রাজনীতি হল পদ্মপাতায় জল, টলমল করছে সর্বক্ষণ। আর তা যদি ভারতবর্ষের রাজনীতি হয় তাহলে তো কথাই নেই, ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ রং বদলাতে থাকে। জোটের চেহারা বদলাতে থাকে, জোটের মধ্যের ইকুয়েশন বদলাতে থাকে আর তার থেকেও বেশি গতিতে বদলাতে থাকে মানুষের মন। আপনি একভাবে ভাবা শুরু করলেন, মানুষ অন্যভাবে ভাবা শুরু করেছে তার আগেই, কাজেই আপনার হিসেব? গৈল ভৈঁসিয়ে পানি মে। সব গোলমাল হয়ে যায়। ২০১৯-এ এ রাজ্যের লোকসভার হিসেব অনেকের গুলিয়েছিল, সব্বাই মনে করেছিলেন সিপিএম বামেদের ভোট কমবে, কমে সম্ভবত ২০-২১ শতাংশ হবে, সেক্ষেত্রে এক ক্লাসিক ট্রায়াঙ্গুলার ফাইটে তৃণমূল ৪২-এ ৪২টাই পেতে পারে, ঠিক আছে দুটো আসন বাদ দিলেও, কম করে ৪০টা তো পাবেই। বামেদের ভোট কমে ৭ শতাংশে ঠেকেছিল, বিজেপি হঠাৎই ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮টা আসন পেয়ে ঘাড়ের কাছে ফোঁস ফোঁস করছিল। কাজেই ২০২১-এ বিজেপির মন্ত্রিসভাতে রুদ্রনীল ঘোষ সংস্কৃতি দফতরে গিয়ে কী কী করবেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, ওদিকে পাবলিক তো পাবলিক, ১০০ তো দূরস্থান, ৭৭-এ আটকে গেল বিজেপি আর বাম-কংগ্রেস শূন্য। রাজনৈতিক পালাবদলের দিক থেকে অত্যন্ত কনজারভেটিভ এই বাংলার যদি এই হাল হয় তাহলে বাকিদের অবস্থা কেমন ভাবুন। গত লোকসভা ফলাফল আসার পরে মনেই হয়েছিল মহারাষ্ট্র এখন সময়ের অপেক্ষা, মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি ১৮৮ তো নিশ্চয়ই আর ওই প্রকাশ আম্বেদকরের বহুজন বঞ্চিত আগাড়ি যদি জোটে এসে যায় তাহলে তো ২০০ পার। কিন্তু দু’ দিন আগেই বলেছি, বিষয়টা তত সরল নয়, ২৮৮টা আসনের মধ্যে ১৯৯টা আসনে আলাদা প্রার্থী দিয়েছে ওই প্রকাশ আম্বেদকরের দল, তারা ভোট কাটবে এমভিএর, অন্যদিকে রাজ ঠাকরের নবনির্মাণ সেনা লড়ছে ১৩৫টা আসনে, তারা দুই শিবসেনার ভোট কাটবে। বিএসপি লড়ছে ২৩৯টা আসনে, কাটবে কংগ্রেসের ভোট, সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে বিকাশ আগাড়ি খানিকটা এগিয়ে, মূলত বিদর্ভ আর মারাঠওয়াড়া থেকে তাদের এগিয়ে থাকাটাই জয় পরাজয় নির্ধারণ করবে। এরসঙ্গে আছে পশ্চিম মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ারের লাস্ট স্পেল পারফরম্যান্স। শিন্ডে শিবসেনা তাদের লাডকি বহিন প্রকল্প নিয়ে দারুণ আশাবাদী, বিজেপি ভাবছে এক চূড়ান্ত কমিউনাল প্রচারের ফলে হিন্দু ভোট এককাট্টা হয়ে তাদের দিকে পড়বে। তবে এটা বলাই যায় আসনের হিসেবে মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাড়ি খানিক এগিয়ে থাকলেও ফল ঘোষণার পরে যে খেলা হবে সেই খেলাতেই ঠিক হবে আগামী মহারাষ্ট্রের সরকার, নির্বাচনে নয়।
ঝাড়খণ্ডেও কাঁটে কি টক্কর। এখানে জেএমএম আর কংগ্রেসের জোট তো হয়েছে, জেএমএম ৪৩টা আসনে, কংগ্রেস ৩০টা আসনে, আরজেডি ৭টা আসনে আর লিবারেশন ৪টে আসনে লড়ছে। সিপিআইএমএল লিবারেশন জোটে থাকলে সিপিআই বা সিপিএমকে কোনও আসন ছাড়েনি জোট কাজেই তারা আলাদা লড়ছে। ওদিকে বিজেপি কিন্তু অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, জনতা দল ইউনাইটেড, লোকজনশক্তি পার্টিকে নিয়ে জোট বেঁধেছে। বিজেপি নিজেই ৬৮টা আসনে লড়ছে, ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ১০টা, জেডিইউ ২টি আর এলজেপি ১টা আসনে লড়ছে। ৮১টা আসনের বিধানসভাতে ৪১ হল ম্যাজিক ফিগার। এমনিতে জেএমএম জোট জিতবেই এমন অবস্থা কিন্তু ছিল না, কিন্তু হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতারের পরে আর তাঁর জামিন পেয়ে বাইরে আসার পরে একটা হাওয়া উঠেছে, যে হাওয়াতে ভর করে জেএমএম কংগ্রেস আরজেডি লিবারেশন জোট আবার ক্ষমতায় আসতে চলেছে। ওখানে হেমন্ত সোরেন বা এই মহা গঠবন্ধনের প্রচারের মূল জায়গাটাই হল আদিবাসী রাজ, ভূমিপুত্রের রাজ, অন্যদিকে বিজেপির প্রচার হল ঘুসপেটিয়া, আদিবাসীদের জায়গা নাকি দখল হয়ে যাচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের আসনগুলির প্রায় ৭০ শতাংশ এক্কেবারে আদিবাসী গরিষ্ঠাংশ আসন, সেগুলোতে অনায়াসেই হেমন্ত সোরেন জিতে যাবেন, জিতবে কংগ্রেসও। কিন্তু মিক্সড এলাকা, ধানবাদ, বোকারো, জামশেদপুর মানে বাংলা লাগোয়া ঝাড়খণ্ড এলাকাতে বিজেপি অনেকটা এগিয়ে আছে। আর এবারের ভোটে ওই চম্পাই সোরেন, যাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি ছেড়ে হেমন্ত সোরেন জেলে গিয়েছিলেন, তিনি কোন খেলা দেখান তা অবশ্যই দেখার। যদিও ঝাড়খণ্ডের মাটিতে গুরুজি বেঁচে থাকতে অন্য কেউ ভোট ভাগ করে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না, কিন্তু চম্পাই সোরেন কি আদিবাসীদের সহানুভূতি পাবেন? যদি পান তাহলে জেএমএম-এর কপালে দুঃখ আছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও ছবি উঠে আসছে না। কিন্তু গতবারে জেএমএম আর কংগ্রেস মিলে যে সংখ্যা পেয়েছিল, তা নিশ্চিতভাবেই আসছে না, সেই সংখ্যা কমবে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পাক বাহিনীর গণহত্যা, গণধর্ষণের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন মহম্মদ ইউনুস
তথ্য বলছে, গত ২৪ বছরে ঝাড়খণ্ডে ১৩ জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কেন? কারণ ওই আদিবাসীদের ভোট বিভাজন। বিজেপি আদিবাসী মুখ নিয়ে মাঠে নেমেছে, আবার রঘুবর দাসের মতো আদিবাসী নয় এমন মুখ নিয়েও নির্বাচনে নেমেছে, কিন্তু আপাতত তাদের ভরসা আদিবাসী মুখেই। তারা এই প্রথমবার আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বাইরে থেকে অনাদিবাসীরা এসে জমি দখল নিচ্ছে, বাংলাদেশ থেকেও লোকজন আসছে ইত্যাদি প্রচার তুঙ্গে তুলেছে, যার প্রভাব কিন্তু জমিতে দেখা যাচ্ছে। ধরুন পাকুড়ের কাছে গাইবাথান, সেখানে আনসারি আর হেমব্রম পরিবারের মধ্যে জমির লড়াই, বিবাদ বহুদিনের, তাই নিয়ে নতুন করে কিছুদিন আগে ঝামেলা শুরু হয়। বিজেপি নেতা বাবুলাল মারান্ডি সেটাকে বাংলাদেশের ঘুসপেটিয়ারা আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিচ্ছে বলে প্রচার শুরু করেন। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এসে ওই প্রচার তুঙ্গে তোলেন, অথচ দুটো পরিবারের বসবাসের কাগজ ১৯৩২ সাল থেকে আর এই বিবাদ প্রায় ৫০ বছরের পুরনো। কিন্তু গাইবাথানের এই ঘটনা গোটা ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি উদ্বাস্তু আর আদিবাসীদের লড়াই বলে চালানো হয়েছে। আদিবাসী মানুষ খানিক বিশ্বাসও করছেন, কে আর গাইবাথানে গিয়ে সত্যিটা জানবে? কাজেই খানিক এগিয়ে থাকলেও মহাগঠবন্ধন জিতে যাবেই এমন কথা বলা যাবে না। তা বলার জন্য ওই ২৩ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তার মানে দুটো রাজ্যের নির্বাচনে ফলাফল কিন্তু এখনও অনেকটাই ধোঁয়াশায়। এরমধ্যে মহারাষ্ট্রে লোকসভার পরে মহারাষ্ট বিকাশ আগাড়ির জয় নিয়ে কোনও সন্দেহই ছিল না, ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেন জেল থেকে বের হওয়ার পরে রাজ্যজুড়ে যে সহানুভূতির ঢেউ উঠেছিল তা ছিল দেখার মতো। কিন্তু কোথাও বিজেপি সেই হাওয়াকে ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে আর কিছুটা হলেও সফল তো বটেই। আর দু’ জায়গাতেই প্রবল কমিউনাল প্রচার, বাংলাদেশ থেকে নাকি দলে দলে উদ্বাস্তু গিয়ে ডেরা বাঁধছে ঝাড়খণ্ডে। জমিতে তার বিরাট কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু এই প্রচার মুসলমান বিরোধী এক হাওয়া তুলেছে, এবং এই প্রথমবার ঝাড়খণ্ডে এই পরিমাণ কমিউনাল প্রচার হল, এর আগে ঝাড়খণ্ডের কয়েকটা এলাকা ধানবাদ, ঝরিয়া, বোকারো বা জামশেদপুর ছাড়া সাম্প্রদায়িক ঝামেলার কোনও খবর কিন্তু ছিল না, আজ সেটা সামনে আসছে।
ওদিকে মহারাষ্ট্রেও ওই একই বটেঙ্গে তো কটেঙ্গে স্লোগান নিয়েই চলছে বিজেপি। তারমানে ওই লোকসভা নির্বাচনে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে বিজেপি বুঝেছে আরও বেশি করেই আঁকড়ে ধরতে হবে সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে। এ রাজ্যের ফলাফল আসার পরে শুভেন্দু অধিকারী সাফ জানিয়েই দিলেন, চাই না আমাদের মুসলমান ৩০ শতাংশ ভোট, আমরা ৭০ শতাংশ নিয়েই খুশি। এটা কেবল বাংলার কথা ছিল না, এটা সারা দেশের প্রিপ্ল্যান্ড কমিউনাল ক্যাম্পেইনের অঙ্গ ছিল যা আজ পরিষ্কার। এবার কোনও হিসেবে শিন্ডে অজিত বিজেপি জোট যদি ২৮৮তে ১৩০-১৩৫ আসনও পেয়ে যায়, তাহলেও তারা সরকার বানানোর চেষ্টা করবে, ঝাড়খণ্ডে তারা সেই চেষ্টা বহুবার করেছে আবারও করবে। কিন্তু যদি দু’ রাজ্যেই তারা সরকার না করতে পারে? তাহলে আবার বিজেপি থমকাবে, আবার বিজেপির নেতৃত্ব, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু এটাও ঠিক সেক্ষেত্রে আরও বেশি করে ওই কমিউনাল এজেন্ডাকে সামনে রেখেই, আরও খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক প্রচার নিয়েই বিজেপি মাঠে নামবে, আরও উগ্র হিন্দুত্বের মুখ যোগীজিকেই হয়তো এগিয়ে দেওয়া হবে। এক সন্ন্যাসীর হাতেই হিন্দু রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব। অন্যদিকে যদি দুটো রাজ্যেই ভেঙে, কিনে জোগাড় করে বিজেপির সরকার আসে, তাহলে এক ধরনেরর স্থিতাবস্তার মধ্যে দিয়েই যাবে বিজেপি দল আর সরকার। কিন্তু কংগ্রেস আর তার রাজনৈতিক জোটের রাজনীতি নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠবে, কংগ্রেস যতক্ষণ না বিজেপির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার স্ট্রাইক রেট বাড়াতে পারছে, ততদিন কংগ্রেসের জোট সঙ্গী হবে আর ভাঙবে। কংগ্রেসকে ম্যারাথন রানার হতে হবে, আপাতত কংগ্রেসকে দেখে মনে হয় একটা ১০০ মিটার দৌড়ের পরে বসে জিরোচ্ছে, ছোট ছোট শানদার পারফরম্যান্স কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। আজ ১৯ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন, ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা কংগ্রেসকে ওই ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকেই নিতে হবে। ১৯৭৭ সালে হেরে ভূত কংগ্রেস, কেবল হার নয়, দলের নেতারা দেবরাজ আর্স, প্রিয়রঞ্জনের মতো নেতারা কংগ্রেস ছেড়েছেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কংগ্রেস ছেড়েছেন, জরুরি অবস্থার জন্য সবাই দুষছে ইন্দিরাকে। সেই সময়ে জুলাই মাসে খবর এল বিহার শরিফ থেকে, বিহারের অখ্যাত গ্রাম বেলচিতে হরিজনদের কচুকাটা করা হয়েছে, সেই অঝোর বৃষ্টির মধ্যে ইন্দিরা বললেন বেলচি যাব। গাড়ি যাচ্ছে না, অন্য গাড়ি এল, সেটাও যাচ্ছে না। হাতি নিয়ে আসা হল, হাতির পিঠে চেপে ইন্দিরা সেই বেলচি গ্রামে, ওটাই ছিল সেই বেলচি মোমেন্ট, খবরের কাগজে সেই ছবি, সেই একগুঁয়ে ইন্দিরার ছবি, সেই ম্যারাথন দৌড়, আবার কংগ্রেস ফিরেছিল। আজ আবার সেই বেলচি মোমেন্ট চাই, রাহুল প্রিয়াঙ্কা ছাড়া সেই মোমেন্ট আর কেউ এনে দিতে পারবে না, আর ওই বেলচি মোমেন্ট ছাড়া কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। কংগ্রেস নিজের স্ট্রাইক রেট না বাড়াতে পারলে আজ এই জোট হবে, কাল ভেঙে যাবে, হেমন্ত সোরেন যদি এবারে ক্ষমতায় না আসেন, জোট থাকবে? হেমন্ত সোরেন কোনদিকে যাবেন তারও কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? কাজেই দুই রাজ্যের নির্বাচনে যদি কংগ্রেস খানিক ভদ্রসভ্য রেজাল্ট পায় তাহলেও ম্যারাথনের জন্য প্রস্তুতি দরকার, একমাত্র তাহলেই কংগ্রেসের নেতৃত্বে এক বড় জোট গড়ে ওঠা সম্ভব।