দিল্লিতে আমাদের ‘পরধান সেভক’ আপ দলকে আপদ বলেছেন আর আপ দলের কর্ণধার অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিজেপিকে দেশের সবথেকে বড় বিপদ বলে জানিয়েছেন। যদিও সঙ্গে তাঁরা এটাও বলেছেন যে তাঁরাই নাকি বিজেপিকে হারাতে পারবেন, তারজন্য কংগ্রেসের দরকার নেই। হ্যাঁ এই কথাটা বাংলাতে তৃণমূল নেত্রীও বলে থাকেন। কাজেই এই শুনেই আম আদমি পার্টি আর তৃণমূলের মধ্যে অনেকে মিল দেখতে পেয়েছেন, তাঁদের বোধশক্তির ওপর কিছুটা করুণাই হয়, দুটো দল অবিশ্বাস্য রকমের আলাদা, কিন্তু বারবার এই তুলনামূলক আলোচনা অনেক রাজনৈতিক পণ্ডিতের মুখে শুনেছি। আম আদমি পার্টি তৈরি হচ্ছে মূলত কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি, আর সেই সময়ের বিরাট ইস্যু নারী সুরক্ষাকে কেন্দ্র করে আন্না হাজারের আন্দোলনের পিঠে ভর দিয়ে। আন্না হাজারের আন্দোলন ছিল বিজেপি-আরএসএস-এর পূর্ণ এবং প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গড়ে ওঠা এক আন্দোলন, সুষমা স্বরাজ থেকে অরুণ জেটলি, রামদেব থেকে কিরণ বেদীর আজকের চেহারা দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। একটা অংশে ছিলেন বাম ঘেঁষা যোগেন্দ্র যাদব, ছিলেন প্রশান্ত ভূষণ, আর মধ্যপন্থী মণীশ সিসোদিয়া, অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছিলেন কুমার বিশ্বাস বা আশুতোষের মতো লোকজন। আন্না হাজারের পিঠে ভর দিয়েই কংগ্রেস সরকারকে ফেলে ক্ষমতায় এল বিজেপি কিন্তু ওই আন্দোলন থেকেই আগে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না থাকা কিছু লোকজন কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আপ তৈরি করে ফেলল। নতুন স্লোগান, নতুন দল, নতুন মুখ আর রকেটের মতো উত্থান এবং খুব তাড়াতাড়িই বিরাট ভাঙন, এই দলের মধ্যে লেফট লিবারেলরা বেরিয়ে গেলেন, দল হয়ে গেল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের, দেশের আর পাঁচটা দলের মতোই যার চেহারা।
অন্যদিকে সেই কবে ১৯৮৪-তে সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে জায়েন্ট কিলার মমতা ব্যানার্জি, সিপিএম আর কংগ্রেসের ভিতরের সিপিএম-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলা নেতাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে ১৯৯৮-এর পয়লা জানুয়ারি তৈরি করলেন তৃণমূল, এবং রকেট উত্থান? এক্কেবারেই নয়, ২০০৪-এর লোকসভায় একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন দলের সাংসদ, অনেকেই এই দলকে তখনই রাইট অফ করে দেওয়ার কথাও বলেছেন, সেই দল বিজেপির হাত ছেড়ে সময় মতো জমি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেকটা বাম এজেন্ডাকে সামনে রেখেই ক্ষমতায়, আর দু’ চারটে ছিটফুট ভাঙন এসেছে বইকি, কিন্তু বড় ভাঙন যাকে বলে তা আসেনি, আর যেটুকু ভেঙেছে তাতে তৃণমূলের ক্ষতি হয়নি, বরং দলের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত আরও শক্তিশালী হয়েছে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই সেই শুরুর থেকেই প্রথমে সিপিএম, পরে বিজেপির বিরুদ্ধে, ওনার লড়াই কোনও কালেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ছিল না। অন্যদিকে আম আদমি পার্টির লড়াই ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে, এখনও পঞ্জাবে তাদের লড়াই ওই কংগ্রেসের সঙ্গেই। কাজেই এখনও পর্যন্ত এক বাম ধারার রাজনীতির বেশ কিছু উপাদান নিয়ে তাকে জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মিশিয়ে সংখ্যালঘুর সমর্থন বরকরার রেখেই সংখ্যাগুরুর অনুভূতিকে ভালোরকম চাগিয়ে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধায়্যের যে ঝাঁঝালো ককটেল, তার সঙ্গে আপ-এর কোনও মিলই নেই। ওনারা লেফট লিবারেল পোজিশন ছেড়ে ক্রমশ মধ্যপন্থায় পা দিয়েছিলেন তারপর ওই সব অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ইত্যাদিকে চুলোর দুয়োরে পাঠিয়েই ডাইরেক্ট বেনিফিশিয়ারির রাজনীতিতে নেমেও খুব আত্মবিশ্বাসী বব কেজরিওয়াল, তাই আরএসএস সরসংঘচালককে চিঠি দিয়ে হিন্দু ভোট বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, এবং এই মুহূর্তে বিজেপি আর কংগ্রেস দুজনের বিরুদ্ধেই সমান তীব্রতায় লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছেন আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এর আগে দু’ দু’ বার বিজেপিকে যাকে বলে ধুল চাটায়া, কিন্তু আরও অবাক কাণ্ড লোকসভাতে দু’বারই চূড়ান্ত পরাজয় বলে দেয় দিল্লির মানুষজন আপকে ওই কর্পোরেশন চালানোর দায়িত্ব দিতে চায়, রাস্তাঘাট আলো মহল্লা ক্লিনিক, সরকারি স্কুল আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের বাইরে আর কোনও দায়িত্ব দিতে রাজি নন। দেশের সরকার চালানো, দেশের আইন তৈরি করার মতো বড় ব্যাপার স্যাপার আপ-এর হাতে যাক, এটা অন্তত দিল্লির মানুষজন এখনও চাইছেন না।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি অমিত শাহের সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
পঞ্জাবেও রাজ্য চালাতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছে মান সরকার, প্রতি পদে পদে ভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি, না তারা লড়াকু কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দেখাচ্ছে, না রাজ্যের বাড়তে থাকা খলিস্তানি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছে। সব মিলিয়ে আম আদমি পার্টি এখনও দেশের এক পাকাপোক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবেই দাঁড়াতে পারেনি। তাহলে দিল্লিতে কী হবে? ওই দেখবেন, শাসকদলের সুনামির মধ্যেও কর্পোরেশন, মিউনিসিপালিটির কয়েকটা ওয়ার্ডে ধারাবাহিকভাবেই জিতে যান বিরোধী প্রার্থী। তিনি জেতেন তাঁর কাজের জন্য, সেরকম মানুষও আছেন যিনি জল জমে গেছে খবর পেয়ে নিজেই লাঠি শাবল নিয়ে নালা সাফ করতে লেগে গেছেন, তেমন মানুষকে মানুষ ভোট দেয়, দল দেখে নয়, কাজ দেখে। দিল্লির জুগগি ঝোপড়ি থেকে বিভিন্ন ঝাঁ চকচকে মহল্লাতেও আম আদমি পার্টির ভাবমূর্তিটা খানিক সেই রকমের, কাজেই সেই কাজের ভিত্তিতেই তারা জিতেছে, তাদের রাজনীতির জন্য নয়, রাজনৈতিক জমি থাকলে ৭টা লোকসভাতেই এরকম প্রবল হার অসম্ভব ছিল। প্রথম বিধানসভাতে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিজুলি সরকার করেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সরকার বেশিদিন চলেনি, দ্বিতীয় বার বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এসেছেন, আর সেই পর্যায়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার অক্ষম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কিছুটা সফল পঞ্জাবে। তৃতীয়বারেও বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিন্তু এই পর্যায় থেকেই আম আদমি পার্টির পিছনে লাগাতার হানা দিল ইডি আর সিবিআই। দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের থেকে উঠে আসা কেজরিওয়ালকেই জেলে পোরা হল। দলের দু’ নম্বর নেতা, মন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়াকে জেলে পোরা হল, রাজ্যসভা সদস্য সঞ্জয় সিংকে, আরও বেশ কিছু নেতামন্ত্রীকে জেলে পোরা হলো। হ্যাঁ সবাই জামিনে, কিন্তু অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়নি।
কিন্তু ইতিমধ্যেই আপ দখল নিয়েছে দিল্লি নগর নিগম, তার ওই আলো জল দেওয়ার ক্ষমতা বেড়েছে, মানে গতবারের নির্বাচনের সঙ্গে এবারের দিল্লি নির্বাচনের মূল ফারাকটা হল সেবারে আপ বাড়ছিল, আর সেবারে আপ-এর বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, এমন ঢালাও জেল ভরো হয়নি। কিন্তু সেই দুর্নীতির অভিযোগ তো এই বাংলাতেও আছে, ইন ফ্যাক্ট অবিজেপি দল শাসিত প্রত্যেক রাজ্যেই সরকারের দূর্নীতি নিয়ে ইডি আর সি বি আই এর যৌথ অভিযান এমন এক পর্যায়ে গেছে যা মানুষকে প্রায় চোখে আঙুল দিয়েই বুঝিয়েই দিচ্ছে যে এগুলো আসলে বিরোধিতার ফল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান নয়, কাজেই ওই দুর্নীতির যে সামাজিক প্রভাব পড়ার কথা, নির্বাচনে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ভাবে ফলাফল আসার কথা তা আসছে না। কাজেই কেজরিওয়ালের জামিন পাওয়াটাই এক বিরাট সেলিব্রেশন হয়ে গেল কিছুদিন আগে, মনে হচ্ছিল কী বিরাট রাজকার্য সেরে তিনি তিহাড় জেল থেকে বের হচ্ছেন। বিজেপির বাঁধনছাড়া ইডি সিবিআইকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা কোথাও এই দুর্নীতির অভিযোগকেই ফিকে করে দিয়েছে। কাজেই এবারেও দিল্লিতে সেই দুর্নীতির অভিযোগ কি খুব বেশি দাগ কাটতে পারবে? মনে হয় না। দু’ নম্বর ব্যাপার হল কংগ্রেসের বিরোধিতা, এর আগে তিনটে বিধানসভা নির্বাচনে একটা লোকসভা নির্বাচনে আপ আর কংগ্রেস আলাদাই লড়েছে, আপ অনায়াসে জিতেছে, গত লোকসভাতে কংগ্রেসের সঙ্গে একটা বোঝাপরা হয়েছিল বটে কিন্তু তাতে কোনও লাভও হয়নি, দু’ তিনটে পকেট ছাড়া কংগ্রেস ওখানে কোনও শক্তিই নয়। কিন্তু, কিন্তু যদি তারা ২-৩ শতাংশ ভোট বাড়াতে পারে? তাহলে নিশ্চিত কেজরিওয়াল বিপদে পড়বেন। আর ঠিক এই মুহূর্তে এটাই কেজরিওয়ালের সবথেকে বড় মাথাব্যথা।
উনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গোটা ইন্ডিয়া জোটকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে চাইছেন, সেরকম একটা কথাবার্তাও চলছে, সেটা আবার জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও খুউউব গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই সেদিকে তো সবার চোখ থাকবেই, আর সেটা হলে বিজেপির দু’ ধারেই জয়, দিল্লি কেজরিওয়ালের হাতেই থাক না, বিরোধী জোট যদি কংগ্রেসী আর অকংগ্রেসিতে ভেঙে যায়, তাহলে বিজেপির উল্লাস উল্লাস। তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এবং কেজরিওয়ালের বিলি বণ্টন, গতবারে কেবল মহিলাদের বাসের টিকিট আর মহল্লা ক্লিনিক আর ফ্রি বিদ্যুৎ-এর ঘোষণা ছিল, এবারে বাংলার মডেলকে কার্বন কপি করে ছেড়েছেন। পুরোহিত ভাতা, গুরুদ্বারাতে গ্রন্থীদের ভাতা, ইমাম ভাতা থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পুরো জলছবি নামিয়ে দিয়েছেন। ওই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের, মানে ওই মাইয়া সম্মান যোজনা বা লাডকি বহিন যোজনার উপরে ভর দিয়ে জিতে এল শিন্ডে সরকার, হেমন্ত সোরেনের সরকার, সেই আশায় ২০০০ টাকার মুখ্যমন্ত্রী মহিলা সম্মান যোজনা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই রেখেছেন কেজরিওয়াল। ওনার বৈপ্লবিক শিক্ষা প্রকল্প ইত্যাদির বদলে আপাতত এই মিষ্টান্ন মিতরে জনা প্রকল্পই কি ওনার ফিরে আসার চাবিকাঠি? হতেই পারে। তাহলে নেট নেট হাল হকিকতটা কেমন। আগের বার বা তার আগেরবারের সুইপ ভুলে যান, এবারের লড়াই অনেক বেশি হাড্ডাহাড্ডি।
এখানে কংগ্রেসের ভূমিকা খানিক নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার মতো। কিন্তু তারা সেটা কতটা করতে পারবে সেটা দেখার। কারণ কংগ্রেস গত বেশ কয়েকটা নির্বাচনে আবার তাদের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক ফিরে পাচ্ছে, তা যদি হয়, তাহলে কেজরিওয়ালকে বিরোধী শিবিরেই বসতে হবে। কেজরিওয়ালের হিন্দু হয়ে ওঠার এই নৌটঙ্কিকে দিল্লির হিন্দুরা কীভাবে নিচ্ছেন? মাথায় অনায়াসে ভস্ম মেখে ৩৩টা ক্যামেরার সামনে ডুবকি লাগাতে পারেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সঙ্গে হিন্দুত্বে পাল্লা দেওয়া, তাও আবার উত্তর ভারতের আবহে খুউউব খুউউব কঠিন ব্যাপার। এবং গত নির্বাচনের হিসেব বলছে সংখ্যালঘু এলাকাতে কংগ্রেসের ভোট ভালরকম বেড়েছে। সবমিলিয়ে আম আদমি পার্টি বার বার তিনবার অনায়াসেই হবে বলার মতো অবস্থায় এখন আর নেই, এবারের লড়াইয়ে দিল্লি গেলে আপ-এর রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি হবে, আর জিতলেও সেটা কেক ওয়াক হবে না। এবারেও দু’ধারের সেনাপতি কিন্তু এক, একধারে কেজরিওয়াল, অন্যদিকে অমিত শাহ, ধুন্ধুমার লড়াই আরও খানিক এগোলে আবার হাজির হব আমাদের পরবর্তী সমীক্ষা নিয়ে।