ভারত–৪ হংকং–০
(আনোয়ার আলি, সুনীল ছেত্রী, মনবীর সিং, ঈশান পন্ডিতা)
ওস্তাদের মার শেষ রাতে।
টুর্নামেন্টের সেরা ম্যাচটা ভারত খেলল তাদের শেষ ম্যাচে। প্রথম দুটি ম্যাচে কম্বোডিয়া এবং আফগানিস্থানকে হারালেও সেই জয়ে এতটা দাপট ছিল না যা হংকং ম্যাচে দেখাল ভারত। জয় একেবারে এক গণ্ডা গোলে। এ ছাড়াও গোল হতে পারত আরও। সাহাল আব্দুল সামাদের শট বারে লেগেছে, সুনীল ছেত্রীর শট বাঁচিয়েছেন হংকং গোলকিপার। সব সুযোগেই অবশ্য গোল হয় না। তবু ভারত যে রকম ভাবে একচ্ছত্র প্রাধান্য রেখে মঙ্গল সন্ধ্যায় সল্ট লেক স্টেডিয়ামে হংকংকে হারাল তার উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় রউটবলে নেই। এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের গ্রুপ ডি-তে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েই গেল মূল পর্বে। ২০১৯-এর পর আবার ২০২৩-এ। আর এই যাত্রায় তাদের সেরা প্লেয়ার হলেন সুনীল ছেত্রী। এখন থেকে এগারো বছর আগে দোহাতে যখন ভারত এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলেছিল তখন সুনীল ছিলেন বাইশ বছরের তরুণ। এখন ৩৭ বছর বয়সে বানপ্রস্থে যাওয়ার পথে। কিন্তু এখনও তাঁর ফুটবলে তারুণ্যের ঝলক। গ্রুপ লিগের তিনটি ম্যাচে চারটি গোল করে তিনিই টপ স্কোরার। ১২৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৮৪টি গোল করা হয়ে গেল সুনীলের। ভারতের কোচ ইগর স্টিমাক তো বকেই দিয়েছেন ১০০ গোল করার আগে তিনি সুনীলকে ছাড়বেন না। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ-ই বলবে। আপাতত বাস্তব হল এশিয়ান কাপে ভারত কোয়ালিফাই করল মাথা উঁচু করে।
বাকি দিনটা কেমন যাবে তা সকালেই অনেকটা বোঝা যায়। মঙ্গলবার সকালেই খবর আসে হংকং ম্যাচে ভারতের ফল যাই হোক ভারত এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করে গেছে। কারণ সেরা পাঁচটি রানার্সের মধ্যে ভারত ঢুকে পড়েছে। হংকং ম্যাচ ড্র হলে কিংবা ভারত হারলে কী হবে তা নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা না করে খৌলা মনে খেলতে নামে ভারত। এবং দু মিনিটের মধ্যে গোল করে ভারতকে এগিয়ে দেন সেন্টার ব্যাক আনোয়ার আলি। রোশন নাওরেমের কর্নার থেকে বল এ মাথা, ও পা করতে করতে চলে আসে বক্সের মধ্যে। সেখানে জটলার মধ্যে বলটা আনোয়ারের পায়ে পড়তেই দুরন্ত শট এবং গোল। সেই যে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ভারতের পায়ে এসে পড়ল তা বজায় ছিল শেষ মিনিট পর্যন্ত। চার গোল তো আর এমনি এমনি হয় না।
গ্যালারিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শক। তার উপর প্রথমার্দ্ধের মাঝ বরাবর আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। দুটো ফ্যাক্টরই গেছে ভারতের পক্ষে। ইগর স্টিমাক এদিন দল গঠনে একটু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মনবীর সিং এবং লিস্টন কোলাসোকে না নামিয়ে তিনি শুরু থেকে সুনীল ছেত্রীর সঙ্গী করে দেন উদান্ত সিং এবং সাহাল আব্দুল সামাদকে। মাঝ মাঠে সুরেশ, জিকসন এবং আশিক কুরুনিয়ন। এই কম্বিনেশনটা কিন্তু ক্লিক করে যায়। হংকংয়ের ছেলেদের উচ্চতা খুবই খাটো। তবে তাদের গতি বেশ ভাল। পায়ে ভাল ড্রিবল আছে। কাউন্টার অ্যাটাকে তারা হু হু করে উঠছিল। কিন্তু বক্সের মধ্যে একটা ভাল পাস করার কিংবা শট নেওয়ার মতো দক্ষ ফুটবলার তাদের দলে ছিল না। উচ্চতায় খাটো অ্যাটাকারদের সামাল দিতে তাই সন্দেশ ঝিঙ্গন কিংবা আনোয়ার আলিদের তাই কোনও অসুবিধেই হয়নি। তবু ওরই মধ্যে একবার গুরপ্রীতকে একা পেয়ে গিয়েছিল হংকং। কিন্তু তাড়াহুড়োয় বল বারের উপর মেরে তারা নষ্ট করে। গুরপ্রীতকে দেখছি সেই ২০১০ সাল থেকে। ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলতেন তখন। ২০১১ সালের এশিয়ান কাপে দোহাতে ভারতের তিন গোলকিপারের একজন ছিলেন। তখন তো সুব্রত পালের যুগ। গুরপ্রীত তিনটে ম্যাচের একটাতেও খেলার সুযোগ পাননি। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা এখন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। ভারতের বারের নীচে তিনি রীতিমতো নির্ভরতার প্রতীক। তবে এই টুর্নামেন্টে তাঁর সে রকম পরীক্ষা হয়নি। এশিয়ান কাপের মূল পর্বে গুরপ্রীতকে দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
ভারতের দ্বিতীয় গোলটা বিরতির ঠিক আগে। ৪৬ মিনিটে। জিকসন সিংয়ের ফ্রি কিক-টা ফলো করে সুনীল ছেত্রী যখন ডান পায়ে ধরলেন তখন গোটা হংকং ডিফেন্স তাঁর পিছনে। আর সামনে শুধু গোলকিপার। বাঁ পায়ের আলতো পুশ এবং গোল। চুনী গোস্বামী একবার ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন, “বাইচুংয়ের চেয়ে সুনীল ছেত্রী স্ট্রাইকার হিসেবে অনেক এগিয়ে।” চুনী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু সুনীলকে এই ৩৭ বছর বয়সে নিয়মিত গোল করতে দেখলে চুনীর সেই কথাগুলো মনে পড়ে।
দু গোলের লিড নিয়ে ভারত যখন বিরতির পর খেলতে নামল তখন আস্তে আস্তে স্টিমাক তাঁর রিজার্ভ বেঞ্চকে নামানো শুরু করলেন। সুরেশের বদলে গ্লেন মার্টিন্স আসায় কোনও ইতর বিশেষ হয়নি। কিন্তু উদান্ত সিং আর সাহাল আব্দুল সামাদের পরিবর্তে মনবীর সিং এবং লিস্টন কোলাসো নামায় ভারতের আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়ে। এবং শেষ দিকে ভারত আরও দুটো গোল করে ফেলে। সুনী। ছেত্রীর বদলি ব্রেন্ডন ফার্নান্ডেজ ডান দিকে নীচু সেন্টার রাখেন বক্সের মধ্যে। সেই বলটাই ডান পায়ের জোরালো শটে গোল করে ফেলেম মনবীর। আর আশিক কুরুনিয়নের বদলে নামানো হয় ঈশান পন্ডিতাকে। মনবীরের পাস থেকে দিনের চতুর্থ গোলটা করে তিনি যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার তিন ম্যাচের মধ্যে মাত্র দশ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে জ্বলছিলেন। সামান্য সুযোগে গোল করে ওই উচ্ছ্বাসটা সেই জ্বলুনিরই বহিঃপ্রকাশ।
এই সবেরই যোগফল মাথা উঁচু করে ভারতের এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করা। টুর্নামেন্ট ২০২৩-এ হবে না ২০২৪-এ তা এখনও চুড়ান্ত হয়নি। তবে সুনীল ছেত্রীর দলবল যে সেখানে দুরন্ত লড়াই করবে তার ইঙ্গিত দিয়ে গেল কলকাতার এই টুর্নামেন্ট।