আইপিএলের শুরুর বছরগুলোয় আরসিবি-র ম্যাচ থাকলে অফিসের যাবতীয় লোকেদের বাধ্যতামূলক মাঠে পাঠানো ছাড়াও বিজয় মালিয়া নাকি বেশ কিছু টিকিট কেনাতেন। লোক পাঠাতেন আরসিবি জার্সিতে। যাতে ইডেনের শব্দব্রহ্মাণ্ডে তাঁর টিম অসহায় না হয়ে পড়ে। ফেসবুকের ভাষায় অনর্গানিক গ্রোথ। কৃত্রিমভাবে তৈরি চাহিদা।
অর্গানিক গ্রোথ হল যা স্বাভাবিকভাবে টাকা পয়সা দিয়ে কৃত্রিম বুস্টিং না করেই আসে। বৃহস্পতিবার রাতের ইডেন যেমন। সব অর্থেই মায়াবী। আর পাঁচটা দিনে যা ঘটে না সেগুলো ম্যাচের বল পড়ার আগেই ক্রমান্বয়ে ঘটতে শুরু হয়ে গেল। খেলা শুরুর দু’ঘণ্টা আগে ইডেন মুখোমুখি কাস্টমস মাঠে চ্যানেলের জন্য প্রাক ম্যাচ শো করতে গিয়ে দেখি, এত চিৎকার হচ্ছে যে সঙ্গে থাকা সাংবাদিক বুমে কী বলছে, শুনতেই পাচ্ছি না। চিৎকারটা আরও অবাক করার মতো— কারণ তা কেকেআর নয়, আরসিবি-র নাম করে ঘটছে। শো শেষ করে দেখি ক্লাব হাউসের উল্টোদিকের কাঠের পাটাতনের ওপর সার সার দাঁড়িয়ে কিছু তরুণ। এদের পরা লাল জার্সি আর পেছনে লেখা বিরাট। কেকেআর সাম্রাজ্যে এইরকম ভিনদেশি অনুপ্রবেশ এর আগে শতাব্দী প্রাচীন মাঠ একবারই দেখেছে। যখন পুনের হয়ে ২০১২ সালে গাঙ্গুলি নেমেছিলেন। তখন বলা হয়েছিল ইডেন আবার বঙ্গভঙ্গ দেখল। এ যে বাংলা বনাম বাঙালি।
আরও পড়ুন: IPL 2023 | বিরাট’ সমর্থনের গঙ্গাপ্রাপ্তি, কেকেআরকে জেতালেন লর্ড শার্দূল আর স্পিনাররা
কিন্তু বৃহস্পতিবারের চরম অপ্রত্যাশিত বঙ্গভঙ্গ তো বাংলা বনাম বাঙালি নয়। বাংলার অর্ধেকটা বেঙ্গালুরুর হাতে চলে যাওয়া। মাঠে ঢুকে দেখি সেখানেও লাল পতাকা আর চারদিকে বিরাট জার্সিতে তরুণের ঝাঁক। অতীতে ধোনি বা শচীনও তো তুমুল ক্যাপটিভ অডিয়েন্স দেখিয়েছেন। কিন্তু সেটা এককভাবে। ধোনি ও ধোনি। ধোনি ও সিএসকে নয়। শচীন প্লাস শচীন। শচীন ও এমআই নয়। তাহলে কোন জাদুবলে কোহলি ও আরসিবি মাদকতা এই পর্যায়ের হল যে শাহরুখ বক্সে ঢুকে হাতটাত নাড়ার পরেও তাঁর সামনেই ইডেনের ষাট শতাংশ অতিথিদের জন্য তুমুল হাততালি দিয়ে চলল? এক একটা উইকেট পড়ছে আর আরও বেশি করে চিন্নাস্বামী হয়ে যাচ্ছে ইডেন। এসআরকে-র বিস্ফারিত হয়ে যাওয়া উচিত, কী করে শহরের টিম তার বিখ্যাত মালিকের উপস্থিতিতেই শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? সিএবি-তে বসে তখন কেউ কেউ বলছেন, শাহরুখ আজ বুঝবে স্টার প্লেয়ার না খেলিয়ে আর স্থানীয় বেঙ্গল ক্রিকেটারের দিকে মুখ ফেরানোয় কী ক্ষতি এখানে ব্র্যান্ডটার হয়েছে।
কেকেআর তখন ৮৯-৫। বক্সের এককোণে বসে পড়েছেন শাহরুখ। ম্যাচ যাঁর ঘোরানোর কথা সেই আন্দ্রে রাসেল প্রথম বলে মারতে গিয়ে আউট। এইরকম একটা শটের জন্য
কপিল দেবকে জীবনে মাত্র একবার বাদ পড়তে হয়েছিল। এখন অবশ্য দিনকাল অন্য। সাদা বলের যুগে সহনশীলতা অনেক বেড়েছে। ওটা ছিল পুরোনো পৃথিবী। এটা নতুন।
আর এই নতুন পৃথিবীতেও চরম বিস্ময়কর কিছু ঘটনা ইডেন এদিন দেখাল। মঞ্চ ছিল রাসেলের। মঞ্চ ছিল কোহলির। সেটা নিয়ে গেলেন কিনা শার্দূল ঠাকুর। তাঁর ২৯ বলে ৬৮ রান কেকেআরের আর্কাইভে থাকার মতো। এক কথায় বলা যাক সেলিম দুরানিকে সম্মান জানানোর পক্ষে উপযুক্ত। রিঙ্কু সিংয়ের ৩৩ বলে ৪৬ আবার হবে। কিন্তু শার্দূলের গর্জন মরশুমে হয়তো একবারই। নাকি কম বললাম? লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করতে চেয়েছিলেন। লর্ড শার্দূল ১১৮ বছর বাদে দ্বিতীয়টা রুখলেন একাই বিরাটদের ম্যাচ থেকে উড়িয়ে দিয়ে। গ্যালারি আবার কেকেআরে ফিরল। আবার শাঁখ বাজা শুরু হল মাঠ জুড়ে।
ম্যাচে কী ঘটেছে এতক্ষণে সবাই জানেন। লিখছি না। তবে মায়াবী কেন বললাম শুরুতে ? শুধু বঙ্গভঙ্গের জন্য নয়। শুধু শার্দূলের জন্য নয়। কত কিছু আজব ব্যাপার।
সিরাজের দিনের ফার্স্ট বলটা যেমন লাফিয়েছিলো তাতে মনে হয়েছিল এটা পুরোনো পারথ পিচ। কেকেআরের স্পিনিং দাপট ও বল ঘোরা। তারপর নিচু হওয়া দেখতে দেখতে মনে হল এ তো ৯৬-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। পরে ব্যাট করে ভারত ডুবেছিল। আজ কি আজহারের মতোই হাল হল ডুপ্লেসির? জানি না। চারদিকে এত কেকেআর, কেকেআর চিৎকার হচ্ছে যে মাথা কাজ করার উপায় নেই।