খবর এসে গেছে তারা আসছে, তারা নাকি দলবল বেঁধেই আসছে অতএব বাইরের গ্রিলে তালা দেওয়া হল, তারপর সদর দরজায় তালা, তাতেও সামলানো না গেলে ভেতরের ঘরে ঢুকে তালা দিতে হবে, মুন্ডু গেলে খাবটা কী? এ চিন্তা তো সবারই থাকে। তো খানিক পরেই যেমনটা খবর ছিল, তাঁরা দলবল বেঁধে এলে, বেরিয়ে আয় ইয়ের ছেলে গোছের মধুর বুলি শোনা যাচ্ছে। তাদের হাতে বাঁশ আর লোহার রড, তারা বাইরের গেট প্রায় ভেঙে ফেলেছে, মূল ফটকের দিকে হানো আঘাত। কয়েকজন রামভক্ত হনুমান পাঁচিল টপকিয়ে ভেতরে ঢুকেছে, ভেতরের বাসিন্দারা ফোন করছেন দাদাগো এসো, এবার বুঝি প্রাণ যায়। আরে দাঁড়া দাঁড়া, বাইরে শক্ত তালা আছে, পুলিশকে ডাকছি, একটু ধৈর্য ধর। সল্টলেকে বাংলা বিজেপির অস্থায়ী দফতরে গতকাল সন্ধ্যের ছবি। বাইরে নব্য বিজেপি, ভেতরে আদি নাকি উলটো বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু ঘণ্টাখানেক ধরে এই চলেছে। এক্কেবারে নাম ধরে ধরে কাঁচা গালিগালাজ, ঠিক ওই ভাষায় যা আপনারা সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজেপির ট্রোল বাহিনীকে ব্যবহার করতে দেখেন। ওনাদের সবথেকে প্রিয় হল অন্যের স্ত্রী, অন্যের মা, এবং বোন। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি, চোখা চোখা গালিগালাজ, ধাক্কা ধাক্কি, কিল চড়, লাথি ঘুসি। আসলে দুই পক্ষই তো বাংলার উন্নয়ন করতে চায়, তো উন্নয়ন করার আগে একটু গা গরম করে নিচ্ছে আর কি। আচ্ছা এই ঘটনা কি কেবল ঐ সল্টলেকের? না, এ ঘটনা বাংলার সর্বত্র, উত্তর থেকে দক্ষিণে যাকে বলে ইনার পার্টি আর্মস স্ট্রাগল চলছে বিজেপি তে, মিছিলের মধ্যে ১০ জনকে ধরে পিটিয়ে দেওয়া হল, ধুপগুড়ি নির্বাচনের ঠিক আগে, তারাও প্রার্থীকে ফুল দিতেই এসেছিল, কেবল বলেছিল এই বহিরাগত প্রার্থী তাঁদের পছন্দ নয়, ব্যস, দে দমাদ্দম। সেটাই বিষয় আজকে, দলীয় কোন্দলে বেসামাল বিজেপি নেতাদের প্রাণ বাঁচাতে পুলিশ ডাকতে হচ্ছে?
কেবল কি ধূপগুড়ি বা সল্টলেকেই বিক্ষোভ? না তাও নয়, এই একই চেহারার বিক্ষোভ দেখা গেছে বারাসাতে, সেখানে এক গোষ্ঠিয়াগেভাগে গিয়ে দলের কার্যালয়ে তালা মেরে দিয়েছে, আমরাও ঢুকবো না, ওদেরও ঢুকতে দেবো না, তালা ভাঙো, ভাঙতে দেবো না, নেতা ডাকো, হাজার ফোন হুজ্জুতের পরে দপ্তর খোলা হয়েছে। গাইঘাটাতেও এই ছবি দেখেছি, তবে বাঁকুড়ার বিষয়টা ছিল অভিনব, মন্ত্রীকে দপ্তরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে চাবি খো যায়, এদিকে মন্ত্রী কমরে মে বন্ধ হ্যায়, চাবি পাশের নালা বা পানা পুকুরে। পুলিশ এসে তালা ভেঙে মন্ত্রীকে বার করলো, দুধুভাতু হলেও আফটার অল মন্ত্রী তো। সাসপেন্ড করে দেবো ইত্যাদি প্রচুর হুমকি দিয়েছিলেন বটে মন্ত্রী মশাই, বদলায়নি কিছুই, উলটে শুনতে হয়েছে আসছে বছর আবার হবে। সারা বাংলা জুড়ে এসব হচ্ছে কেন?
আরও পড়ুন: বকেয়া টাকার আন্দোলন, তৃণমূল, বাম ও বিজেপির ভূমিকা
এক কথায় উত্তর হল গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলে এরকমই হয়। সিপিএম কে আজকে দেখলে বোঝা যাবে না, প্রতিটি ইস্যুতে, সে ভুল হোক আর ঠিক হোক, রাস্তায় নেমেছেন, মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকেছেন, মার খেয়েছেন, জেলে গেছেন, মানুষকে বুঝিয়েছেন, মিটিং মিছিল সমাবেশ করেছেন। ক্ষমতায় এসেছেন। তৃণমূলকে দেখুন, আপনার বিরোধিতা থাকতেই পারে, ইস্যুতে একমত নাও হতে পারেন কিন্তু তারাও প্রতিটি ইস্যু নিয়ে ঝড় তুলেছে, আমি জানি, পুলিশ কর্তাদের কাজ ছিল আগামী কাল মমতা ব্যানার্জী কী করবেন সেটা জানা, পুজোর কটা দিম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও ধরণা, আন্দোলন করতেন না, এক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন পুজো সারাবছর চললেই তো পারে। কিন্তু বিজেপির? তাদের বোঝানো হয়েছে ইডি আসছে, সি বি আই আসছে তারপর ব্যস, ঝরাত করে সরকার পড়বে আর আমরা পাকা আমটির মত কুড়িয়ে খাবো। এই আশ্বাস পেয়ে বাম, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা নেতারা পোচুর বাওয়াল দিয়েছেন, এবার ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছেন, পুরনোরা ভাবছে এরা আবার কারা? নতুন্রা ভাবছে এগুলো অপদার্থ। কাজেই সুকান্ত, শুভেন্দু, অমিতাভ, দিলীপ ইত্যাদি প্রত্যেক নেতার অনুগামীরা লড়ে যাচ্ছেন। এটা বন্ধ হয়া সম্ভবই নয়, কারণ বিজেপি দলের বিজেপিই করেন, বিজেপি বোঝেন এমন ক্যাডারের সংখ্যা খুব বেশি হলে ১৫/২০% হবে। খুব শিগগির বিজেপি আবার ঐ ১৩/১৪% ভোটে ফিরবে, নটে গাছটি মুড়োবে, গল্প ফুরোবে। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম বিজেপি দলের মধ্যে এই লাগাতার কোন্দল, মারপিট, মন্ত্রীকে তালা দিয়ে আটকে রাখা, বাঁশ, লোহার রড দিয়ে দপ্তরের দরজা ভাঙা, এগুলো কেন হচ্ছে? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
সারা ভারতে বিজেপির সঙ্গে বাংলার বিজেপির তুলনা করলে ভুল করবেন, এখানে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত যা দেখছেন তা সম্ভাব্য ক্ষমতার আস্বাদ পাবার জন্য এক জমায়েত। সেই ক্ষমতা যখন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, মরিচিকার মত, তখন এক হতাশা গ্রাস করছে আর বিজেপির মধ্যে সেই অংশটা যারা এক গভীর প্রত্যয় থেকে হিন্দু রাষ্ট্র, আর এস এস এর দর্শনে বিশ্বাস করে তারা দলের মধ্যে এই হঠাৎ ক্ষমতালোভীদের দেখে হতাশ। সবমিলিয়ে সেই হতাশারই বর্হিপ্রকাশ ঘটছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, ২০২৪ এর পর যা এক চুড়ান্ত আকার নেবে, মিলিয়ে নেবেন, সেদিন দলের এই দুর্দশার জন্য এক বিরাট অংশ আঙুল তুলবে কাঁথির খোকাবাবুর দিকে, উনিই হবেন বাংলায় হেরে যাওয়া বিজেপির বলির পাঁঠা।