কলকাতা: আবেগের কত রংয়ে রেঙেছেন বুদ্ধদেব। কখনও দলে, কখনও সরকারে, কখনও বা স্রেফ সিনেমা দেখতে গিয়ে। মেঠো রাজনীতির পোড় খাওয়া নেতাদের যেমন হওয়া উচিত, তেমন নন মোটেই। বরং কেমন যেন কবিদের কথা মনে পড়ে যায় সুকান্ত ভট্টাচার্যর এই ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেখে। ভালোবাসতেন লেখালিখি, পড়াশোনা, সিনেমা, গান। দৈবের অচেনা টানাপোড়েনে রাজনীতিকের পরিচিতিই যাঁর একান্ত হয়ে দাঁড়ালে, তিনি কি তা নিয়ে স্বস্তিতে ছিলেন খুব?
হয়তো কমই চর্চা হয় কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থকে নিয়ে। অসাধারণ লেখক, বাগ্মী, পণ্ডিত এই মানুষটি পুরোহিতও ছিলেন। পুরোহিত দর্পণ নামে তাঁর লেখা গ্রন্থ আজও পুরোহিতদের কাছে প্রিয়। ইনি ছিলেন বুদ্ধদেবের পিতামহ। পিতা নেপালচন্দ্র আলোকপ্রাপ্ত, পুরোহিত হতে চাইলেন না। তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রকাশনার পেশা। সেই বাড়িতেই বুদ্ধদেবের কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্য বাঙালির কিশোর বিপ্লবী কবি। সেই প্রবাহ চেতনায় নিয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়েছিলেন। সেই সময়ের ঝড়ঝাপটায় তিনি কবে যে কীভাবে সিপিআইএম-এর হয়ে গেলেন!
আরও পড়ুন: বাংলা হারাল সৎ স্বচ্ছ রাজনীতিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে
১৯৬৬ সালে দলের সদস্য হলেন, বিপদসঙ্কুল দিনে নবীন বাহিনীর অগ্রণী। কিন্তু রাজনীতি তাঁর সবটা নিতে পারেনি। পাশাপাশিই চালিয়ে গেলেন লেখাপড়া, সিনেমা, সঙ্গীত, লেখালিখি। নিজের আবেগের সঙ্গে বেইমানি করেননি কখনও। ১৯৯৩ সালে মন্ত্রিসভা থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করলেন বুদ্ধদেব। জ্যোতি বসু সে সময়ে মুখামন্ত্রী। সিপিএমে এমন পদত্যাগ ভাবাই যায় না। অনেকে ভাবলেন, সিপিএম-এর মধ্যেও একটু বাম ঘেঁষা বুদ্ধদেব কী দল ছাড়বেন? ‘দুঃসময়’ নাটকের লেখক সেই অসম সময়ে বলেছিলেন, আমি ও সিপিএম আলাদা নই, একই অস্তিত্ব। দল ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।
গত শতকের শেষ ভাগ। দীর্ঘ কয়েক বছর জ্যোতি বসু দলে বলছিলেন, তাঁর অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে, এবার মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে দেওয়া হোক। সম্মতি আদায় করতে পেরেছিলেন ২০০০ সালে। সে বছরের ৬ নভেম্বর জ্যোতি বসুর চেয়ারে বসলেন বুদ্ধদেব। খুব কি খুশি ছিলেন তিনি? ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বারবার বলেছেন, তাঁর একটা মিশন আছে। রাজ্যকে শিল্পোন্নত করতেই হবে। তা না হলে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের চেয়ারে বসার কোনও অর্থ নেই। সে চেষ্টা তিনি করেছিলেন। কুর্সির ভয় পাননি। হয়তো ঠিক করেছেন অনেক কিছু, ভুলও করেছেন কিছু কিছু। বাংলার মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল, তাও ১৩ বছর হয়ে গেল। পরাজয়ের পরে একান্তে বলেছিলেন, My Innings is over. দলের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন, বৈঠকে যাওয়া এড়াতে শুরু করলেন। শরীরও ভাঙতে শুরু করেছিল, বারবার হাসপাতাল আর বাড়ি। কেবল ওষুধ, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেনের নল। তন্দ্রায় হয়তো স্বপ্নের উপন্যাসটার কথা ভাবতেন, যে উপন্যাস লেখা আর হয়ে ওঠেনি। বড় ভক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের। মার্কেজের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপন্যাস One Hundred Years of Solitude ইংরেজিতে অনূদিত হলে তার প্রথম কয়েকটি কপি তিনিই আনিয়েছিলেন কলকাতায়। অমন উপন্যাস তাঁর মাথায় হয়তো আসত, যেত, আলোছায়া খেলা করত। সে উপন্যাস আর কখনও লেখা হবে না।