রাজ্যের জনসংখ্যা ১০ কোটির মতো, ঠিক হিসেব জানার জো নেই কারণ মোদিজি সেই ২০২১-এর পরে জনগণনা বা সেন্সাস করাননি, করালে ওনার আরও হাজারটা মিথ্যে ধরা পড়ে যাবে তাই করাননি। সে যাই হোক, আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, দিলু ঘোষ বা কাঁথির খোকাবাবুর হু হু করে মুসলমান বাড়ছে, কথাটা কে ১০০ শতাংশ মিথ্যে প্রমাণিত করে আমাদের রাজ্যে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে, ইন ফ্যাক্ট হিসেব বলছে আমাদের রাজ্যে মুসলমান মানুষজনের বৃদ্ধির হার হিন্দুদের চেয়েও কম। সেই সাধারণ হিসেব মাথায় রেখেই একটা কনজারভেটিভ এস্টিমেট বলছে রাজ্যে কমবেশি ১০ কোটি মানুষ আছে, তো কাঁথির ডাডাবাবু বলেছিলেন তার মধ্যে ২ কোটি নামবে রাস্তায় এই রামনবমীতে, নেমেছে কত? উত্তর থেকে দক্ষিণে হিসেব বলছে কমবেশি ২ লক্ষ মানুষ নেমেছিলেন রাস্তায়, এরমধ্যে আবার তৃণমূলের ছিল হাজার ৫০, তাঁরাও হাতে গদা, হাতে ত্রিশূল, গেরুয়া ফেট্টি পরেই নেমেছিলেন, ফারাক ছিল ঐ এক চিলতে তেরঙ্গা আর ঘাসফুলের ফ্ল্যাগ এ। তৃণমূল নেমেছিল রাস্তায় এটাই জানান দিতে যে আম্মো আছি, আমরাও হিন্দু, এবং নানান জায়গাতে নানান রকম সকম দেখলাম, তারস্বরে ডি জে বাজছে, উত্তরের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পাগড়ি পরে বসে আছেন, একইভাবে সৌগত রায়, যিনি অনায়াসে তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত তেও নাচেন, গতকাল মাইকে যে রামলালা রামলালা ইত্যাদি বাজছিল তাতেও তাল দিয়েছেন, এবারে ব্রাত্য বসু ছিলেন না সঙ্গে, বা থাকলেও দেখা যায় নি। ওদিকে কুণাল ঘোষ পাগড়ি পরে রাস্তাতে। বোলপুরে রামনবমীর মিছিলে কেষ্ট মোড়ল হাঁটলেন, পাল্লা দেবার ব্যাপার তো ছিলই, কাজেই কাজল শেখ কেবল হাঁটলেন না, ত্রিশূল হাতে হাঁটলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার হদ্দমুদ্দ করে ছেড়েছেন।
ওদিকে বাগুইআটির তাপস চ্যাটার্জী তো আদতে সিপিএম ছিলেন, মার্কসবাদী, তো তিনি মুসলমান মানুষজনদের সঙ্গে রাখলেন, বিজেপির মিছিল এল, প্রত্যেক কে মিষ্টি খাওয়ালেন, উনি নিজে নয়, সেই স্থানীয় মুসলমান মানুষজনই খাওয়ালেন, নে খা। তাঁরাও সোনামুখ করেই খেলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া পাড়ায় টেঁকা দায়। কিন্তু এই সব রগড়ের মাঝে হারিয়ে গ্যালো আমাদের কাঁথির খোকাবাবুর ২ কোটির সেই প্রবল হুঙ্কার, দেড় লাখ মানুষও নামলো না আর মিডিয়ার আর্ক লাইটের অনেকটাই কেড়ে নিল এই রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের হিন্দুত্ব, মুখের ওপর তাঁরা বললেন রাম কি কারোর বাবার? অবশ্যই বিদ্বৎজনেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের তত্ত্ব নিয়ে অনেক কথা হবে, হওয়াই উচিত, মানুষ যা বিজেপির কাছ থেকে পায়, সেটাই যদি তৃনমূল দিতে শুরু করে তাহলে আগামী দিনে তৃণমূলের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তুলবে না তো? সে নিয়ে তর্ক চলুক, কিন্তু বাস্তবে এই মূহুর্তে ডাডাবাবুর পালের হাওয়া কিন্তু তৃনমূল কেড়ে নিয়েছে। আসলে এ রাজ্যে কাঁথির খোকাবাবুর সমস্যা কি একটা, হাজারো সমস্যা তো আছেন, মমতা যে পথে চলছেন, সেই পথ তো দেখিয়েছেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রামমোহন, আরও অনেকে। তারপরে এই আর্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও বাংলার প্রতিবাদী ধর্ম প্রচারকরা আছেন, চৈতন্য থেকে লালন থেকে গুরুচাঁদ ঠাকুর। এই মনিষীদের সর্ব ধর্ম সমন্বয় বা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এই বাংলাতে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব বা রাম কেন্দ্রিক হিন্দুত্বকে বেড়ে উঠতে দিচ্ছে না। এখানেই তো শেষ নয়, এরও ওপরে রবি ঠাকুর, নজরুল। মানবতাবাদ আর হিন্দু মুসলমান সম্প্রিতীর যে পাঠ তাঁরা দিয়ে গিয়েছেন তা ঐ রিপাবলিক উচ্চিংড়ের কর্কশ চিৎকারে মুছে যাবে তেমন তো নয়। এবং শুভেন্দুর সমস্যা বাড়াতে এক দীর্ঘ বাম আন্দোলনের ইতিহাস এই ভূমিতে ওনাদের রাজ্যজোড়া গ্রান্ড প্ল্যানের বীজ ছড়াতেই দিচ্ছে না। আর এসব ছেড়ে দিয়েই যদি কেবল ধর্মই দেখেন, সেখানেও ডাডার যাবতীয় পরিকল্পনায় গ্যামাক্সিন ছিটিয়ে দিয়ে গেছে বাংলার প্রাচীন সময় থেকে বারো মাসে তের উৎসবের আবহ।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ১০০টা কথার ৯০টা মিথ্যে, সেই মোদিজি আমাদের প্রধানমন্ত্রী
উত্তর ভারতে যেখানে এই সময়ে রামনবমী পালন হচ্ছে তা তাদের এক মূল ধর্মীয় উৎসব, মানে ৯০% হিন্দু এই কদিন রামনবমী পালন করেন, উপবাস রাখেন, নিরামিষ খান, পুজো পাঠ চলে আর বেশ কিছু জায়গাতে রাম কথা পাঠ আর রাম লক্ষণ হনুমান সীতা সেজে পথ পরিক্রমা চলতো, এখন সেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি যোগ হয়েছে। কিন্তু বাংলায়? আমি নয়, সেই কবে বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম পেঁচার নকশায় লিখেছেন, ❝রামলীল| এদেশের পরব্ নয়-_এটি প্রবল খোট্রাই। কিছু কাল পুর্বে চার্নকের সেপাইদের দ্বারা এই রামলীলার সুত্রপাত হয়, পুর্বে তারাই আপনা আপনি চাঁদা করে চার্নকের মাঠে রামরাবণের যুদ্ধের অভিনয় কত্তো; কিছু দিন এ রকমে চলে, মধ্যে একেবারে রহিত হয়ে যায়। শেষে বড়বাজারের দু-চার ধনী খোট্টার উদ্দ্যোগে ১১৫৭ শকে পুনর্বার ‘রামলীলা’ আরম্ভ হয়। তদবধি এই বারো বৎসর, রামলীলার মেলা চলে আস্চে । কল্কেতায় আর অন্য কোন মেলা নাই বলেই অনেকে রামলীলায় উপস্থিত হন। এদের মধ্যে নিষকর্মা বাবু, মারোয়াড়ী খোট্টা, বেশ্যা ও বেনেই অধিক। ❞ হ্যাঁ আমি নিশ্চিত রামনবমীর কথা কাঁথির খোকাবাবুর ঠাকুরদা জীবনেও শোনেন নি, শোনার কথাও নয়, কিন্তু উনি সেই রামনবমীতে ২ কোটি মানুষ নামানোর কথা ঘোষণা করে দিলেন। বিজেপির এই দুকোটিতে একটা দুর্বলতা আছে, ইনফ্যাক্ট দুই শব্দটা নিয়েই ওনারা অবশেসড, কৃষকের আয় দুগুণ করে দেবো থেকে বছরে দু কোটি বেকারের চাকরির বাওয়াল কি আমরা শুনিনি? তো সেই বাওয়ালির মতই আমাদের শুভেন্দু ডাডার ২ কোটি হিন্দুদের রামনবমীতে রাস্তায় নামানোর ঘোষণা মাঠে মারা গেছে। কেন? তার অন্যতম কারণ হল রামনবমী বাংলার উৎসব নয়, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না।
ঠিক এই দিনে আমাদের উৎসব হল অন্নপূর্ণা পুজো, অন্নকূট উৎসব। পুরাণ বলছে বিয়ে টিয়ে সেরে কৈলাশ শিখরে শিব ও পার্বতী বেশ সুখেই দাম্পত্যজীবন কাটাচ্ছিলেন। সব্বাই জানে শিব ছিলেন হাঘরে গরীব। কাজেই নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে কিছুদিন পরই শুরু হয় দাম্পত্যকলহ। বৌ এর খোঁটা সহ্য না করতে পেরে শিব ভিক্ষে শুরু করলেন কিন্তু সেখানেও সমস্যা, কোথাও ভিক্ষে পাচ্ছেন না। শেষে হাল ছেড়ে কৈলাশে ফেরেন। আসলে কৈলাশ থেকেই পার্বতী কলকাঠি নাড়ছিলেন, তিনি ভিক্ষে পাচ্ছিলেন না, কিন্তু তার কারণ টের পাননি শিব। অবশ্য কৈলাশে ফিরে সঘৃত পালান্ন, পায়েস, পিঠে প্রভৃতি দিয়ে ভরপেট খেয়ে তৃপ্ত শিব পার্বতীর মহিমাবৃদ্ধির জন্য কাশী নির্মাণ করে সেখানে অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন উনি। চৈত্রমাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে সেই মন্দিরে অন্নপূর্ণা পুজো শুরু হল। কিন্তু বাংলায় সেই পুজো চালু করে দিলেন অন্নদা মঙ্গল, তাঁর চন্ডীপাঠে লিখলেন, “যে জন করয়ে অন্নপূর্ণা উপাসনা। / বিধি হরি হর তার করয়ে মাননা।। / ইহলোকে নানা ভোগ করে সেই জন। / পরলোকে মোক্ষ পায় শিবের লিখন।।“ তারপর থেকে এই চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীতে অন্নপূর্ণা পুজো শুরু হলো। শোনা যায়, কাশীর অন্নপূর্ণা দর্শনে বিঘ্ন ঘটার পর থেকেই রানি রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের মনে ইচ্ছে ছিল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। তাঁর জীবদ্দশায় না হলেও সেই স্বপ্নপূরণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বাদেবী। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার ঠিক ২০ বছর পরে ১৮৭৫-এর ১২ এপ্রিল চাণক-এ অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। এই চাণকই হল আজকের ব্যারাকপুর। মন্দির প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁদের পুত্র দ্বারিকানাথ বিশ্বাস। তৈরি হয়েছিল পঙ্খের কাজ যুক্ত ন’টা চূড়াবিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির, বিশালনাটমন্দির, ছ’টা আটচালার শিবমন্দির, দু’টো নহবৎখানা, গঙ্গার ঘাট, ভোগের ঘর ইত্যাদি। এতে সে যুগে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। সেই অন্নপূর্ণা পুজো এখনও হয়, হ্যাঁ পূব পশ্চিম মেদিনীপুরেও হয়, খোকাবাবু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ব্যারাকপুরের ঐ মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। প্রতিদিন অন্নভোগ হয়। এবং কাঁথির খোকাবাবু জানেন না যে দেবী অন্নপূর্ণার ভোগে প্রতিদিন মাছ থাকা আবশ্যিক। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ি, বিডন স্ট্রিটের মিত্রাশ্রম, বলরাম দে স্ট্রিটে খানেদের পরিবারে অন্নপূর্ণা পুজো হয়। ওদিকে এই সময়েই আবার বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বাসন্তী দূর্গাপুজো হয়। মেধস মুনির উপদেশে রাজা সুরথ ও তাঁর সঙ্গী সমাধি বনের মধ্যে নদীর তীরে শ্রীশ্রীচণ্ডীস্বরূপা দুর্গাদেবীর মাটির প্রতিমা গড়ে তিন বছর উপোস করে পুজো করছিলেন, দেবী দুর্গা-চণ্ডীকা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের বর প্রদান করেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, রাজা সুরথ আর সমাধি, ঐ মেধসও আশ্রমে বসন্ত কালেই শ্রীশ্রী দুর্গাপূজা করেছিলেন, যা পরে এই বাংলায় বাসন্তী পুজো হয়ে উঠেছিল। কেন বাংলায় কেন? কারণ শক্তি মঙ্গল তন্ত্র অনুসারে সুদূর অতীতে বিন্ধ্যাচল থেকে বাংলাদেশের চট্টলভূমি পর্যন্ত প্রদেশ বিষ্ণুক্রান্তা নামে বিখ্যাত ছিল। আর এখানেই নাকি ছিল সেই মেধস এর আশ্রম। এখনকার বাংলাদেশ, দক্ষিণবঙ্গের কেবল নয় উত্তরবঙ্গেও এই সময়ে বহু জায়গাতে বাসন্তী দুর্গার পুজো হয়, আসলে কৃত্তিবাসী রামায়ণে অকাল বোধনের বর্ণনার পরেই আমাদের বাংলাতে অকালবোধনে আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো চালু হয়। যে কথা বলছিলাম, আমাদের বাংলাতে রামনবমী ছিল না, কিছুদিন আগে পর্যন্তও হিন্দি ভাষী মানুষজন হনুমান সেজে গদা হাতে ঘুরতেন, আমরা আমোদ পেতাম যা এখন এক দাঙ্গার আবহ নিয়েই হাজির সারা দেশে, বিশেষ করে এই বাংলাতে। রামনবমী মানেই দাঙ্গা, রামনবমী মানেই মিছিলে পাথর ছোঁড়া আর হাঙ্গামা, আর সেসব আসলে এক হিন্দু মেরুকরণের চেষ্টা, সেটা আটকাতে পালটা রামনবমী না করে আসুন না, আমরা বরং অন্নপূর্ণা পুজো করি, রাজ্যের প্রতিটা শিশুর মুখে উঠুক পলান্ন, পায়েস, এই দিনটাতে। ভরতচন্দ্র রায়গুনাকর এর অন্নদা মঙ্গলের কবিতা কটা লাইন পড়ি,
আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে।
চৈত্র মাসে মোর পূজা শুক্ল অষ্টমীতে ॥
কত দিন ছিনু হরিহরের নিবাসে।
ছাড়িলাম তার বাড়ি কন্দলের ত্রাসে ॥
ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।
বর মাগ মনোনীত যাহা চাহ দিব ॥
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে জোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ॥
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান ॥
আমরা এই বাংলায় কোনও দাঁত মুখ খ্যাঁচানো হনুমান চাই না, আমরা চাই আমাদের সন্তান থাকুক দুধেভাতে। আর ঠিক তাই ওই কাঁথির খোকাবাবুর ২ কোটির বাওয়ালিতে গ্যামাক্সিন ছিটিয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষ।