Saturday, September 27, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | দেশে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে চাই মা দুর্গাকে, নতুন করে...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | দেশে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে চাই মা দুর্গাকে, নতুন করে অসুরবধ প্রয়োজন

শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ না করলে, প্রবল অন্যায় আর অত্যাচারের মোকাবিলা করা যায় না

গণতন্ত্র এক শাসন ব্যবস্থা, যার সবচেয়ে প্রচলিত সংজ্ঞা হল, ‘অ্যা গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল’। মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য, মানুষের সরকার। আমরা কখনও কেন্দ্রীয় সরকার বলি, কখনও মোদিজির সরকার বলি, কখনও বা বিজেপির সরকার বলি বটে, কিন্তু তা ঠিক নয়, তা অসম্পূর্ণ বা বেঠিক। গণতন্ত্রে মানুষ ভোট দেয় সরকার তৈরি করতে, সেই সরকার মানে আইন সভা – রাজ্যসভা, লোকসভা, বিধানসভা। গণতন্ত্র মানে গরিষ্ঠাংশের শাসন। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থে সেটাই ঠিক, কিন্তু আমরা তার সঙ্গে প্রজাতন্ত্র কথাটাও জুড়েছি। ভারত এক প্রজাতন্ত্র, কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়। কেউ কেউ তা বোঝানোর চেষ্টা করে বটে, কিন্তু তা ডাহা মিথ্যে। ভারত চলবে সংবিধান মতে। প্রজাতন্ত্রে মানুষ শাসক ও বিরোধী দুই দলকেই নির্বাচিত করে, তারা সংসদে বসে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে দেশ চালায়। এটাকেই প্রজাতন্ত্র বলে, মানুষের, মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য এক শাসনব্যবস্থা। সেই শাসন ব্যবস্থার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিরোধিতা। মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা, দল বা মোর্চা যা করতে চাইছে, সংখ্যালঘু সদস্যরা, দল বা মোর্চা তার বিরোধিতা করতে পারে। এমনকি সংসদে বসে থাকা, প্রত্যেক দল একমত হয়েও যদি একটা আইন পাস করে, তাহলেও আপনি একলা, কয়েকজনে মিলে, কয়েকটা সংগঠন মিলে তার বিরোধিতা করতে পারেন। বলতেই পারেন, আমরা এই আইন মানছি না। বলতেই পারেন, সেটাই গণতন্ত্র। আমাদের সংবিধান সেই গণতান্ত্রিক ধারনাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। আমাদের সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে, কিছু অধিকার, মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা আছে, প্রত্যেক মানুষের ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ আছে, মনের কথা খুলে বলার অধিকার আছে। হ্যাঁ, ‘মন কি বাত’-এ, শুধু মোদিজি বলবেন, বাকিরা সারা জীবন শুনেই যাবে, এমনটা নয়। বলা আছে যে, প্রত্যেক নাগরিক বলতে পারে তাঁর মনের কথা, দেশের যেকোনও জায়গায় গিয়েই বলতে পারে। আপনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকার যেকোনও ভুখন্ডে দাঁড়িয়ে আইন মেনে আপনার মনের কথা বলতে পারেন। সংবিধান আমাদের সেই অধিকার দিয়েছে, মৌলিক অধিকার। এবং এই সংবিধানই আপনাকে এক বিচার ব্যবস্থা দিয়েছে, যেখানে আপনি একলাই গিয়ে বিচারপতিকে বলতে পারেন, “হুজুর এই আইন জনবিরোধী, এই আইন বাতিল করুন।” এটাই প্রজাতন্ত্র।

এই সংবিধান রচনার সময়, বিজেপির উত্তরসূরিরা দেশের সংবিধান সভা বয়কট করেছিল। করেছিল কারণ তাঁদের এই ব্যবস্থা না পসন্দ। তাঁরা মনে-প্রাণে, তাঁদের আদর্শ অনুযায়ী গণতন্ত্র বিরোধী। তাঁদের গুরুদেব সদাশিব গোলওয়ালকর, হিটলার আর নাজি শাসনের মধ্যেই তাঁদের খুঁজে পায়। এক রাজা আর তাঁর মুখের বাণীতে দেশ চলবে, এটাই তাঁদের কাম্য শাসন ব্যবস্থা, রাজতন্ত্র। গণতন্ত্রও নয়। প্রজাতন্ত্র তো বহু দুরের কথা। না হলে একবার ভাবুন দেশের এক অংশে আগুন জ্বলছে, এখনও রোজ মণিপুরের দুই জনগোষ্ঠির মধ্যে লড়াই চলছে, মানুষ মারা যাচ্ছেন, সেই রাজ্যে আড়াই ঘন্টা পা রেখে দেশের প্রধানমন্ত্রী বোঝার চেষ্টাই করলেন না যে, সমস্যাটা কোথায়। তিনি চলতে থাকা জাতিদাঙ্গা নিয়ে একটা কথা বললেন না, চোখের জল ফেলা তো দুরের ব্যাপার, সামান্য শোক প্রকাশও করলেন না। কেবল অলীক উন্নয়ন আর বিকাশের কথা বলে ফিরে এলেন। ২০২১-এও মোদিজি ৫৩৭ জন কৃষকের মৃত্যুতে বিচলিত নন, এই অন্নদাতাদের মৃত্যু তাঁর কাছে তুচ্ছ, এ নিয়ে তিনি একটা কথাও মুখে আনেননি। তিনিও হয়তো তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীর মত বিশ্বাস করেন – এই কৃষকেরা আসলে বব্বর খালসার লোকজন, এরা খলিস্থানপন্থী, এরা মাওবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | শ্রীলঙ্কা–বাংলাদেশ–নেপাল–লাদাখ, ভারতেও সেই আগুন ছড়াবে?

মাত্র গত পরশু লাদাখে চার জন মারা গেল, তরতাজা যুবক, একটা শব্দও খরচ করেননি তাঁদের জন্য। ওনার পক্ষে এসব মনে করা স্বাভাবিক। হাথরসে মন্ত্রীপুত্রের গাড়ির চাকার তলায় চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন ৫ জন মানুষ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা, অন্য রাজনৈতিক দল যখন ঘটনাস্থলে যেতে চাইলেন, তখন প্রায় ৭২ ঘন্টা ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হল সেই গ্রাম আর ঘটনাস্থলকে, গ্রেফতার করা হয়েছিল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। আবার প্রমাণিত হল, দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক স্বাধীনতা নেই, প্রজাতন্ত্রও নেই। মোদিজির সরকার মনে করে গণতন্ত্র হল মেজরিটির শাসন, মেজরেটেরিয়ানিজমে বিশ্বাসী তাঁরা। মানে কী কথাটার? সোজা বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। ‘Majoritarianism is a traditional political philosophy or agenda that asserts that a majority sometimes categorized by religion, language, social class, or some other identifying factor of the population is entitled to a certain degree of primacy in society, and has the right to make decisions that affect the society.’ মানে এক সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, যেখানে তার সংখ্যালঘুদের মতামত অগ্রাহ্য করে, ধর্ম, শ্রেণি বা এক নির্দিষ্ট দলের শাসন চালু করা হয়। আমরা ইতালিতে মুসোলিনিকে, জার্মানিতে হিটলারকে এই ধরনের শাসন কায়েম করতে দেখেছি। এই ব্যবস্থায় যে কোনও সংখ্যালঘু তাঁর সাধারণ অধিকার হারিয়ে ফেলে, আক্রান্ত হয়। ভারতবর্ষেও সেই ব্যবস্থাই চালু করেছে আরএসএস-বিজেপি। যেকোনও বিরোধিতাকে তারা দেশদ্রোহ মনে করে, যেকোনও প্রতিবাদকে চক্রান্ত মনে করে, যেকোনও বিরোধী কন্ঠস্বরকে তারা চুপ করিয়ে দিতে চায়, তারা যা বলছে বা তাদের নেতা যা বলছে, সেটাকেই লাগু করতে চায়। কোন সংখ্যাগরিষ্ঠতা? যে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সায় আছে দেশের ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশ মানুষের, তাকেই হাতিয়ার করে গণতন্ত্রকে খুন করতে চায়।

এমনটা নতুন নয়, পৃথিবীতে বহুবার এমন মেজরেটেরিয়ানিজম দেখা গিয়েছে। এর একমাত্র উপায়, প্রত্যেক বিরোধী শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ করে, এই শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একমাত্র সেই ঐক্যের হাতিয়ার দিয়েই এই সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানো যায়, ইতিহাস তাই বলছে। দেখুন না চার্চিলের মতো ভয়ঙ্কর কমিউনিস্ট বিরোধী, রুজভেল্টের মতো চরম কমিউনিস্ট বিরোধী, স্তালিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঐ হিটলার, মুসোলিনি, তোজোর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, জিতেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের বিরুদ্ধে, হাত মিলিয়েছিল অজস্র বিরোধী দল। তাদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী জনসংঘও ছিল, কমিউনিস্টরাও ছিল, সমাজগণতন্ত্রীরাও ছিল। তাদের সম্মিলিত ঐক্যের সামনে হেরে গিয়েছিলেন প্রবল ক্ষমতাশালী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশে এরশাদের শাসন শেষ হয়েছিল, হাসিনার শাসনও শেষ হয়েছে। মিশরে, উগান্ডায় বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সেই কথাই বলে। আজ আমাদের দেশে গণতন্ত্র নেই, জাঁকিয়ে বসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, তার বিরুদ্ধে লড়াইতে জিততে হলে চাই সার্বিক ঐক্য। যতদিন সে ঐক্য না তৈরি হচ্ছে, ততদিন আমাদের ঐ একতরফা ‘মন কি বাত’ শুনে যেতেই হবে, পরিত্রাণ নেই।

এইসবের মাঝখানে চলে এল দুর্গাপুজো, সেই দুর্গার আবাহনও কিন্তু এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথাই বলে। অসুররা দলে দলে বেরিয়ে এসে, মহিষাসুরের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করেছিল। কেবল মহিষাসুরই তখন ‘মন কি বাত’ বলত, তাঁর ইচ্ছেই ছিল শাসন, বিরোধিতা, ছিল মৃত্যু। দেবতারা চেষ্টা করেছিলেন, ইন্দ্র চেষ্টা করেছিলেন, আলাদা আলাদা লড়াইতে দেবতারা পরাস্ত হয়। তাঁরা ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হলে তিনি তাঁদের এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে সামনে আনতে বলেন। তাঁরা সবাই মিলে দুর্গাকে সামনে রেখে লড়াই শুরু করেন, যার যা ছিল খড়গ, ধনুক, তরবারি থেকে সমস্ত অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করেন তাঁদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইকে। অসুরপতিকে মেরে আবার শান্তি আর সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন মা দুর্গা। কল্পকাহিনী, কিন্তু মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার- প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অস্ত্র আর শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ না করলে, প্রবল অন্যায় আর অত্যাচারের মোকাবিলা করা যায় না। আজ আশ্বিনের শারদপ্রাতে যখন বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী, ধরণীর বহিরাকাশে যখন অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা, তখন সেই সমস্ত শক্তি যাঁরা গণতন্ত্র চান, যাঁরা আইনের শাসন চান, যাঁরা এই প্রবল অত্যাচারী শাসনের অবসান চান, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। এক মা দুর্গাকে চাই, যিনি দেশের মানুষের, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সমর্থন নিয়ে অত্যাচারীকে দমন করবেন। শারদীয়া উৎসব আমাদের কাছে সেই ঐক্যবার্তা নিয়ে আসুক। সব্বাই ভাল থাকবেন, উৎসব আনন্দের হয়ে উঠুক, অন্যায় আর পাপের অবসান হোক। আগামী ক’দিন চতুর্থ স্তম্ভের ছুটি, ততদিন সব্বাই ভাল থাকবেন। বড়দের প্রণাম, ছোটদের জন্য রইল শুভেচ্ছা।

Read More

Latest News