ফান্ডের নাম, পি এম কেয়ার ফান্ড। ঠিকানা, প্রধানমন্ত্রী আবাসন। কী কাজে লাগবে এই ফান্ড? কোভিড পরিস্থিতি বা ঐরকম জরুরি খরচ মেটানোর জন্য এই টাকা খরচ হবে, ওয়েবসাইটে অশোকস্তম্ভের ছবি আছে, সদস্যরা হলেন দেশের অর্থমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী। কারা টাকা দেবেন? সব্বাই, দেশের শিল্পপতি, আদানি ট্রাস্ট, আম্বানি, ইনফোসিস, টাটা ট্রাস্ট ইত্যাদিরা। দেশের বলিউড চিত্রতারকা সলমন খান, আমির খান, শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। দেশের সরকারি কর্মচারি, সে আমলা হন আর ক্লার্ক বা পিওন, তাদের মাইনে থেকে এই ফান্ডে টাকা জমা পড়েছে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প, যা মোদিজী বেচে দিতে চান তাদের টাকা জমা পড়েছে, রেল দফতর যারা প্ল্যাটফর্ম থেকে স্টেশন বেচে দিচ্ছে, শিক্ষা সংস্থা, এল আই সি, জি আই সি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক প্রত্যেকে টাকা জমা দিয়েছে। তাহলে এবার জানতে ইচ্ছে হবে তো, যে কত টাকা জমা পড়েছে, কত টাকা কোথায় খরচ হবে? কারা নির্ধারণ করলেন এই ব্যয় বরাদ্দ? কিন্তু আপনি জানতে পারবেন না। কারণ এটা ট্রাস্ট, সরকারি সংস্থা নয়, সরকার, তাদের দপ্তর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আমারা কিছুই জানাতে পারবো না, কারণ এ তো সরকারি সংস্থা নয়। এক ভদ্রলোক আর টি আই করেছিলেন, তাকে জানানো হয়েছে এটা ব্যক্তিগত ট্রাস্ট, এর খরচ আমদানি কিছুই জানাতে পারা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের প্রত্যেকটি খরচের হিসেব নিকেশ করা হয়, তার জন্য এক দফতর আছে, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফিস, সি এ জি দফতর, না তারা এই ফান্ডের হিসেব নিকেশ করেন না, তাঁরা কেবল জানিয়েছেন, এই ফান্ডের অডিট হয়, একজন অডিটর এই ফান্ডের অডিট করেন, তা সে তো বিজয় মালিয়ার কোম্পানির, বা নীরব মোদির কোম্পানিরও অডিট হয়, তাতে তাদের টাকা মেরে পালিয়ে যাওয়া, বা ব্যাঙ্কের টাকা চুরি করা আটকানো যায় নি, এটা আমরা জানি। মানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে ফান্ড, টাকা দেবেন জনসাধারণ বা দেশেরই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তা নাকি সরকারের নয়, তার হিসেব নিকেশ সি এ জি করবে না। এমন কি সেই ফান্ডের যে ওয়েব সাইট আছে, সেখানে গিয়ে দেখুন, আয় ব্যয়ের কোনও লেখাঝোকা সেখানে নেই, সেই টাকা নির্বাচনী প্রচারে খরচ হচ্ছে কি না, কোনও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে কিনা তা জানার কোনও উপায় নেই। কেন নেই? খুব স্বাভাবিক, ধরুন আমার টাকা আছে, তা দিয়ে আমি মাছ কিনবো না কচি পাঁঠার মাংস কিনবো, তা আপনাকে জানাতে যাবো কেন? আমায় টাকা হরিদাস পাল দিয়েছে না ঘনশ্যাম বাটপাড়িয়া দিয়েছে, তাই বা আপনাকে জানাবো কেন? আমি ১০০ পেয়েছি না ১০০ কোটি, তা জানানোরও দায় আমার নেই, ঠিক সেরকম এটা মোদিজীর ফান্ড, দেশের মানুষকে জানানোর কোনও প্রয়োজন তিনি মনে করেন না, করেন নি। হ্যাঁ, রাষ্ট্রপুঞ্জে তিনি সেই অলীক স্টেশনের গল্প বলবেন, যে স্টেশন আদৌ ছিলনা, অথচ যেখানে তিনি চা বিক্রি করতেন, সে সব গুল দিতে দিতে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলবেন, যে গণতন্ত্রের পিন্ডি তিনি রোজ চটকাচ্ছেন, এই দেশে বসেই রোজ।
আরও পড়ুন :চতুর্থ স্তম্ভ: আসা যাওয়ার মাঝখানে
১৯৪৮ এ জহরলাল নেহেরু, প্রধানমন্ত্রী রিলিফ ফান্ড করেছিলেন, তখন দলে দলে শরণার্থী আসছে পাকিস্থান থেকে, তার খরচ সামলাতে দেশের মানুষের কাছ থেকে টাকা চাইলেন, মানুষ দিলেন, পরে সে ফান্ড আরও বিস্তৃত হয়েছে, ওয়েবসাইট খুলে দেখুন, পাবেন, কত টাকা এসেছে কত টাকা খরচ হয়েছে। সেই ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ডে কংগ্রেস সভাপতিও ছিলেন, স্বাভাবিক, কারণ সেই সময়ে কংগ্রেস মানেই তো দেশ, কিন্তু ১৯৮৫ তে দেশের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, তিনি ঐ ট্রাস্টের সব ক্ষমতা পি এম ও দফতরের উপর ছেড়ে দিলেন, তখন থেকে পি এম ও দফতর তার দেখাশুনো করে, প্রতিটি খরচের হিসেব থাকে ট্রাস্টের ওয়েব সাইটে, আর আছে ডিসাস্টার ম্যনেজমেন্ট ফান্ড, মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন চালু হয়, তার মাথায় দেশের প্রতিরক্ষা কর্তারা, তারও হিসেব ওয়েবসাইটেই আছে, না পি এম কেয়ারের নেই, কারণ নরেন্দ্রভাই দামোদর দাস মোদি হলেন প্রকৃত গণতান্ত্রিক, দেশে শুধু নয়, ৬৪ কোটি টাকার প্লেনে চেপে বিদেশে গিয়েও গণতন্ত্রের ঢাক বাজান, কথায় কথায় বলেন, ন খাউঙ্গা, ন খানে দুঙ্গা। অথচ ট্রাস্টের হিসেব নিকেশ সবার সামনে রাখতে ভারী অনীহা, সেই টাকায় ৫০ হাজার ভেন্টিলেটর কেনা হবে জানানো হয়েছিল, তার খবর কী? প্রথমে বলা হল ৩৫০০ কেনা হয়েছে, তারপর বলা হল থুক্কুড়ি, কিনেছেন ২৯০০ টা, বিহারে পাঠানো হয়েছে, দক্ষ লোকের অভাবে তা গোডাউন থেকে বের করা যায় নি, ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য কাজে লাগানো হবে, সেই ভ্যাক্সিন দেবার পরে, মোদিজীর হাসিমুখের ছবিওলা সার্টিফিকেট থাকবে, সে খরচ কোনখান থেকে আসছে? জানা নেই। মোদিজী বললেন ফান্ড বানাবো, যেই বলা সেই কাজ। রেল দপ্তরে ছাঁটাই চলছে, রেল তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি মালিকানার হাতে, সেই রেল দপ্তর দিয়ে দিল ১৫০ কোটি টাকা, অন্য দপ্তর পিছিয়ে থাকে কেন? অর্থ দপ্তর সার্কুলার দিল, প্রত্যেক কর্মচারিকে এক বছর ধরে প্রতি মাসে ১ দিনের বেতন দিতেই হবে, মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হবে, কোন ফান্ডের জন্য? এক ব্যক্তিগত ট্রাস্টের জন্য যার হিসেব মানুষ পাবে না! এ হয় নাকি? হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির আমলে সবই সম্ভব, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। একই সার্কুলার গিয়েছিল দিল্লির এইমস ইত্যাদি হাসপাতালগুলোতে, ডাক্তারবাবুরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কোনও ব্যক্তিগত ট্রাস্টে ডোনেশন দেবেন না, সার্কুলার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই কাজ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিরা তো করতে পারেন নি, তাদের টাকা জমা পড়েছে মোদিজীর ফান্ডে।
সুপ্রিম কোর্টের কর্মচারিদের মাইনের টাকাও জমা পড়েছে, কেউ প্রশ্ন করেনি যে কেন অশোক স্তম্ভ লাগিয়ে, এক ব্যক্তিগত ট্রাস্ট চালানো হচ্ছে। নিয়মটা একটু খোলসা করা যাক, নতুন আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র বা সরকার ছাড়া কেউই দেশের নাম, দেশের এমব্লেম অশোক স্তম্ভ, জাতীয় পতাকা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবে না। মানে কাল আপনি চাইলেই, ভারতীয় জাতীয় সুরক্ষা ফান্ড নামে কোনো ট্রাস্ট তৈরি করতে পারবেন না, বা কোনও কোম্পানি তৈরি করতে পারবেন না, যার লোগো হবে দেশের জাতীয় পতাকা বা অশোকস্তম্ভ। তা কেবল সরকারই করতে পারে, এবং সরকার করলে তা হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান, অন্য আর দশটা দপ্তরের মত তার হিসেবের অডিট করবে।
সি এ জি, তারা জানাবে কোন কোন সংস্থা বা কোন ব্যক্তি এই ফান্ডে টাকা দিয়েছেন, তা কিভাবে খরচ হয়েছে, কটা টাকা খরচ করে আপনি আর টি আই করলে, সংশ্লিষ্ট দপ্তর আপনাকে এই সব তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে, যেমন ধরুন আমরা জেনেছি রাশিয়া এবং সম্ভবত আরও দুটো দেশের তিনটে প্রতিরক্ষা কোম্পানি, না সরকারি নয়, বেসরকারি কোম্পানি এই পি এম কেয়ার ফান্ডে টাকা দিয়েছে, কেন দিল? রাশিয়ার এক বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যাথাটা কোথায়? তারা হঠাৎ টাকা দিতে গেল কেন? কিন্তু সে প্রশ্ন তো তোলাই যাবে না, কারণ অফিসিয়ালি এটা তো জানানোই হচ্ছে না যে তারা কত টাকা দিল বা আদৌ দিল কি না? বা ধরুন আমার আপনার টাকা যে ফান্ডে জমা পড়ল, সেই টাকা দিয়েই কোভিড সার্টিফিকেটে প্রধানমন্ত্রীর সহাস্য মুখ ছাপা হচ্ছে কি না? জানবো কি করে? দেশের প্রত্যেক আয় সক্ষম মানুষ, তাদের আয়ের পুরো হিসেব নিকেশ দেবে, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা করবে, কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে এই ফান্ড থাকবে, যেখানে পাবলিক মানি জমা হবে কিন্তু তার হিসেব থাকবে না, এটাই হল নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছ ভারত অভিযান, ট্রান্সপারেন্সি, পারদর্শিতা। এবং চারিদিকে হীরণ্ময় নীরবতা, আদালত কোনও কথা বলছে না, গোদী মিডিয়া মোদিজীর জয়জয়কারে ব্যস্ত, সংসদে বিরোধীদের বলতেই দেওয়া হচ্ছে না, এ কেমন গণতন্ত্র? এ কোন গণতন্ত্র? জহরলাল নেহেরু পি এম রিলিফ ফান্ড তৈরি করেছিলেন, তার হিসেবনিকেশ আছে, মনমোহন সিং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ফান্ড করেছেন, তারও হিসেব নিকেশ চাইলেই পেয়ে যাবেন, কিন্তু মোদিজীর পি এম কেয়ার এতটাই কেয়ারিং যে তার হিসেব নিকেশ আপনাকে দেওয়া হবে না, কেন? কোন খেলা চলছে মানুষের পয়সা নিয়ে? কোথায় খরচ হচ্ছে? কেন এই ফান্ড ব্যক্তিগত ট্রাস্টে রাখা হল? কেন সরকার তার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন আমরা করছি, জবাব না পাওয়া পর্যন্ত মোদিজী, আপনার গণতন্ত্রের ঢাক বাজানো বন্ধ করুন, আপনার মুখে গণতন্ত্র শব্দটা বড্ড বেমানান।