শোলে সিনেমাতে একটা ডায়ালগ অনেকেরই মনে আছে, ঘোড়া ঘাস সে দোস্তি করেগা, তো খায়গা কেয়া? ঘোড়া যদি ঘাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, তাহলে খাবে কী? তো সেই সূত্র মেনে আজকাল সমাজসেবকরাও সমাজ সেবা করে গাড়ি বাড়ি করেন। দেশের সেবা যাঁরা করেন তাঁদের সংক্ষেপে এমপি, এমএলএ বলা হয়, তাঁদের যোগ্যতার কোনও মাপকাঠি নেই কিন্তু মাইনে বিরাট। মাইনের চেয়েও অন্য আরও রোজগারের পথও প্রশস্ত। এসব তো আমরা বিলক্ষণ জানি। আর এটাকেই তো চলতি ভাষায় প্রাগমাটিজম বলা হয়, এটাই তো দস্তুর। হিসেবের পাতা খুলে দেখুন, মাই নেতা ওয়েবসাইট সার্চ করুন, এমপি বা এমএলএ হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এঁদের প্রত্যেকেই কোটিপতি। ওই হিসেবই বলছে আমাদের সাংসদদের ৮৩ শতাংশ কোটিপতি, এতে অবাক হবার কিছু নেই। বরং বাকি ১৭ শতাংশ যে কোন কারণে ওই কোটিপতিদের দলে নাম লেখাতে পারল না, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। এই রাজনীতিবিদদের এক বড় অংশ ওকালতি করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বিরাট বড় উকিল ব্যারিস্টার। এক সময়ে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শ্রীশ বসু, শরৎচন্দ্র বসু এই বাংলায় রাজনীতি করেছেন, ওকালতির বিরাট নাম। কিন্তু এঁরা বহু মামলা বিনি পয়সাতেই লড়তেন, অরবিন্দের হয়ে চিত্তরঞ্জন সওয়াল করেছিলেন, এক পয়সা নেননি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অভিযোগে যে বিপ্লবীরা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শরৎ বসু, শ্রীশ বসু, এক পয়সাও নেননি। নেতাজির আইএনএ সেনাবাহিনীর হয়ে সওয়াল করতে নেমেছিলেন জওহরলাল নেহরু, না পয়সা নেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। বহু পরে ১৯৭৪-এর ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সময়ে শ্রমিক কর্মচারীদের হয়ে কোর্টে সওয়াল করতে নেমেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, না, উনিও এক পয়সা নেননি। এরকম বহু উদাহরণ আছে, কিন্তু এখন দিনকাল পাল্টেছে। জানা গেল চাকরি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করেছিলেন যে যুবক যুবতীরা, তাঁদের হয়ে মামলা লড়ার জন্য যে উকিলরা নেমেছিলেন, ওই বেকার ছেলেমেয়েরা তাঁদের পিছনেই খরচ করেছেন ২৭ লক্ষ টাকা। হ্যাঁ, সেটাই বিষয় আজকে, ২৭ লক্ষ টাকা চাকরিপ্রার্থীদের ওকালতি করার জন্য?
তখন গান্ধীজির ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে নেমেছেন দেশের মানুষ। স্কুল কলেজ ছেড়েছেন শিক্ষক-ছাত্ররা, আদালত বয়কট করেছেন বাঘা বাঘা উকিলেরা। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখেছিল, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অনন্ত সিংহও অবাক হয়েই দেখেছিলেন, আদালতে এসেছেন শরৎ বসু, বলেছেন, আই অ্যাপিয়ার অন বিহাফ অফ অনন্ত সিংহ। শরৎ বসু সেই সময়ে একবার আদালতে সওয়াল করার জন্য তিন হাজার টাকা নিতেন, তিনি বিনা পয়সায় সেদিন সওয়াল করতে নেমেছিলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | অমিত শাহ আবার আসছেন বাংলায়, কেন আসছেন জেনে নিন
৭৪-এর রেল ধর্মঘট, রেল ধর্মঘটের নেতারা জেলে, চাকরি গেছে চোদ্দোর এক ধারায়, যাঁরা বাইরে আছেন তাঁরা গেছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। মামলা হাইকোর্টে উঠেছে, দিনের পর দিন সওয়াল করেছেন সোমনাথবাবু, এক পয়সা নেননি। এঁরা পয়সা কেন নেননি? কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন যাঁদের হয়ে তাঁরা আইনি লড়াই করছেন, তাঁদের লড়াইকে সমর্থন করা উচিত। সেই লড়াইটা তাঁরা হয়তো রাস্তায় লড়ছেন না, কিন্তু এই লড়াইয়ে শুধু আইনজীবী হিসেবেই নয়, সাধারণভাবেও তাঁরা সমর্থন করছেন। বহু রাজনীতিবিদ উকিল ব্যারিস্টারেরা বিনা পয়সায় বহু মামলা লড়েছেন শুধুমাত্র ওই কারণেই। আর কোথায় তাঁরাও পয়সা নিয়েছেন? যেখানে সেই মামলা ছিল তাঁর মক্কেলের, তিনি কেবল আইনি সাহায্য দিয়েছেন, তাঁর মক্কেলের হয়ে মামলা লড়ার জন্য ফিজ নিয়েছেন। বড় বড় উকিলেরা লক্ষ লক্ষ টাকার ফিজ নিয়ে থাকেন, নেবেনই তো, ওই যে ঘোড়া অগর ঘাস সে দোস্তি করেগা তো খায়গা কেয়া? তো এই হিসেব ধরেই সিপিএম সাংসদ, বড় উকিল বিকাশ ভট্টাচার্য চাকরিপ্রার্থী বা বলা যাক বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায্য লড়াইয়ের জন্য আদালতে হাজির হয়েছেন, ওকালতি করেছেন। তা থেকে বেশ কিছু দুর্নীতিও বেরিয়ে এসেছে, মানুষ বুঝেছেন একটা ভালো রকমের দুর্নীতি ছিল। এবং মজার ব্যাপার হল এই মামলা লড়তে বিকাশ ভট্টাচার্য এবং তাঁর জুনিয়ররা মিলে ২৭ লক্ষ টাকা ফিজ নিয়েছেন, ফিজ দিয়েছেন ওই বেকার যুবক যুবতীরা। হ্যাঁ, ২৭ লক্ষ টাকা, এবং বিকাশ ভট্টাচার্য সাফ জানিয়েই দিয়েছেন, মামলা লড়তে তো পয়সা খরচ হয়। কিন্তু তিনি তো নিজে হাতে টাকা নেননি, নেনও না, তাই কত টাকা জানা নেই, কিন্তু টাকা যে খরচ হয়েছে, ওই বেকার যুবক-যুবতীদের গ্যাঁট থেকে টাকা যে বেরিয়েছে তা অস্বীকারও করেননি। এমনিতে এখানেও ঘোড়া আর ঘাসের উপমা আনা যেতেই পারে, কিন্তু সমস্যা হল এটা এই সময়ের অন্যতম বড় রাজনৈতিক ইস্যু। প্রশ্ন তো উঠবেই যে এই দুর্নীতির ইস্যুতেও দলের একজন সাংসদ বেকার যুবক-যুবতীদের কাছ থেকে এই পরিমাণ টাকার লেনদেনের অংশীদার হলেন তার আইনি যথার্ততা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও নৈতিক প্রশ্ন তো থেকেই যায়, তাই না? আমরা সেই প্রশ্নই করেছিলাম আমাদের দর্শকদের। বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরির আইনি লড়াইয়ে শামিল বিকাশ ভট্টাচার্য এবং তাঁর সহযোগী উকিলেরা ২৭ লক্ষ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ, সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
ঘোড়া ঘাসের লজিক সব্বার জানা, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক শাণিত কণ্ঠস্বর বিকাশ ভট্টাচার্য বেকার যুবক-যুবতীদের লড়াইকে সমর্থন করে আদালতে দাঁড়ালেন এবং সেই যুবক-যুবতীদের পকেট থেকে ২৭ লক্ষ টাকা খরচ হল, এটা বেশ দৃষ্টিকটু। উনি যদি একথা বলতেন যে আমার সহযোগী জুনিয়র উকিলেরা কিছু টাকা নিয়েছেন, এ মামলা লড়তে আমি টাকা নিইনি, তাহলে তাঁর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হত, কিন্তু এখন সাধারণ মানুষ অস্ফুট স্বরে কেবল এটাই বলতে পারে, এট টু ব্রুটে? হায় ব্রুটাস, তুমিও? তুমিও?