সেই উত্তর থেকে দক্ষিণে নবজোয়ারের যাত্রা করেছিলেন তৃণমূলের যুবরাজ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা লিখেছিলাম। এবার তেমনই এক যাত্রা নিয়ে রাস্তায় সি পি এম এর ছাত্র যুব সংগঠন, ইন্সাফ যাত্রা। সামনের মুখ এই সময়ে সি পিএম ছাত্র যুবই নয়, বহু সমর্থক কর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মিনাক্ষী মুখার্জি। ফারাক হল সেবার অভিষেক অনেকটা পথই তাঁর বিলাসবহুল বাসেই পার করেছেন, এবারে কিন্তু মিনাক্ষী এবং তাঁর কমরেডরা পুরোটাই হেঁটে আসছেন। মানুষ আসছেন, দেখছেন, ভিড় জমছে, কোথাও কোথাও ভালই ভিড় হচ্ছে। কেবল মঞ্চ থেকে ভাষণ দেবার চেয়ে এ অনেক ভালো, সংগঠন খানিক চাঙ্গা হবে, মানুষের কাছে একটা লরাই এর ছবি উঠে আসবে, ঘুরে দাঁড়ানোর বুকনি না দিয়ে গুরে দাঁড়ানোর জন্য ইন্সাফ যাত্রা জরুরিই ছিল। পদযাত্রা তো নতুন কিছু নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসে গান্ধী থেকে মাও পথে নেমেছেন, ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার ও তুফান প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল, কমরেড লেনিনের আহ্বান চলে মুক্তি সেনাদল। ডান্ডি মার্চের সামনে এক কৌপিন পরা ফকির বুঝিয়ে দিয়েছিল তাঁর ক্ষমতা। স্বাধীন ভারতেও বহুবার, বহু দল বহু নেতা পথে নেমেছেন। অন্ধ্রে ওয়াই এস আর রেড্ডি, তাঁর ছেলে জগন রেড্ডি, এই তো সেদিন চন্দ্রবাবু নাইডুও, রথে চেপেই সই রাস্তাতেই ছিলেন আদবানিজী, রাহুলের ভারত জোড়ও যাত্রাও ছিল বহুদিন পরে দেশ জোড়া এক পথে নামার কর্মসূচি। সে সফল অভিযানের পর আবার তিনিই নামবেন, রাস্তা আর রিসোর্স নিয়ে প্ল্যানিং চলছে। অভিষেক জনজোয়ারের কিছু লাভ তো পেয়েইছেন। রাস্তাই রাস্তা দেখায়, দেখাবে, তাই এবার ইন্সাফ যাত্রা। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, সি পি এম দলের যুব শক্তি এবং ইনসাফ যাত্রা।
রাস্তায় তো নামে বহু মানুষ, কিন্তু রাস্তায় যদি কোনও বিশেষ উদ্যেশ্য নিয়েই নামা হয়, তাহলে সেই নামার প্রথম শর্ত হল রাস্তায় নেমে কী কমিউনিকেট করা হবে? কী বলা হবে? কেন বলা হবে? কি ভাবে বলা হবে তা নিয়ে এক নিশ্চিত জায়গায় আসা। গান্ধীজি জানতেন তিনি ভারতবর্ষের নাড়ি ধরে টান দিচ্ছেন, নুন, প্রতিদিনের ব্যবহার্য নুন আমি নিজে বানাবো, ট্যাক্স দেবো না। প্রতিটা মানুষকে বুঝিয়ে দেবে এক সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসনের স্বরূপ। মাও এর লং মার্চ ছিল দেশজুড়ে নিপীড়িত মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেবার লড়াই, নিজেদের অস্ত্র হাতে নাও অত্যাচারের অবসান করো। এই তো। মানে কেবল নামলেই হবে না, নেমে কী করবো, কী বলবো, সেটা নিয়ে এক স্পষ্ট ধারণাও দরকার। রাহুল গান্ধী বা কংগ্রেস বেশ ভাল করেই বুঝেছেন যে বহু ভুল হয়ে গেছে, দেশের অগণিত দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে যেতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা, কল্যাণকর রাষ্ট্রিত্যাদি পুরনো আদর্শ ধ্যান ধারণাগুলোকে আবার আঁকড়ে ধরতে হবে। দেখুন গোটা যাত্রা পথজুড়ে তিনি কৃষকদের কথা বলছেন, দিন আনি দিন খাই মজুরদের কথা বলছেন, ন্যুনতম মজুরি আর রোজগারের কথা বলছেন। বলেছেন নাকি ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমি আর বিকাশের কথা? বলেন নি কারণ সেগুলো তো বিজেপি বলছে, মোদি শাহ বলছে, বন্দে ভারত, বুলেট ট্রেন আর ডিজিটাল ইকনমির কথা বলছে। ঠিক সেইরকমই এই ইন্সাফ যাত্রা কী বলছে? মীনাক্ষী কী বলছেন? তাঁর দল কী বলছে? সাধারণ মানুষ জানে? পথ চলতি মানুষকে বোঝানো যাবে যে মমতা আর বিজেপির তলায় তলায় সেটিং আছে? একজনকেও বোঝানো যাবে? বোঝানো যাবে যে এই রাজ্যে তৃণমূল আর বিজেপি দুজনকেই হারানোর জন্যে ওঁরা লড়ছেন, সেই লড়াই এ সামিল হতে হবে? মানুষ কি একেবারেই হাবাগোবা? একটুও যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা জানেন না কেরালায় সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গেই লড়ছে, লড়বে? যিনি কিছুটা হলেও খবরের কাগজ পড়েন আর টিভি দেখেন, তাঁকে বোঝানো যাবে যে মমতা ইয়েচুরি রাহুল পাটনা, বেঙ্গালুরু, মুম্বাইতে এক মঞ্চে বসে ভাষণ দিলেও মমতা আসলে বিজেপিই। যদি এগুলো বোঝানো নাই যায়, তাহলে কী বলছেন মীনাক্ষী? যদি এগুলোই বলেন আর মানুষ বুঝতেই না পারে, তাহলে মীনাক্ষীর বলেই বা লাভ কী? বিশ্বাসযোগ্যতাই যদি তৈরি না হয় তাহলে কেবল রাস্তাই কি কোনও রাস্তা দেখাতে পারবে? আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, সি পি এম এর ছাত্র যুবরা পথে নেমেছেন, সত্যিই তাঁরা দীর্ঘ পথ হেঁটে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসার পথে মানুষকে কিছু বোঝানোর চেষতা করছেন। কিন্তু মানুষ কি তাঁদের কথা বুঝতে পারছেন? ইন্সাফ যাত্রা তাঁদের কোনও পলিটিকাল মাইলেজ এনে দিতে পারবে? শুনুন মানুষজন প্রশ্নের উত্তরে কী বলছেন।
পাথরে ভগবান থাকে না, কল্পনায় থাকেন, চিন্তায় থাকেন চেতনায় থাকেন। রাস্তাতেই রাস্তার দিকনির্দেশ পাওয়া যায় না, সে দিকনির্দেশ আসে নিজেদের চিন্তার থেকে, নিজেদের চেতনার থেকে। সেখানে ঘুন লাগলে হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চললেও, সিংহল সাগর থেকে মালয় সাগরে পৌঁছলেও কোনও লাভ হয় না। ২০২১। সদ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে। মাটির অত্যন্ত কাছাকাছি নেতা কান্তি গাঙ্গুলি তাঁর প্রতিক্রীয়া দিতে গিয়ে বললেন, “সংযুক্ত মোর্চা ধর্মীয় ফ্যাসীবাদকে রুখতে পারবে, মানুষের এই বিশ্বাস আমরা অর্জন করতে পারিনি। … তবে আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলার মানুষকে, যার নেতৃত্বেই হোক না কেন তাঁরা মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে পেরেছেন। রাজ্যবাসী সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।” অন্যদিকে একইদলের আইনজীবি বিকাশ ভট্টাচার্য বললেন, “মমতার জয়ে খুশী কারা? এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে মমতার এ নির্বাচনী সাফল্যে খুশী হয়েছে আর.এস.এস ও সিপিআইএম বিরোধী সমস্ত শক্তি। … মমতার জয় তাই নি:সন্দেহে ফ্যাসিবাদী শক্তির জয়। তারাই শক্তিশালী হল। ধর্মীয় বিভাজন ও ঘরে বাইরের বিভাজন, ফ্যসিবাদী দর্শনের সামাজিক ভিত্তি, জয়ী হল।” বিকাশ বাবু যা বলেছিলেন সেটা বলা ভাল? না কান্তিবাবু যা বলেছিলেন সেটাই পথ, সেটা আগে ঠিক করুন, তারপর পথে নামুন, ইন্সাফ মিলবে, না হলে ঐ পথ হাঁটাই সার হবে।