সে এক ফুটপাথের ভিখিরিই হোক, এক কেরানি মধ্যবিত্তই হোক বা এক সদ্য পয়সাওলা ব্যবসায়ী, তার নিজের তিল তিল করে জমানো সম্পদ বেহাত হতে দিতে পারে না। সে ভিখিরি ফুটপাথের যে অংশটা দখল করে প্লাস্টিকের ছাউনি আর সিনেমার ব্যানারের ফ্লেক্স এনে মাথার ছাদ তৈরি করেছে, সেইখনে শুয়ে রাতে সে উপরে তাকালেই নুসরত জাহান বা মিমি চক্রবর্তীর ছবি দেখতে পায়, ওটাই তার প্যালেস, ওটা সে কোনও মূল্যেই ছাড়তে রাজি হয় না, ওটার জন্য প্রায়সই সে যাবতীয় আদর্শ, যাবতীয় নীতিজ্ঞান বিসর্জন দেয়, এটাই স্বাভাবিক। তো সেরকম এক রাজত্ব তৈরি করেছেন বহরমপুরের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী। এককালে আরএসপি-র যুব সংগঠনের ডাকাবুকো উঠতি নেতা বুঝেছিলেন, তিনি ওই দলে থেকে তাঁর নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করতে পারবেন না অতএব তাঁর রবিন হুড ইমেজ নিয়ে তিনি কংগ্রেসে চলে এলেন। কংগ্রেস রাজনীতি ছিল আবরণ, সাইকেল যুবক বাহিনী তৈরি হয়েছিল, তখন বাংলাদেশে ডিম থেকে টুথপেস্ট যেত এপার বাংলা থেকে, অবশ্যই আইন কানুন মেনে নয়। তো সেই ছেলেরা যারা ওই সাইকেলে মাল চাপিয়ে ওপারে পৌঁছে দিত, তারা অধীর চৌধুরির অতি ভক্ত ছিল। সেই থেকে বহরমপুরে অধীর সাম্রাজ্যের সূত্রপাত। তারপর বিভিন্ন ক্রিমিনাল কেস, জেল, জেল থেকে এমএলএ হওয়া, কংগ্রেসের সোমেন মিত্রের ছত্রছায়াতে বেড়ে ওঠা, এক বিরাট কাহিনি, কিন্তু উনি থেকেই গেছেন ওই বহরমপুরের কংগ্রেস নেতা। এবং এরই মধ্যে মমতা কংগ্রেসের অন্যতম নেতা হয়ে উঠেছেন, নির্বাচনে অধীর চৌধুরীকে টিকিট দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। সেদিন বলেছিলেন ওইসব ক্রিমিনালদের টিকিট দেওয়া হলে আমি আত্মহত্যা করব, হাতের সেই শালওলা ছবি আমরা দেখেছি। সেদিনের পর থেকে মমতার সঙ্গে অনেকেরই সম্পর্ক ভালো বা খারাপ হয়েছে, সোমেন মিত্র তৃণমূলে এসে এমপি হয়েছেন, পরে দল ছেড়েছেন, মানস ভুঁইয়া এদিকে ওদিকে বেশ কয়েকবার, এরকম আরও অনেকেই আছেন কিন্তু অধীর চৌধুরীর সঙ্গে মমতার হেসে কথা বলার মতো ঘটনাও ঘটেনি। সেই অধীর চৌধুরী আবার আলোচনার শিরোনামে। তিনিই নাকি জোটের প্রথম বাধা। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, এই বাংলাতে কংগ্রেস তৃণমূল জোট হলে অধীর চৌধুরীর দিল্লি যাওয়া হবে না।
অধীর চৌধুরী এ বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট চান না তার কারণ কী? তার কারণ কি এটাই যে এই মমতাই একদিন তাঁর এমএলএর টিকিট কাটার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন, প্রাণ থাকতে অধীরের মতো ক্রিমিনাল টিকিট না পায় তার কথা বলেছিলেন। এরকম ভাবলে ভুল ভাববেন। অধীর চৌধুরী জীবনে বহুবার আনুগত্য বদলেছেন, শিবির বদলেছেন, দলও বদলেছেন, কাজেই কোন নেতা কী বলেছিলেন তা মনে রেখে উনি রাজনীতি করেন না এটা পরিষ্কার।
আরও পড়ুন: Aajke | কীভাবে শাহজাহান তৈরি হয়েছে
সবথেকে বড় কথা এই সিপিএম-এর আমলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে ওনাকে জেলে পোরা হয়েছিল, উনি সেসব ভুলেই সিপিএম-এর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তার প্রথম আর শেষ কারণ হল বহরমপুরের সাম্রাজ্য ধরে রাখা। ধরুন অধীরবাবু বহরমপুরের নির্বাচিত সাংসদ নন, তাহলে উনি কে? ওনার হাতে তো পেনসিলও থাকবে না। কাজেই ওনার এক ও একমাত্র বিবেচ্য হল ওই বহরমপুর, সেখানকার বিধায়ক পদ, পরে সেখানকার সাংসদ পদ। সারা দেশ জানে উনিও জানেন ভালো করেই যে উনি লোকসভার বিরোধী দলের নেতা এবং সেই পদটি দুধুভাতু। এতটাই দুধুভাতু যে সেই বিরোধী দলনেতা হিসেবে তাঁর কাছে সরকারি চিঠিপত্র এলে উনি নিজেই পাত্তা দেন না, তাঁর চেয়ে ঢের বেশি যোগ্য নেতা অনেকেই ছিলেন, শশী থারুর ছিলেন, কিন্তু তিনিই সেই কাঠপুতুল হতে পারবেন জেনেই তাঁকে ওই পদে বসানো হয়েছে, এটা তিনিও জানেন। ওসবে তাঁর তেমন লোভও নেই, ওনার এক এবং একমাত্র পাখির চোখ হল বহরমপুর। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের জোট হলে এমনিতে তো হাসতে হাসতেই ওনার জিতে যাওয়া উচিত। তার উপরে বিরোধী ভোট বাম আর বিজেপিতে ভেঙে যাবে, তাতে আরও সুবিধে। কিন্তু সমস্যা তো সেখানেই, উনি ভালো করেই জানেন তৃণমূল নেত্রী ওনাকে দিল্লি যেতে দেবেন না, যদিও বা তিনি নিমরাজি হয়েই মেনেও নেন, ওনার এলাকার তৃণমূলের ভোট তিনি হারগিজ পাবেন না। ওদিকে বামেরা ভোট কাটলেও ওই আসন বিজেপির হাতেই যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। অধীর চৌধুরীর কাছে অন্য উপায়টা কী? বামেদের সঙ্গে হাত মেলানো, তাতে সারা বাংলায় কংগ্রেস বামেদের ভোট দেবে, খুব কম সংখ্যায় হলেও দেবে, বাকি আসনগুলো ভোট কাটাকুটির ফলে কংগ্রেস হারাতেও পারে, কিন্তু বহরমপুরে জোটের প্রবক্তা কংগ্রেসের ভোট পাবেন, পাবেন বামেদের সম্পূর্ণ সমর্থন। এই অঙ্কে তিনি জিতেই যাবেন এমন কিন্তু নয়, কিন্তু অন্তত জেতার একটা সম্ভাবনা থাকবে। কাজেই একমাত্র নিজের বহরমপুর থেকে দিল্লি যাওয়ার রাস্তাটা খোলা রাখার জন্যই তিনি বাম-কংগ্রেস জোট চান, তৃণমূলের সঙ্গে জোট চান না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম অধীর চৌধুরীই এই বাংলাতে কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেসের জোট যাতে না হয় তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এর পিছনে কারণটা কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অনেকেই বলছেন অধীরবাবু বিজেপিতে চলে যাবেন, না যাবেন না। যাবেন না তার কারণ এটা নয় যে উনি খুব সেকুলার, কংগ্রেস দলের আদর্শবাদী এক নেতা। উনি যাবেন না কারণ বহরমপুর বা মুর্শিদাবাদ যা ওনার চারণভূমি সেখানে সংখ্যালঘু ভোট বিরাট, তারাই নির্ধারক শক্তি, ওনার ভোটার। উনি বিজেপিতে গেলে দুকূল যাবে এটা উনি জানেন। কাজেই উনি বিজেপিতে যাবেন না। আবার তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাবেন না। আপাতত ওনার ক্ষীণ সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখতেই উনি বামেদের সঙ্গে থাকার কথাই বলে যাবেন।