ঘৃণা ছড়ানোর আপাতত স্বর্গরাজ্য এই ভারতে, কেউ একটা প্যারোডি লিখেছেন, গেয়েছেন , বা সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা লেখা লিখেছে্ন, অমনি ভাঙচুর করো, হাজির হনুমান বাহিনী, কারণ তাদের সেই নেতা তো বাজারে গিয়ে মিডিয়া ডেকে, সঙ্গে রেখে, মিডিয়ার সামনেই দা কাটারি কিনছেন, চোখে মুখে এক জান্তব ইঙ্গিত, দা নাকি অনেক কাজে দেবে। জানি তো, দা কাটারি কাজে দেয় তো, ঢিল, ইট পাটকেলও কাজে দেয় দিলুবাবু, শ্যামাপ্রসাদের লেখা পড়ে নেবেন, ওনার মাথা কারা ফাটিয়েছিল, সেটা উনি নিজেই লিখে গেছেন। এই হনুমানের দল আর তার অনুগামীরা কুণাল কামরা যেখানে তাঁর স্ট্যান্ড আপ কমেডি করত সেটা ভাঙচুর করল, তাকে জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দিল। আমরা চুপ করে বসে পপকর্ন খাচ্ছি, এদিকে আমাদের মধ্যেই আহাম্মকের তো অভাব নেই, সেই আহাম্মকদের কেউ কেউ ওটা সত্যিই এক উচ্চমানের কমেডি কি না, সত্যিই কমেডি কি না নাকি স্রেফ ছ্যাবলামি তা নিয়ে গবেষণা করছেন। হ্যাঁ, একধারে শ্বাপদেরা ঘুরছে, তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তাদের হিন্দুত্বের এজেন্ডার বিরুদ্ধে একটা কথা বলা হলেই জানে মেরে দেবে, জেলে পুরে দেবে, বুলডোজার পাঠিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে দেবে, অন্যধারে কিছু আরশোলা, উচ্চিংড়েরা বসে আছে, ইহা কি কমেডি? বাক স্বাধীনতা নিয়ে রবি ঠাকুর থেকে দেরিদা ফুকো কী বলিয়াছেন তাই নিয়ে আলোচনা এবং মন্তব্য করার জন্য। যেন ছ্যাবলামি করলেই, কারও বিরুদ্ধে কিছু বললেই তার স্টুডিও ভাঙাটা জায়জ কাজ, তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়াটা এক্কেবারে এক সংবিধান সম্মত ব্যাপার। ক’দিন আগে জন্ম নিলে এনারা এই বাংলার রূপচাঁদ পক্ষীর গর্দান নিতেন। কিন্তু এসব আদন্ত্য সুবিধেবাদী দালালদের পালটিবাজেদের কথা ছেড়ে আজ বরং আমরা সেই শ্বাপদদের কথা নিয়েই আলোচনায় নামি। যারা দেশের সর্বত্র এক চরম অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, নানান মিথ্যে ইতিহাস, নানান মিথ্যে তথ্য, নানান মিথ্যে গল্প ছড়িয়ে আদতে গোটা সমাজে ঘৃণা ছড়িয়ে দাও। আরএসএস–বিজেপির প্রপাগান্ডা ব্রিগেডের সেই তালিকায় আমাদের রাজ্যের দিলু ঘোষের নাম আছে। যিনি অনায়াসে একজন মহিলাকে গলা টিপে মেরে ফেলব, এরকম কথা প্রকাশ্যেই বলতে পারেন, সেই তিনিই কেবল নয়, ইদানিং তাঁর দোসর শুভেন্দুও বিষ ছড়ানোর এক প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন, সেটাই বিষয় আজকে, দিলীপের হাতে দা, মুখে ঘৃণা, নতুন দোসর শুভেন্দু।
ছোট্টবেলার স্কুলের কথা মনে পড়ছে, বছরে একবার ক্লাস মনিটর বেছে দিতেন হেড স্যর, আমরা সেদিনটার জন্য ওয়েট করতাম, খানিক আঁচও পেতাম, বৃহস্পতি কি সোম কি বুধবারে হেডস্যার আসবেন, ঘন্টা খানেক ছাত্র ছাত্রীদের কী কী করিতে হইবে, কী করিবে না ইত্যাদি জ্ঞান দিতে দিতেই গোটা ঘরের ছাত্র ছাত্রীদের মাপতেন, তারপর ঘন্টা বাজার আগেই জানিয়ে দিতেন কে হবে প্রধান মনিটর, আর কারা দুজন অ্যাসিসট্যান্ট মনিটর। এবং গল্পটা এটা নয়, গল্পটা হল আমরা ছাত্র ছাত্রীরা সেই ৫০ মিনিট ধরে নিজেদেরকে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে ডিসিপ্লিনড, সবচেয়ে যোগ্য মনিটর হিসেবে তুলে ধরার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতাম।
আরও পড়ুন: Aajke | কমরেডস, এত গাঁজা আর ড্রাগস কেন?
বাংলাতে ঠিক সেটাই চলছে। দিল্লি থেকে বলা হয়েছে আর ক’টা দিন, সভাপতি বেছে দেওয়া হবে, বিজেপির কুষ্ঠিতে নির্বাচন বলে কিছুই নেই, এদিকে নাকি মাদার অফ দ্য ডেমোক্রেসির ফাদার বসে আছেন দলের মাথায়, তো যাই হোক ওই সভাপতি বেছে দেওয়া হবে শুনেই মাঠে নেমেছেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা, কেবল জেলা সভাপতির লিস্ট বের হওয়ার পরেই অকাল হোলি হয়েছে, এবং কোনও প্যারোডি না গাওয়া সত্বেও ভাঙচুর হয়েছে বিজেপির দলীয় কার্যালয়, সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড, মুখে কালি মেখে দাঁড়িয়ে আছে যেন মুখপোড়া হনুমান। সেই বাজারে সর্বোচ্চ পদ বলে কথা, বঙ্গ বিজেপির সভাপতি। কাজেই শুভেন্দু চিৎকার করছেন মুসলমান এমএলএ-দের নাকি চ্যাংদোলা করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসবেন, শর্ত একটাই, ওনারা ক্ষমতায় এলে তারপরে এই ঘটনাটি ঘটবে। খ্যাক খ্যাক করে হাসছে খিদিরপুর থেকে ফুরফুরা শরিফ থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গোটা বাংলা, ইদের আনন্দ চোখে মুখে, কারণ সব্বাই জানেন সাত মণ তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। তো উনি বলেছেন মুসলমানদের চ্যাংদোলা করে ফেলে দেব, জনান্তিকে আমি এবং দিলীপ ঘোষ এ কথা শুনেছি, আমি স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত, অক্ষমের প্রলাপে আমার আনন্দ হয় কিন্তু দিলু ঘোষ তিনি এক বঙ্গ ললনার গলা টিপে ধরার কথা বললেন, তিনি নাকি আবার বিবেকানন্দের শিষ্য, আজ তিনি জীবিত থাকলে আমি নিশ্চিত উনি এই আহাম্মকের গলা টিপে ধরতেন, কারণ সেই বিবেকানন্দই বলে গেছেন, “যে দেশে নারীদের সম্মান করা হয় না, সে দেশ কখনও উন্নতি করতে পারে না। নারীদের দিয়েই সমাজের ভিত গড়ে ওঠে।” এক দুর্দান্ত কমপিটিশন চলছে, ঘৃণা ছড়ানোর, অসভ্যতামির, এ দা কাটারি কিনছে, ইঙ্গিত দিচ্ছে হিংসার, সে সংখ্যালঘুদেরকে বাদ দিয়েই রাজ্যের কথা ভাবছে, আসলে ওই হেড মনিটর হওয়ার এক তীব্র প্রতিযোগিতা। একবার ভাবুন এক দল, তার নেতা কর্মীরা স্রেফ একটা প্যারডি সহ্য করতে পারে না, এক দল প্রতি মুহূর্তে সামান্যতম বিরোধিতার কথা শুনলে জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয়, সেই দল বাংলার মাটিতে আস্তানা গাড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এক প্যারোডি গাইবার জন্য একজন কমেডিয়ানকে জানে মারার চেষ্টা চলছে, সেই দলের নেতা সংখ্যালঘু বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে বিধানসভার বাইরে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন, অন্যজন এমনকী এক মহিলার গলা টিপে মারার কথা বলছেন। এই দলের বাংলায় একটা আসনও কি জেতা উচিত? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
বাংলার মাটি রামমোহন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের, মাইকেল মধুসূদন এই মাটিতে বসেই রাবণ রাজার এক বীরগাথা লিখেছেন, এই মাটিতেই চন্ডীদাস লিখেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই, এই বাংলায় রবিঠাকুর বলেছেন শ্বাশ্বত মানবতার কথা, নজরুল বলেছেন একই বৃন্তে দুটি কুসুমের কথা, নেতাজি বলেছেন ত্রিশূল আর গেরুয়া নিয়ে হিন্দুত্ব মেনে নেব না। এটাই বাংলা। কাদের গাফিলতিতে, কাদের ইন্ধনে, কে বিজেপিকে জমি দিয়েছে এখন সেটা বিচার করার সময় নয়, এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উপড়ে ফেলে এক সুস্থ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা গড়ে তুলতে হবে এটাই সময়ের চাহিদা।