কেরালা, যাকে সবাই বলে ‘গডস ওন কান্ট্রি’ বলে আর যেটা এখনও সিপিএম-এর শেষ দুর্গ— সেখানে ড্রাগের সমস্যা সাংঘাতিক চেহারা নিয়েছে। নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস (NDPS) আইনের কেস বছরের পর বছর বাড়ছে। ২০২১ সালে এই কেস ছিল ৫,৬৯৫টা। ২০২২ সালে লাফিয়ে গিয়ে হয়ে গেল ২৬,৬১৯টা। ২০২৩ সালে আরও বেড়ে ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেল। ২০২৪ সালে ২৭,৭০১টা কেস হয়েছে। আর এই সংখ্যা দেখে মাথা ঘুরে যায় যখন দেখি, অন্য রাজ্যের তুলনায় কেরালা অনেক এগিয়ে। ২০২৩ সালে মহারাষ্ট্রে, যারা আগে এই তালিকাতে দু’ নম্বরে ছিল, সেখানে কেরালার অর্ধেক কেস হয়েছে। ২০২৪ সালে পাঞ্জাব দ্বিতীয় স্থানে এলেও, তাদের কেস কেরালার মাত্র এক তৃতীয়াংশ। এটা দেখে মনে হয়, গডস ওন কান্ট্রি এখন ড্রাগের কান্ট্রি হয়ে যাচ্ছে! স্কুল থেকে বাড়ি, সব জায়গায় এই ড্রাগের ঝামেলা ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন নতুন তথ্য আর রিপোর্ট দেখলে মনে হচ্ছে বাম জমানাতে আর বাকি অন্য কিছুর সঙ্গে এই ড্রাগ, গাঁজা, হেরোইন, এক্সট্যাসি, এলএসডি, কোকেনও পাল্লা দিয়েই বাড়ছে। এবং তারা আপাতত সারা দেশের মধ্যে এই হিসেবে প্রথম, নতুন উচ্চতায় বাম কেরালা। নতুন রিপোর্ট বলছে, কেরালার তরুণরা এখন অ্যামফেটামিন ফ্যামিলির ‘জাগরণ ড্রাগ’ যেমন মেথ খাচ্ছে। মেথ এখন তরুণদের পছন্দের ড্রাগ হয়ে যাচ্ছে, গাঁজা আর বুপ্রেনরফিনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে যে এফেড্রা গাছ জন্মায়, সেটা থেকে এফেড্রিন বানিয়ে মেথ তৈরি হচ্ছে। এতে মেথ বানানোর খরচ কমে গেছে, আর দামও কমে গেছে— ৫ গ্রাম মেথ এখন ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকায় পাওয়া যায়। ২০২৫ সালের প্রথম মাসে কেরালায় ২,০০০টা NDPS কেস হয়েছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ ৪,৩৭০.৫৯৫ কেজি গাঁজা আর ৩,৫১৯.৯৫৪ গ্রাম এমডিএমএ ধরেছে। সেটাই বিষয় আজকে।
কেরালার মধ্যে এর্নাকুলাম জেলা আপাতত ড্রাগের সবচেয়ে বড় আড্ডা হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত এর্নাকুলামে মোট ৮,৫৬৭টা NDPS কেস হয়েছে— পুরো কেরালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে কোচি শহরে ৬,৪৩৬টা আর এর্নাকুলাম গ্রামাঞ্চলে ২,১৩১টা কেস। এই সময়ে ৬,১৯১ জনকে ড্রাগ নেওয়ার জন্য ধরা হয়েছে, কোচিতে ৪,৫২৮ আর এর্নাকুলাম গ্রামে ১,৬৬৩, আর ২,৩৭৬ জনকে ড্রাগ বেচার জন্য ধরা হয়েছে কোচিতে ১,৯০৮ আর এর্নাকুলাম গ্রামে ৪৬৮। এর্নাকুলামে সবচেয়ে বেশি কেস হলেও, মালাপ্পুরমে ৫,৯০৬টা আর কোঝিকোডে ৫,৩৮৫টা কেস হয়েছে, সেটাও কম নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | বিজেপি ২০২৬_এর আগে চারজন ইউটিউবারকে যাবতীয় অপপ্রচারের দায়িত্ব দিয়েছে
কোচি শহরের পুলিশ কমিশনার পুত্তা বিমলাদিত্য বলছেন, “কোচিতে এত কেস হচ্ছে মানে এখানে ড্রাগ বেশি আছে, এমনটা নয়। এটার মানে আমাদের পুলিশ বেশি সক্রিয়, তাই বেশি ধরা পড়ছে।” তাঁর এই কথাই বিধানসভাতে শাসকদলের গলায় শোনা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বহু রাজ্যেই ড্রাগ বিক্রি হচ্ছে খাচ্ছে কিন্তু সেখানে ধরা হচ্ছে না বলেই নাকি তারা এই তালিকায় নেই। আহা কী অপূর্ব যুক্তি। আসুন দেখা যাক কী কী ড্রাগ পাওয়া যাচ্ছে? কেরালায় বছর দশেক আগেও আগে গাঁজার চল ছিল, আফটার অল গডস ওন কান্ট্রি, কিন্তু এখন সিনথেটিক ড্রাগের দিকে ঝুঁকছে। এমডিএমএ, যাকে এক্সট্যাসি বা মলি বলা হয়, মেথামফেটামিন, কোকেন, হাশিশ, ব্রাউন সুগার, আর হেরোইন— এসব এখন ধরা পড়ছে। এমডিএমএ ধরা পড়ার পরিমাণ এক বছরে ৬৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এমডিএমএ বেশিরভাগ আসছে বেঙ্গালুরু থেকে। এখন বিদেশ থেকেও ড্রাগ আসছে, কেরালার বিদেশ যোগাযোগ আজকের নয়। সমস্যাটা আরও জটিল কারণ অন্য রাজ্যে ড্রাগের সমস্যা শহরে বেশি থাকে, কিন্তু কেরালায় সব জেলায় এই ড্রাগ খাওয়া, বিক্রি বেড়ে গেছে। ২০২২ সালে কেরালার প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে ৫০০টা NDPS কেস হয়েছে। মানে পুরো কেরালা জুড়ে এই সমস্যা ছড়িয়ে আছে। এটা পুলিশের জন্য বড় ঝামেলা, কারণ এত বড় জায়গা জুড়ে নজরদারি কঠিন। তুলনা করলে দেখা যায়, মহারাষ্ট্রে মুম্বইয়ে ৮০ শতাংশ কেস আর কর্নাটকে বেঙ্গালুরুতে ৬৩ শতাংশ কেস হয়। কিন্তু কেরালায় সব জায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে আছে। আর একটা সমস্যা চোখে পড়বে, কেরালায় ড্রাগের কেসগুলোর বেশিরভাগই হচ্ছে ড্রাগ রাখার জন্য, খাওয়ার জন্য, কনজাম্পশনের জন্য, বেচার জন্য নয়। ২০২২ সালে ৯৪ শতাংশ কেস হয়েছে ড্রাগ রাখার জন্য, আর মাত্র ৬ শতাংশ হয়েছে ড্রাগ বেচার জন্য। ২০২২ সালে সারা ভারতে ড্রাগ রাখার সবচেয়ে বেশি কেসের ২৫টা জেলার তালিকায় ১৭টা জেলা কেরালার। কিন্তু ড্রাগ বেচার সবচেয়ে বেশি কেসের ২৫টা জেলার তালিকায় কেরালার একটাও জেলা নেই— সেখানে পাঞ্জাবের ১৩টা জেলা আছে। মানে, কেরালায় লোকে ড্রাগ বেশি খাচ্ছে, বেচছে না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দীর্ঘদিন ধরে বাম আন্দোলনের এক দুর্গ কেরালাতে এই গাঁজা, কোকেন, এলএসডি, ড্রাগের এই রমরমা বাজার কেন? আমাদের রাজ্য বাংলা কিন্তু সেই তুলনায় তালিকায় এক্কেবারে শেষের দিকে। কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
কেরালায় ড্রাগ খাওয়া বাড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। লোকের জীবন নিয়ে ধারণা বদলে যাচ্ছে, ছেলেরা হাইপার-ম্যাসকুলিনিটি দেখাতে গিয়ে ড্রাগ খাচ্ছে, গ্যাং-এর প্রতি লয়ালটি দেখাতে, যেটা অনেক সময় হিংস্র সিনেমা দেখেই তারা শেখে, আর তরুণদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, বড় স্বপ্ন পূরণের সুযোগ না থাকায় তারা ড্রাগের দিকে ঝুঁকছে। ড্রাগ পাওয়াও এখন খুব সহজ— অনলাইনে অর্ডার করলেই কুইক ডেলিভারি হয়ে যায়। আর অফলাইনে পুলিশ ১,৩০০টা ড্রাগ বেচার কালো জায়গা খুঁজে বের করেছে। ড্রাগের এই ঝামেলা কেরালার উপর বড় প্রভাব ফেলছে। ড্রাগ খেয়ে হিংসা বাড়ছে, এমনকী বাড়ির মধ্যেও ড্রাগের জন্য ঝগড়া হচ্ছে। স্কুলে ড্রাগ পাওয়া যাচ্ছে, এমনকী ক্যান্ডি আর আইসক্রিমের মতো করে ড্রাগ বিক্রি হচ্ছে। এটা দেখে বাবা-মায়েরা ভয় পেয়ে গেছে, অনেকে তাদের বাচ্চাদের জন্য ড্রাগ টেস্ট কিট কিনছে। এই সমস্যা এত বড় হয়ে গেছে যে কেরালার বিধানসভায় নিয়মিত কাজ বন্ধ করে এটা নিয়ে আলোচনাও করতে হয়েছে। কেরালায় ড্রাগের ঝামেলা এখন একটা বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনথেটিক ড্রাগ বাড়ছে, সব জেলায় এটা ছড়িয়ে পড়ছে, আর বেশিরভাগ কেস ড্রাগ রাখার। পুলিশ অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু ড্রাগ ধরা আর পাচারকারীদের নিত্যনতুন কায়দা তাদের চোখে ধুলো দিয়েই এই র্যাকেটকে বাড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু পুলিশের চেষ্টা দিয়ে হবে না, কেরালার তরুণদের এই বিপদে পড়ার পেছনের কারণগুলো— যেমন সুযোগের অভাব, জীবন নিয়ে ভুল ধারণা, এগুলোকেও ঠিক করতে হবে। গডস ওন কান্ট্রি, সিপিএম-এর শেষ দুর্গ যদি ড্রাগের দুর্গ হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা বামপন্থারও সমস্যা, তাই নয় কি?