মাসে সাকুল্যে আয় যার ১৫ কি ১৬ হাজার টাকা সেও একটা নতুন আইফোন ফিফটিন চায়। রুপোলি পর্দার বহু নায়িকা বহু কিশোরের স্বপ্ন ছিল, আছে, থাকবে। সাইকেলে করে যেতে যেতেই ফেরারি গাড়ি চোখে পড়ে, একটা অমন হলে কেমন হত, ভাবে সেই যুবক। এমনই আদেখলা হয় ইচ্ছেগুলো। তারা যখন তখন পাতালের রত্ন চায়, আকাশের চাঁদ ধরে এনে খেলা করতে চায়। কৈশোরে, যৌবনে এসব ইচ্ছে তো থাকারই কথা। কিন্তু তেমন ইচ্ছে যদি ৩৪ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা এক রাজনৈতিক দলের হয়? তাহলে? ইডি আসবে খপ করে অভিষেক আর মমতাকে ধরবে, অমনি সরকারটা ধুপ করে পড়ে যাবে, আহা কী আনন্দ আবার অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু এরই সঙ্গে ওই ইডি যখন নিউজ ক্লিক-এ হানা দেবে, যখন তেজস্বী যাদবকে জেরা করবে, কেরলে সিপিএম বিধায়কের দখলে থাকা সমবায় দফতরে রেড করবে? তখন তা ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী, তার বিরোধিতা করবেন সিপিএম নেতারা। এমন এক খোয়াবের অঙ্গ হিসেবেই কমরেড সেলিম চলে গিয়েছিলেন সিজিও কমপ্লেক্সে। সেখানে জমায়েতের মধ্যেই যারা যারা দুর্নীতি করেছে, অর্থাৎ ওই অভিষেক-মমতাকে গ্রেফতার করার প্রস্তাব পাশ করা হল এবং তা তুলে দেওয়া হল ইডি অফিসারদের হাতে। অর্থাৎ বিহারে, দিল্লিতে কেরলে তামিলনাড়ুতে ইডি অফিসারেরা ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্দেশে কাজ করছে, আর এখানে মুক্ত স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক। তাই তাদের কাছে দাবি জানালে তাঁরা নিশ্চয়ই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করবেন। ব্যস, ল্যাটা চুকে গেল। রাজ্য জুড়ে মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন মিছিল মিটিং করার দরকার তো নেই। ইডি, সিবিআই এখন বিপ্লবী কমিউনিস্ট দল সিপিএম-এর সহযোগী, তারাই ওনাদের হয়ে কাজটা করে দেবে। সেটাই বিষয় আজকে, ইডি প্রতিষ্ঠা করে দেবে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার।
সিজিও কমপ্লেক্সে সিপিএম নেতারা চলে গেলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করার দাবিতে। ঠিক সেই দিনেই সারা রাজ্যের মানুষ দেখছিলেন রাজ্যের বকেয়া টাকা আদায়ের দাবিতে আরেক আন্দোলন। সেটা রাজভবনের সামনে, দিল্লিতে মন্ত্রী পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে, এখানে রাজ্যপাল আগেই কেটে পড়েছেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ঠিক আছে রাজ্যপাল না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই বসে থাকব। হ্যাঁ, গ্রামের মানুষ যাঁরা ১০০ দিনের কাজের টাকা পাননি তাঁরা দেখছেন, ঘরের জন্য টাকা পাননি, তাঁরা দেখছেন। একই কলকাতায় দুটো আন্দোলন চলছে। রাজনৈতিক নেতারা এই আন্দোলন করে কী চান? সিপিএম নেতারা কি মনে করেন ওনারা বলবেন আর ইডি মমতা অভিষেককে গ্রেফতার করবে?
আরও পড়ুন: অভিষেক বাংলার রাজনৈতিক লড়াইটাকে তৃণমূল বনাম বিজেপি করে তুলছেন
না, ওনারা চান এটা রাজ্যের মানুষের কাছে যাক। তার মানে যা রাজ্যের মানুষ বুঝবেন তা হল বিজেপি সরকারের নির্দেশে চলা ইডির কাছে সিপিএম আবেদন করছে যাতে নাকি তারা রাজ্যের দুর্নীতির অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে। ওদিকে অভিষেক রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করলেই টাকা আসবে? না আসবে না কিন্তু তিনি রাজ্যের মানুষকে জানাতে চান যে মানুষের হকের টাকা মোদি সরকার আটকে রেখেছে। কোনটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে? আরও মজার যে এই অভিষেক, এই মমতাকে পাশে বসিয়ে বিজেপি বিরোধী জোটের বৈঠক হচ্ছে যে জোটকে সিপিএম শক্তিশালী করতে চায়। সামনে চার রাজ্যে নির্বাচন। বহু আগে তেলঙ্গানায় সিপিএম-এর ভালো প্রভাব ছিল, সংগঠনে এবং বিধানসভাতেও, কিন্তু এখন? একজন বিধায়কও নেই, তাঁরা টিআরএস-এর সঙ্গে জোট চেয়েছিলেন, টিআরএস রাজি নয়। এবার তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চেয়েছেন, কংগ্রেস এ নিয়ে উচ্চবাচ্যও করছে না। রাজস্থান বিধানসভায় সিপিএম-এর দুজন বিধায়ক আছে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই এনারা জিতেছেন, এবারেও সিপিএম গোটা ১৫ আসনে প্রার্থী দেবেন, কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধেই লড়াই করবেন। ছত্তিশগড়ে বা মধ্যপ্রদেশে সিপিএম-এর সংগঠন নেই, নির্বাচনে লড়লেও সেটা কোনও জোটের হয়ে লড়বেন না, নিজেরাই লড়বেন। তাহলে দাঁড়ালটা কী? কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়বেন, রাজস্থানে কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন, তেলঙ্গানাতেও তাই। মধ্যপ্রদেশেও যদি এক আধটা আসনে লড়েন তাহলে সেটাও ওই কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধেই লড়বেন আর বাংলাতে ওনারা তৃণমূল নেতাদের ইডি কেন ধরছে না? সেই দাবি নিয়ে ইডি দফতর ঘেরাও করছেন। কিন্তু ওনারা এ দেশে বিজেপি বিরোধী ঐক্যকে শক্তিশালীও করতে চান। এই স্ববিরোধিতা নিয়েই নিজেদেরকে হাস্যকর করে তুলতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। আমরা আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম, সিপিএম নেতারা সিজিও কমপ্লেক্স ঘেরাও করে ইডি অফিসারদের কাছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের দাবি জানালেন। আবার তাদের সঙ্গেই বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে বসে বৈঠকও করছেন। আপনারা এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
রাজনীতির প্রথম পাঠ হল নেতাকে, দলকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। মানুষ অ্যারিস্টটল, মার্কস, দেরিদা, ফুকো পড়ে বসে নেই, কিন্তু তাদের সাধারণ বুদ্ধি প্রখর। তারা প্রবল পরাক্রান্ত শাসককেও একটা সুযোগ পেলেই হারিয়েও দেয়, জিতিয়েও আনে। সেই মানুষ বাংলা থেকে ৭৭-এ কংগ্রেসকে ঘরে পাঠিয়েছে, তারা আর ফেরেনি। সিপিএম, যাদের একটা সময় মনে হত বাংলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তারা আজ শূন্য। তৃণমূল যারা একজন সাংসদে এসে ঠেকেছিল আজ ক্ষমতায়। দেশের রাজ্যে রাজ্যে এই ইতিহাস আছে। এ রাজ্যের সিপিএম মানুষকে যা বোঝাতে চাইছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, আর সেই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবেই এক কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে।