নির্বাচন শেষ হলেই আমাদের রাজ্যে নির্বাচন পরবর্তী হাঙ্গামা শুরু হয়। ঘর জ্বলে, ভাঙে, মানুষ মারা যায়, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কান্না আমরা শুনি। এসব নতুন কিছু নয়, জন্ম অবধি শুনে আসছি। সেই ১৯৭৭-এ বাম সরকার আসার পরে সিপিআই এম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন সংযমী হতে, আইন নিজেদের হাতে না তুলে নিতে। কিন্তু তা হয়নি, বেধড়ক মার দেওয়া হয়েছিল, কংগ্রেসি গুন্ডারা পাড়াছাড়া হয়েছিল, সিপিএম অবশ্য মানুষের গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কাহিনি বলেছিল। বহু পরে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে শুনেছিলাম, বদলা চাই না, বদল চাই। ঘণ্টা, বদলাই নেওয়া হয়েছে। আসার সম্ভাবনা এক্কেবারেই নেই কিন্তু এ রাজ্যে কখনও যদি তৃণমূলকে সরিয়ে বিজেপি আসে, তাহলে এই ছবি পাল্টাবে? হরগিজ নয়, ত্রিপুরার দিকে তাকান, বিরোধিতা করলে পুলিশ আর গুন্ডা একসঙ্গেই ক্যালানি দেয়। এবারে ভোটের পরেও ত্রিপুরাতেও একই ছবি। সেই তুলনায় এবারে আমাদের রাজ্যে নির্বাচনের সময়েও ভায়োলেন্স কম, আমাদের প্রথামাফিক ১৫-২০টা লাশ পড়ে যাওয়ার কথা, জনা দশেক মহিলার বৈধব্য স্বাভাবিক, জনা দশেক সন্তান পিতৃহারা হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু এবারে সেই সংখ্যা দুইয়ের কম, সেও আবার নির্বাচন চলাকালীন নয়। এবং তারপরে? ভাঙচুর, আগুন লাগানো? হয়েছে, নিশ্চয়ই হয়েছে, কিন্তু সেখানেও খানিক উন্নতি, রাজ্যজুড়ে তেমন খবর আসছে? না বাস্তবটা তেমন নয়। তাহলে তৃণমূলি মাস্তানেরা কি বৈষ্ণব হয়ে গিয়েছেন? না, তেমন নয়, এখন খুব সাফসুতরো একটা রাস্তা তাঁরা বেছে নিয়েছেন, দিবি না তো পাবি না। মানে যেখানে বিরোধীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে যেখানে ওই ১০০ দিনের কাজ থেকে, কন্যাশ্রী থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে যা যা আছে তাতে লাগাম দেওয়া হচ্ছে আর এই পদ্ধতি নাকি খুব কার্যকরও বটে। তা নিয়ে পরে একদিন কথা বলা যাবে, ম্যান বাই নেচার ইজ বর্ন ফ্রি, মানুষ তার চরিত্রে জন্ম থেকেই স্বাধীন, সে কি এই পাওনাগন্ডায় স্বাধীনতা হারাতে রাজি? একদিন তা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আপাতত যা বলার তা হল এক্কেবারে শারীরিক হিংসা খানিক কমেছে। কিন্তু এগজিট পোলে রাজ্যটাই দখলে আনা বিজেপির নেতারা তাঁদের নিজেদের ঘরে ঘামাসান লড়াইয়ের পরে কিছু একটা নিয়ে ভেসে থাকতে চাইছেন, আর তার রাস্তা দেখাচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজ্যের রাজ্যপাল আনন্দ বোস। আজ সেটাই বিষয় আজকে। আমাদের রাজ্যপাল, শুভেন্দু অধিকারী আর নির্যাতিতদের নিয়ে দুটো কথা।
নির্বাচনে বা ফল বের হওয়ার পরে হিংসা বিনা কারণে হয় না। কোথাও তার উসকানি থাকেই, উসকানি থাকলেই হিংসার আশ্রয় নিতে হবে এমন সরল পাটিগণিতের কথা আমি বলছি না। কিন্তু উসকানিগুলো মাত্রাছাড়া হয় কারণ নির্বাচনের আগে নেতাদের মরিয়া হয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়। তাঁদের স্টেক অনেক বেশি, কেউ না জানলেও শুভেন্দু জানতেন ২৯-৩০-৩১টা আসন এলে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী, বিধান রায়, সিদ্ধার্থ শংকর, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর মমতা বন্দ্যোপাধায়ের পরের নাম, সে কি কম কথা? বাকি অন্য কিছু তো সব্বাই জানেন, কেবল এমপি, এমএলএ হয়েই কত কিছু হয়।
আরও পড়ুন: Aajke | নরেন্দ্র মোদির নির্দেশেই জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন আমাদের চ্যানেল সম্পাদক কৌস্তুভ রায়
দলের বাকি নেতারাও তাই, কেউ আবার এমপি হবেন, কেউ ২০২৬-এ মন্ত্রী। কাজেই তলার কর্মীদের ভোকাল টনিক দিয়েই গেছেন, বাংলায় বার খাইয়েছেন, ক্ষমতায় আসছি তো আমরাই, দেখে নেব। এবার সেই কর্মীরা একটু আগেই দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কীভাবে দেখে নেব তাও জানিয়েছেন। ফল বিজেপির পক্ষে থাকলে সেই কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন, ফল উল্টে গেছে, কাজেই যাঁদের দেখে নেওয়ার কথা বলেছেন, তাঁরাই দেখে নিচ্ছেন, সোজা হিসেব। কিন্তু আবার বলছি, হয়তো নির্দেশ বা হয়তো স্থানীয় নেতারাও বুঝেছেন যে হাতে মারার চেয়ে ভাতে মারা ভালো, তাই দেখে নেওয়ার সেই ছবি সংবাদমাধ্যমে নেই, নেই ওনাদের পোষা সাংবাদিকদের হাতে বা মাইনে করা ইউটিউবারদের কাছে। কেবল কিছু মানুষের উপর আক্রমণের বাইট, আমাকে মেরেছে, আমাদের ঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিথ্যে? হতেই পারে না, কিন্তু বেশিরভাগতাই মিথ্যে কারণ এমন ঘটনা ঘটলে শিরদাঁড়াহীন মাইনে করা সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যমে তেমন ছবি আসত। দু’ একটা ঘটনার ছবি আছে, রাজ্যজুড়ে ঘটনার ছবি নেই। কিন্তু ওদিকে তো সংগঠন সামলাতে হবে, ৩০-এর জায়গাতে ১২, মুখ দেখানো দায়, কাজেই দায়িত্ব নিয়েছেন দুজন। শুভেন্দু অধিকারী, আর আমাদের রাজ্যপাল আনন্দ বোস। মিডিয়া দেখাতে পারছে না তো কী? নির্যাতিত মানুষদের মিছিল হাজির রাজ্যপালের দরজায়, মানে মুরলীধর লেনের জায়গায় রাজভবনে, দুটোই তো আদতে বিজেপির দফতর। তো সেইখানে রাজ্যপাল দেখেশুনে বলেছেন শেষ দেখে ছাড়বেন, শুভেন্দুও বলেছেন শেষ দেখে ছাড়ব। দেখুন, যদি সত্যি অত্যাচার হয়ে থাকে, তার শাস্তি হওয়া উচিত। শুভেন্দু বলেছেন এই এতগুলো মানুষ বলছেন অত্যাচারিত তাঁদের কথা রাজ্যপালকে শোনাব না, বিচার চাইব না? চাইবেন বইকী। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল কে বিচার দেবেন? সুবিচার? আমাদের রাজ্যপাল? এই রাজভবনেই এক মহিলা যাঁর বিরুদ্ধে মলেস্টেশনের অভিযোগ এনেছেন, এই রাজ্যপাল নাকি তাঁকে ডেকে অন্যায় আচরণ করেছেন, সেই মহিলার কিছু সিসিটিভি ফুটেজ সেই কথার সপক্ষে এসেছে, তার ছানবিন চলছে। কেবল তাই নয়, এই রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে উনি দিল্লির হোটেলে একজন নৃত্যশিল্পীর সঙ্গেও একই ব্যবহার করেছেন, দু’ ক্ষেত্রেই ওনার বিরুদ্ধে প্রাইমা ফেসি যে প্রমাণগুলো এসেছে তা ফেলে দেওয়ার নয়। তারপরেও তিনি আসনে গদিয়ান হয়ে বসে রাজ্যের নির্যাতিত মানুষদের সুবিচার দেবেন? কোনও সাধারণ বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ হলে যাঁর পদত্যাগ করে অভিযোগের বিচার দ্রুত করা হোক বলার কথা, তিনি বলছেন রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে ঢুকতে দেবেন না, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল এক রাজ্যপালের ঔদ্ধত্যটা একবার দেখুন, যাঁর বিরুদ্ধে দু’ দু’খানা শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে, তিনি রাজ্যের মানুষের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে ঢুকতে দেবেন না বলে দিলেন। এই কথা তাঁর বলার অধিকার আছে? কোন দলের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর দলের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে সেসব পরে কথা হবে, তিনি কোট আনকোট এমন চরিত্রহীন মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন কি না সেসব পরের কথা, বাংলার মানুষজন এই কথার প্রতিবাদ করবে না? আমাদের রাজ্যের রাজধানীতে ২৭ একর জমিতে ৮৪ হাজার স্কোয়ার ফিটের প্যালেসে বসে নবাব বনে যাওয়া এক আমলা এই কথা বলবেন আর আমরা চুপ করে শুনব? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্যের রাজ্যপাল নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে ঢুকতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন, এটা কি রাজ্যবাসীর অপমান নয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অনেকেই বলেন অ্যাপেন্ডিক্স-এর মতোই এই গভর্নর পদটা থাকা আর না থাকার মধ্যে ফারাক হল এক হাতি পোষার খরচ, থাকলে খরচ হয়, না থাকলে খরচ বাঁচে। পদ্মজা নাইডু এই পদকে সাদা হাতি, হোয়াইট এলিফ্যান্টের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আর সবচেয়ে ভালো কথাটা বলেছিলেন একদা মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী, হ্যাঁ, তখনও চেন্নাই হয়নি, সি এন আন্নাদুরাই বলেছিলেন, আত্তুক্কু থ্যাডিয়াম, নাত্তুক্কু গভর্নারম থেভাইল্লাই। ছাগলের দাড়ি ছাগলের জন্য জরুরি নয়, রাজ্যপাল পদটিও দেশের জন্য জরুরি নয়। দিন পাল্টেছে, আজ ছাগলের চেয়েও কম বুদ্ধির লোকজন আমাদের রাজ্যে বসে আমাদের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে রাজভবনে ঢুকতে দেবেন না বলে জানাচ্ছেন। আমাদের অবস্থা দেখুন, আমরা প্রতিবাদ করছি না, আমরা কি প্রতিবাদ করতে ভুলে গেলাম?