খাস কলকাতায় গতকাল রাতে আবার এক ঝাঁ চকচকে বড়লোকি গাড়ি হু হু করে হাওয়ার বেগে চলছিল। দু’জন পুলিশ হাত দেখিয়ে থামানোর চেষ্টা করেন, গাড়ি তাঁদের ধাক্কা দেয়, তাঁরা দুজনেই আহত হয়েছেন, একজনের হাতে অন্যজনের পায়ে চোট। তারপরে গাড়ি ফুটপাথে উঠে পড়ে এবং সেখানেও জনা দুই মানুষের চোট লেগেছে। এক নিশ্বাসেই বলা যায় যে না, অন্তত প্রাণহানির কোনও ঘটনা নেই এবং এই গাড়িতে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত শাসকদলের কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। যায়নি বলেই যে যাবে না তাও নয়, কিন্তু তাতে খুব ইতর বিশেষ কোনও পার্থক্য হবে? আসলে বিষয়টা হল বিত্তবান, বড়লোকেদের গল্প। একটা দুটো চারটে আটটা গাড়ি আছে, হ্যাঁ, শোভন চ্যাটার্জির গ্যারেজে আমি ৯ খানা গাড়িও দেখেছি, সেসব গাড়ির নামও আমি বলতে পারব না। একইভাবে ওই যে ভোলেবাবা, যাঁর প্রবচনে গিয়ে মারা গেলেন ১২১ জন, ওঁর নাকি ১৯টা গাড়ি আছে, বিদেশি গাড়ি সমেত। আমাদের দক্ষিণের সদগুরু হার্লে ডেভিডসন বাইকে চাপেন, গোটা দশ বারো মারুতি কে ২০ কেনা হয়ে যাবে, রামদেব রেঞ্জ রোভারে চড়েন। বিয়ে এখনও হয়নি শুনলাম কেবল প্রাক বিয়ের অনুষ্ঠানে আম্বানি পুত্র এখনও পর্যন্ত গোটা আষ্টেক পোর্শে ইত্যাদি পেয়েছেন উপহার হিসেবে। লাল জামা পরেছি, লাল পোর্শে, নীল পরেছি তাহলে নীল মার্সিডিজ এরকম আর কী। বাবা রামদেব চড়েন রেঞ্জ রোভার এসইউভি-তে, সে এক ব্যাপার, মোদিজি সবচেয়ে দামি বুলেট প্রুফ মার্সিডিজে। এসব গাড়ির প্রথম কথাটা কী? স্পিড আর যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের সুরক্ষা। মানে হুউউউউস করে গাড়ি চালাতে পারবেন আর দুর্ঘটনা ঘটলেও গাড়ির ভিতরে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের তেমন লাগবে না। এই হল আদত কথা। লাগবে কাদের? পাশাপাশি চলতে থাকা ৪৫ হাজারের বাইক বা ২৩ হাজারের স্কুটি বা নেহাত পথচারী বা রাস্তার ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের, তাঁরা মরবেন, আর সেটাই বিষয় আজকে, আম আদমির ভবিষ্যৎ কি বড়লোকের গাড়ির চাকার তলায় চাপা পড়া?
সলমন খান ইত্যাদি এপিসোড বাদ দিলে ইদানীং কালে আমরা পুনেতে দেখেছিলেম হুউউউউস করে দুরন্ত গতিতে চলা এক পোর্শে গাড়ি, দাম কমবেশি দেড় কোটি টাকা, মেরে ফেলল দুই তরুণ-তরুণীকে, ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি করা শুরু করেছিল। কারা ছিল সেই পোর্শেতে? বার্থডে বয়, মাত্র সেদিনেই সে এই গাড়িটা জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেয়েছে, তার বাবার প্রচুর পয়সা, রিয়েল এস্টেট বিজনেস করেন। তার বয়স? মাত্র ১৬, সে তার বন্ধুদের নিয়ে এক পানশালায় গেল, আকণ্ঠ মদ খেল, খাওয়ার পরে তার মনে হল গাড়ির স্পিডটা দেখা যাক, পোর্শে মানেই তো দুরন্ত গতির জার্মান স্পোর্টস কার, অতএব অ্যাকসিলেটরে চাপ, দুজনের মৃত্যু।
আরও পড়ুন: Aajke | উপাচার্য নিয়োগের রাশ রাজ্যপাল নয়, রইল মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই
তারপরের ঘটনা পুনেতে, বিএমডব্লু নিয়ে আবার সেই আকণ্ঠ মদ খেয়ে শিবসেনা শিন্ডে নেতার ছেলে একটা স্কুটারে ধাক্কা দিল। তার আরোহিণী ছিটকে এসে পড়লেন গাড়ির বনেটে, তিনি কেয়ারও করলেন না, গাড়ি চালালেন এবং মহিলা মারা গেলেন। পরের পর ঘটনা ঘটেই চলেছে, সবকটার বিবরণ প্রায় একই, বড়লোকের বাবার বখাটে ছেলেমেয়েরা দামি, ভীষণ দামি গাড়িতে চড়ে হাওয়া খেতে বের হচ্ছেন মধ্যরাত্রে, এবং তারপর দুর্ঘটনা। দিল্লিতে হয়েছে, আধ কিলোমিটার এক মহিলার শরীরকে রগড়ে ঘষটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মুম্বই-গোয়া রাস্তাতে হয়েছে, পাটনাতে হয়েছে। কলকাতাতেও হয়েছে, আবার হল। মানে পয়সা আছে গাড়ি চালাব, মানুষ মরবে ওটা হল কোল্যাটেরাল ড্যামেজ। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিভিন্ন বড় শহর থেকে বড়লোকের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেরা মাঝরাতে, ভোর রাতে হাওয়া খেতে বের হচ্ছেন আর তাঁদের গাড়ির তলায় চাপা পড়ছে আম জনতা, ম্যাঙ্গো পিপল। এর পিছনে কোথাও অসম্ভব ধনী মানুষজনদের আইন-কানুন ইত্যাদিকে একেবারেই পাত্তা না দেওয়া, মানুষকে মানুষ বলে মনে না করা, এগুলোই কি কাজ করছে না? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
আসলে সমাজের, রাষ্ট্রের এই অসম্ভব বৈষম্য কিছু নতুন ধারণার জন্ম দিচ্ছে, সেই সামন্ততন্ত্র মানে রাজা রাজড়াদের শাসন শেষ হওয়ার পরে দেশে দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল সরকার হওয়ার পরে দেশের নাগরিকের এক সমান অধিকারের ধারণা গড়ে উঠছিল। আর্থিক মাপকাঠি নয়, দেশের একজন নাগরিক হিসেবেই একটা অধিকার বোধ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই সেসব ধারণা মুছে যাচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য এক চূড়ান্ত জায়গাতে পৌঁছেছে, আর সেখান থেকেই গরিব মানুষের মর্যাদা, প্রাণের দাম কমেছে, কমছে। এই যে বড়লোক ধনী মানুষের গাড়ির চাকার তলায় আমজনতা, গরিব মানুষ চাপা পড়ে মারা যাচ্ছেন সেটা কেবল দুর্ঘটনা নয়, তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু। এই বৈষম্য থাকলে এটা থামানো অসম্ভব।