ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুর। সেখানে ৩৮ বছরের দিলীপ সাইনি নামের এক সাংবাদিককে তাঁর বাড়িতে ঢুকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে। কেবল তিনিই নন এই ঘটনায় গুরুতর আহত তাঁর বন্ধুও, ঘটনাচক্রে তিনি আবার বিজেপি সংখ্যালঘু শাখার যুবনেতা শাহিদ খান। তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি। যা জানা গেছে তা হল বুধবার রাতে আচমকাই সাইনির উপরে হামলা হয়। দুষ্কৃতীরা তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়ে, কুপিয়ে খুন করে। চলে গুলিও। তদন্তকারীরা মনে করছেন, আততায়ীদের আগে থেকেই চিনতেন সাংবাদিক। খবর করা নিয়ে বেশ কিছু হুমকি তিনি মাঝেমধ্যেই পেতেন। ওনার বন্ধু শাহিদ জানিয়েছেন, বুধবার রাতে তাঁরা একসঙ্গে বসে সাইনির বাড়িতেই লাঞ্চ করছিলেন। সেই সময়ে দিলীপের ফোন আসে। ফোন ধরার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে কয়েকজন দুষ্কৃতী এবং সাইনির উপরে এলোপাথাড়ি কোপ মারতে শুরু করে। তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, তাঁকেও ছুরি দিয়ে আঘাত করে অভিযুক্তরা। ভয় দেখাতে কয়েক রাউন্ড গুলিও চালায়। গুলির শব্দে প্রতিবেশীরা দৌড়ে আসেন। তাঁরাই রক্তাক্ত অবস্থায় সাংবাদিক ও বিজেপি নেতাকে উদ্ধার করে এবং হাসপাতালে নিয়ে যান। পথেই সাংবাদিকের মৃত্যু হয়। কতজন ছিলেন? স্থানীয় সূত্রে খবর, অন্তত ১৬-১৭ জন মিলে সাইনির বাড়িতে হামলা করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীদের মধ্যে কয়েক জনকে সাইনিরা চিনলেও বাকি কাউকেই চিনতেন না। এবং এই ১৬–১৭ জনের একজনকেও এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। জানা যাচ্ছে যে সরকারি কিছু নথি ফাঁস করে দেওয়ার পরেই এরকম ঘটনা ঘটল। এসব খবর অবশ্য মেন স্ট্রিম মিডিয়াতে নেই, কিন্তু যোগীরাজ্যে খুন হয়েছেন একজন সাংবাদিক এবং সেটাও এই প্রথম নয়, তাই সেটাই বিষয় আজকে বিজেপি জামানায় খবর করলে লাশ পড়ে যাবে।
গত মাত্র দু’ দিনে সীতাপুরে সাংবাদিক হত্যা হয়েছে, সম্ভলে বিজেপি নেতাকে খুন করা হয়েছে, দলের মধ্যের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে নাকি ওই ঘটনা ঘটেছে। লখিমপুর খেরিতে দিনদুপুরে বাজারের মধ্যে একজনকে গুলি করে মারা হয়েছে। কানপুরে ১৭ বছরের এক বালিকাকে হত্যা করা হয়েছে। গোরখপুরে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। অমরোহাতে উত্তরাখণ্ডের এক মহিলাকে খুন করা হয়েছে। হ্যাঁ, এসব ঘটেছে মাত্র দু’ দিনে। আমাদের রাজ্যের টাচ মি নট খোকাবাবু থেকে কমরেড সেলিম কিন্তু চিন্তিত এই কলকাতা নিয়ে। এই সত্যগুলো তুলে ধরা উচিত প্রতিদিন।
আরও পড়ুন: Aajke | পরে গড়বি বাংলা, আগে দলটা সামলা
গত মাত্র দু’ বছরে ১৭ জন কর্মরত সাংবাদিককে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন জাতীয় হিন্দি খবরের কাগজে সাংবাদিক ছিলেন, ৬ জন ইউটিউবার এবং বাকিরা স্থানীয় কাগজের সাংবাদিক। যে শিরদাঁড়াহীন হেলে সাপেরা চোখে চোখ রেখে সাংবাদিকতার কথা বলেন, যে টিআরপি-খোরেরা সন্ধে হলেই কলতলার আসরে খেউড়ে বসেন তাঁরা এই হিসেব মানুষকে বলবেন না। বলবেন না যে আমাদের দেশে সাংবাদিকের বা সংবাদের স্বাধীনতা ১৮০টা দেশের মধ্যে ১৬০-এ দাঁড়িয়ে আছে, হ্যাঁ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের হিসেব এটাই বলছে। এবং এটা নতুন কিছু নয়, ফাসিস্ত শাসনে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে এটাই স্বাভাবিক, হিটলার পাকাপোক্তভাবে গদিতে বসার পরে আর একটাও স্বাধীন সংবাদপত্র ছিল না, মুসোলিনির জমানাতে প্রত্যেক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় লেখাটা বাধ্যতামূলক ছিল যে তাঁরা নির্ভীক নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করেন। মজার কথা হল বড় হরফে হুবহু একই বয়ানের এই কথা ছাপা না থাকলে সম্পাদককে জেলে পাঠানো হত। আমাদের দেশে জরুরি অবস্থার সময়ে সবচেয়ে আগে কোপ পড়েছিল সংবাদপত্রে, কুলদীপ নায়ার থেকে বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষেরা জেলে ছিলেন। মোদিজির জমানাতে ব্যাপারটা আরও সহজ, সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যমের মালিকানাই চলে যাচ্ছে আদানি আম্বানিদের হাতে, তাঁরাই খবর করছেন বা করছেন না, তাঁদের টাকায় শিরদাঁড়াহীন সাংবাদিকেরা রোজ সন্ধেয় সার্কাস দেখাচ্ছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সংবাদপত্রের, টিভি চ্যানেলের মালিকানা চলে যাচ্ছে মোদির বন্ধু আম্বানি আদানিদের হাতে, সাংবাদিকরা হয় জেলে যাচ্ছেন না হলে তাঁদের খুন করা হচ্ছে, দেশের চতুর্থ স্তম্ভ বিপন্ন, এই মুহূর্তে মূল ধারার সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের উপরে কতটা বিশ্বাস বা ভরসা আছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সে সোভিয়েত রাশিয়ার কথা, তখনও কমিউনিস্ট পার্টির শাসন, একদলের শাসন। সংবাদমাধ্যম মানে সরকারি সংবাদ মাধ্যম। সেরকম এক সময়ে নির্বাচনের পরে দেখা গেল স্তালিন তাঁর নির্বাচন এলাকাতে মোট ভোটের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। মানে সেই কথা আবেগতাড়িত হয়ে লেখাও হয়ে গিয়েছিল, তারপরেই বোঝা যায়, এ তো ক্যাচাল হয়ে গেছে, একজন মোট ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট কীভাবে পাবে। তখন সেই বছরে ওই কাগজের ঘোষিত শ্রেষ্ঠ সাংবাদিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আপনিই দেখুন কী করা যায়। তিনি দীর্ঘ লেখা লিখে বুঝিয়েছিলেন যে কমরেড স্তালিনকে মানুষ এতটাই শ্রদ্ধা ভক্তি করে যে পাশের নির্বাচন এলাকা থেকে এসে জোর করে কমরেড স্তালিনকে ভোট দিয়ে গেছে, যার ফলে কমরেড স্তালিন মোট ভোটের চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন। হ্যাঁ, এভাবেই গণতন্ত্রহীনতা প্রথমেই টার্গেট করে মুক্ত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে, এ দেশে ঠিক সেই কাজটাই চলছে।