কারও কারও মনে হয়েছে তৃণমূলে এক বিরাট অন্তর্কলহ চলছিল, সেখানে নবীনদের আশা ভরসা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতা নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই কর্মসমিতির বৈঠক ডেকে দলের সিনিয়রদের হাতেই তুলে দিলেন দলের দায়দায়িত্ব। আসলে মিডিয়ার দ্বন্দ্ব চাই, লড়াই চাই, কহানি চাই, কহানি মে টুইস্ট চাই, কাজেই মমতা-অভিষেক দ্বন্দ্ব, নবীন প্রবীণের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ভাসিয়ে দিয়ে টিআরপি তোলার ধান্দা জারি আছে। একটা কথা বলুন তো, এই তৃণমূল দলে কর্মসমিতি, অমুক কমিটি, তমুক কমিটি ইত্যাদির মানেটা কী? এগুলোর গুরুত্বটা ঠিক কী? সন্তোষমোহন দেবের কন্যা সুস্মিতা দেব বা সেই কবেকার কংগ্রেস নেতা একদা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর বংশধর রাজেশপতি ত্রিপাঠী তৃণমূল দলে কোন বিরাট সিদ্ধান্ত নেবেন বা নিতে পারবেন? ওনাদের কথা বাদই দিন, আরজি কর আন্দোলনের সময়ে দলের বেলাইনে কথা বলা সুখেন্দু শেখর রায় আর নেই ওই কর্মসমিতিতে, খেয়াল করেছেন। বাকি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি ইত্যাদি, সেখানে কার কত গুরুত্ব? তৃণমূল দলনেত্রীর দল, মমতা ব্যানার্জির দল, তাঁর ‘অনুপ্রেরণায়’ দলের খড়কুটোও নড়ে, কমিটি তো তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই চলবে, অন্যরকম যাঁরা আশাও করেন তাঁদের বোধবুদ্ধি নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু সেটাই এখন হট টপিক। সেটা নিয়েই সরগরম বাজার, কত রকমফের বিশ্লেষণ চলছে, কাজেই সেটাই বিষয় আজকে, ২০২৬-এর প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল তৃণমূল।
বলা হল কর্মসমিতির বৈঠক, কিন্তু আসলে নেত্রী ২০২৬-এর সুর বেঁধে দিলেন। সিনিয়রদের পদ দিলেন, জুনিয়রদের কাজ করতে বললেন, যদি ট্রাসফার অফ কমান্ড হয়ও তা তো এখন হবে না, ২০২৬-এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে আসার পরে সেই কমান্ড পোস্টে পরিবর্তন দেখা যাবে। তাহলে গতকাল কালীঘাটে হলটা কী? এক কর্মসমিতির বৈঠক ডাকা হল, যা শেষ কবে ডাকা হয়েছে কার মনে আছে? আমার তো মনে নেই। জনাকয়েক সাংবাদিক দাদাদের জিজ্ঞেস করলাম তাঁদেরও মনে নেই। তো যাই হোক, সুখেন্দু শেখর রায়ের নাম কাটা গেছে বোঝানো হল, আগামী দিনে সংখ্যালঘু মুসলমান ভোট নিয়ে দল ও নেত্রী চিন্তিত, সেখানে কোনও রিস্ক নিতে নারাজ তিনি, কাজেই সে সব জায়গা দেখে নিলেন। জাভেদ খান এলেন, নাদিমুল হক এলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | রাস্তার আন্দোলন কেন ইভিএমে উধাও হল?
এই কমিটিতে পুরনো সব মহারথীদের রাখা হল, তার প্রথম কারণ বিজেপির পোচিং রোখা। বিজেপি নিজেদের শক্তি দিয়ে জিততে না পারলে প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে ভাঙার চেষ্টা করে। কেবল মহারাষ্ট্রের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট হবে। শিবসেনা বা এনসিপিকে না ভাঙলে বিজেপি থাকত কোথায়? সারা দেশের যেখানে ওরা টিকে রয়েছে, গুজরাট, রাজস্থান, এমপি অসম বাদ দিলে সব জায়গাতেই অন্য দলের ভরসায় তারা টিকে আছে। কাজেই বাংলাতে তাদের লক্ষ্য দল ভাঙা, তৃণমূলের মধ্যে অসন্তুষ্ট ওই এক মেজো খোকাকে দিয়ে তাদের হচ্ছে না, আরও চাই। মমতা সেই দিকে নজর দিয়ে ওল্ড গার্ডদের কমিটিতে আনলেন যে কমিটি আসলে তো তাঁরই হাতে, সিনিয়র হোক বা জুনিয়র, দল তো চালাবেন তিনি। কাজেই ওই নবীন প্রবীণের দ্বন্দ্ব, নবীনরা হতাশ, প্রবীণদের যুক্তিতে সিলমোহর ইত্যাদি বকওয়াস। মমতা আসলে ২০২৬-এর জন্য প্রস্তুতি বৈঠক ডেকেছিলেন, আসল হল ওই জেলায় জেলায় কর্মসূচি, প্রচার কর্মসূচি। বিজেপির আড়কাঠিরা ঘুরছে, ২০২৬-এর আগে তাদের পাকা মাথার দরকার, ওই সুখেন্দু শেখর রায়ের মতো গুরুত্বহীন নয়, গুরুত্ব আছে, জন সমর্থন আছে, এমন নেতার দিকে নজর আছে তাদের। মমতা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নন বলেই প্রায় প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যাঁদের দিকে নজর থাকতে পারে, তাঁদেরকে আনলেন জাতীয় কর্মসমিতিতে। এটার সঙ্গে ওই নবীন প্রবীণ বিতর্ক ইত্যাদির কোনও সম্পর্কই নেই। গতকালের বৈঠকে আসল ঘোষণা হল কর্মীদের নিয়ে বসা, তাদেরকে দলের ইতিহাস বলার মধ্য দিয়ে আসলে শীতঘুম কাটিয়ে আগামী লড়াইয়ের জন্য তৈরি থাকতে বলা। মমতা জানেন ১৫ বছরের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি কম নয়, উনি জানেন যে বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের ক্ষোভ আছে, বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ, বাম কংগ্রেস তলানিতে তাই আমরা নিশ্চিত, এরকম একটা আবহ থেকে দলকে বের করে মাঠে নামানোর প্রস্তুতিই ছিল গতকালের বৈঠকের মূল কথা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ রাজ্যে নির্বাচন আর দেড় বছর পরে, অন্যান্য দল যখন প্রায় ছত্রভঙ্গ, তাদের গুছিয়ে ওঠার আগেই নিজের ফৌজকে মাঠে নামানোর কাজ কি শুরু করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? সেই জন্যই কি দলের ইতিহাস জানতে হবে এমন নতুন কর্মসূচি নিয়ে জেলায় জেলায় দলকে নামানোর প্রোগ্রাম ঘোষণা করা হল? নাকি সত্যিই দলে নবীন প্রবীণ দ্বন্দ্ব মেটাতেই এই বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? শুনুন মানুষজন কী বলছেন?
বহুবার বলেছি, কথাটা কে বলেছেন? অনেকে বলেন সুব্রত মুখার্জি, অনেকে বলেন অরুণাভ ঘোষ, তৃণমূল দলে পোস্ট একটাই, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। এখানে যে কোনও ব্যাপারে, সে শৃঙ্খলাই হোক আর সংসদের স্ট্র্যাটেজিই হোক, শেষ কথা কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবার সঙ্গে কথা তিনি বলেন, কিছু মতামতকে গুরুত্বও দেন, কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ওনার, একমাত্র ওনার। এটা কেবল তৃণমূল বলে নয়, সমস্ত আঞ্চলিক দলেই এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। বালাসাহেব ঠাকরে বেঁচে থাকাকালীন দলে দ্বিতীয় কথা বলার মানে হল দল থেকে বের হয়ে যাওয়া, রাজ ঠাকরে তাই নিজেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। করুণানিধি তাঁর দলে শেষ কথা ছিলেন, লালুপ্রসাদ যাদবও তাই, মমতা আলাদা হতে যাবেনই বা কোন দুঃখে। কিন্তু তিনি এক মসৃণ উত্তরাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা কি করেননি? করেছেন, কিন্তু সেটাও তো হবে সেই ২০২৬-এর পরে, যাতে সেই উত্তরাধিকারী পুরো ৫টা বছর হাতে পায়। হ্যাঁ, সেই উত্তরাধিকার এক তরুণের হাতেই বর্তাবে, তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কেউ, এটা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।