কথা দিয়ে এইবার কথা রেখেছিলেন আমাদের রাজ্যের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বলেছিলেন বোমা ফাটবে, বলেছিলেন সপ্তাহের শুরুতেই ফাটবে। ফেটেছিল। এই রাজ্যের ২৫৭৫৩ জনের চাকরি চলে গিয়েছিল। আমরা বলেছিলাম নির্বাচনের বাজারে এই বোমা কারও পশ্চাতদেশে ফাটলে আমরা অবাক হব না। তো সর্বোচ্চ আদালতের রায় বলছে সবার চাকরি খাওয়ার মধ্যে এক অবিচার আছে, যাঁরা তদন্ত করছেন তাঁদেরই বার করতে হবে কারা টাকা দিয়ে অন্যায়ভাবে চাকরি পেয়েছিলেন, কারা সেই চাকরি বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মানে ব্যাক টু দ্য স্কোয়ার, যেখান থেকে এই তদন্ত শুরু হয়েছে সেখানেই আবার পৌঁছে গেলাম আমরা, দাবি অপরাধীদের শাস্তি হোক, একজনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়। আমরা বলেছিলাম এই রায়ের সঙ্গে বহু মানুষের বেঁচে থাকা জড়িত, বলেছিলাম ধরে নেওয়া যাক গড়ে এনাদের, মানে এই শিক্ষক অশিক্ষকদের বাড়িতে ৫ জন করে যিনি রোজগার করেন তাঁর উপরে নির্ভরশীল মানুষ আছেন, যাঁদের খাবার থেকে ওষুধ, স্কুলের ফিজ থেকে বইপত্র, পয়লা বৈশাখ থেকে দুর্গাপুজোর সামান্য আয়োজন ওই মানুষটিই করেন, তাহলে এক্কেবারে সরাসরি সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৬৫তে। সেদিন শুভেন্দু অধিকারীর কথামতোই যাঁদের উপরে বোমা পড়েছিল তাঁরা আতঙ্কে ছিলেন, তাঁরা খানিক স্বস্তি পেলেন। সেদিনের আদালতের রায়ের কপিটা একবার দেখুন, রায় দিতে গিয়ে বিচারকরাই বলেছিলেন, আমাদের কাছে তিনটে পথ খোলা ছিল, ১) যেরকম চলছে সেরকম চলতে দেওয়া। ২) যোগ্য অযোগ্য প্রার্থী বাছা। ৩) পুরো প্যানেল ক্যানসেল করা। যেরকম চলছে সেরকমই চলতে দেওয়ার হলে আদালতের কাজ কী? আদালতে মানুষ তো গেছেনই ওই জন্য যে আদালত বিচার করবে, কিছু হোক অনেক হোক অযোগ্যদের বার করে যোগ্যদের রাখা হবে এবং আরও যারা যোগ্য আছেন তাঁদেরকে আনার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু আদালত সবথেকে সোজা পথটা বেছে নিয়েছিল, না রহেগা বাঁশ, না বজেগি বাঁশুরি, গোটা প্যানেল ক্যানসেল করা হল, ২৫৭৫৩ জনের চাকরি নট করে দিয়েছিলেন বিচারকেরা। শুধু তাই নয় সেই ২০১৬ থেকে যে যা মাইনে পেয়েছে তাও নাকি সুদ সমেত ফেরত দিতে হবে। সেই রায় স্থগিত রাখা হয়েছে। তাই সেটাই আজকের বিষয়, শুভেন্দু বলেছিলেন বোমা ফাটিবে, সে বোমা কোথায় ফাটিল?
নিশ্চিতভাবে দুর্নীতি হয়েছে। এবং শুধু যে দুর্নীতি হয়েছে তাইই নয়, সেই দুর্নীতিকে আড়াল করার, লুকোনোরও চেষ্টাও হয়েছে। সেই চেষ্টায় কারা ছিলেন? খুব স্বাভাবিক যাঁরা সরকারে ছিলেন তাঁরাই, সেই সময়ের শাসকদলের বড় নেতাদের প্রত্যেকের এ ব্যাপারে দায় আছে বইকী। রীতিমতো জেলা ধরে ধরে তালিকা হয়েছে, টাকা কালেকশনের ব্যবস্থা হয়েছে, সেই টাকা এসেছে, বিতরণ হয়েছে। এবং সেই অপরাধকে ঢাকার জন্য নানান তর-তরিকা বার করা হয়েছে, ডকুমেন্টস লোপাট করা হয়েছে, জাল ডকুমেন্টস বানানো হয়েছে, বিভিন্ন কারসাজি হয়েছে। আচ্ছা তখন শুভেন্দু অধিকারী কোথায় ছিলেন? তৃণমূলেই তো? তাঁর পিতাশ্রী? তাঁর ভ্রাতাশ্রীরা? তাঁরাও তো তৃণমূলেই ছিলেন। তাঁর ওই মেদিনীপুরের খাসতালুকে চাকরি দেওয়া হয়নি? কারা দিয়েছিল? কারা টাকা পেয়েছিল?
আজ তিনি মমতা সরকারের মন্ত্রীদেরকে জেলে পোরার কথা বলছেন, তিনিও তো ওই সরকারেরই মন্ত্রী ছিলেন। উনি নিজেকে জেলের বাইরে রাখতেই কি বিজেপিতে গেছেন? আচ্ছা শুভেন্দু চুরিতে শামিল ছিল বলেই বাকি যারা এই দুর্নীতিতে শামিল ছিলেন তাঁদেরকে কেন চিহ্নিত করা হবে না? নাকি তাঁদেরকে আড়াল করতেই কি এরকম এক ব্যবস্থা করা হল। আমার এক পরিচিত ফেসবুকে লিখেছিলেন স্টে অর্ডার কবে আসবে সুপর্ণা? স্টে অর্ডার এসে গেছে, আবার ফিন রামসে, বিচার চলবে চলবে, চলবে। বিচার বিচারের মতো হোক, দোষীদের বার করা হোক, শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু আবার বলব, ন্যায় বিচারের সেই আপ্তবাক্য, ১০০ জন অপরাধী ছাড় পেয়ে যায় যাক, একজনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়, এটাই, ন্যাচরাল জাস্টিস। তৃণমূল তো ননই, ভয়ঙ্কর মমতা বিরোধী নামিদামী লইয়ারদের একজন হলেন অরুণাভ ঘোষ, তিনি সেদিন বলেছিলেন “টুকে পাশ করে জজ হলে তবেই এমন রায় হয়, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি এই ২৬ হাজার শিক্ষক। তিনি ঠিকই বলেছিলেন, গতকালের আদালতের রায় দেড় লক্ষ মানুষের পাশেই দাঁড়িয়েছে, বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে, তাই আমাদের দর্শকদের প্রশ্ন করেছিলাম। শুভেন্দু বলেছিলেন বোমা ফাটবে, এক ধাক্কায় ২৩ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাকরি গিয়েছিল, আদালত সেই আদেশ স্থগিত রেখেছে। এই নির্বাচনের বাজারে বোমাটা তাহলে ফাটল কোথায়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সেদিন এক হিসেব দিয়েছিলাম, সেই অঙ্কতে আসি, ২৫৭৫৩ জনের চাকরি গেলে তা সরাসরি কম করে ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৭৬৫ জনকে পথে বসাবে, আর খুব সাধারণ হিসেবেও এই পথে বসা মানুষগুলোর এক একজন যদি ১০০০ জনকেও চেনেন, সেই হাজার জনের মধ্যে ৫০০ জন তাঁদের ভালবাসেন, সম্পর্ক রাখেন, তাঁদের দুঃখকষ্টে কষ্ট পান, আনন্দে খুশি হন, তাহলে সেদিনের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ৬ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ, তারা কষ্ট পাবে, সমব্যথী হবে। তারা স্বস্তি পেয়েছেন, এই ছ’ কোটির বেশি মানুষ এবারে বোমা ফাটাবে না? ফাটাক, এত জোরে ফাটাক যে তা যেন ৪ জুন শোনা যায়।