দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
আজ সকাল থেকে এই কথাই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে অনন্ত জীবনের হৃদয় স্পন্দন স্পর্শ তো করব, করতে তো চাই, কিন্তু নিজেরাই তো সেই রাস্তা থেকে কত দূরে সরে এসেছি। আজি মর্মর ধ্বনি কে জাগিল রে, পল্লবে পল্লবে, কবে শেষ শুনেছেন মর্মরধ্বনি? আপনার সন্তান, ঝকঝকে উজ্জ্বল, সে, এই কথাটার মানে জানে? মর্মরধ্বনি মানে কী, সে জানে? আমরা কবে গাছ কাটা শুরু করলাম, ক্রমশঃ ইট কাঠ পাথরের এক সভ্যতা তৈরি হল, জীবন থেকে মর্মরধ্বনি উধাও হয়ে গেল, পাতা নেই, নিষ্পত্র হাইরাইজ আকাশে মাথা তোলে। আর ঘাম চপচপে শরীর এই হঠাৎ উত্তাপের কারণ খোঁজে।
সব বন্ধন ছিঁড়ে বের হতে চান? আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। আপনাকে ফ্ল্যাট কিনতে হবে, আপনাকে গাড়ি কিনতে হবে, ছেলে মেয়েকে বলছেন ৫ নয়, ৪ নয়, ৩ নয় ২ ও নয়, এক হতে হবে, প্রথম, যে কোনও মূল্যে প্রথম হতে হবে। আমি আমি আমি এক বিরাট আমি কবে গিলে নিয়েছে আপনাকে, সেই আমি-র পাঠই পড়াচ্ছেন সন্তানদের, রেডিওতে গান বাজছে, আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। ওদিকে বিশ্ব বলতে আপনার সন্তান চেনে আমেরিকা আর গ্রিন কার্ড, গান বেজেই চলে, বেজে যায়।
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন, রবি ঠাকুর বলছেন, মগ্নতা? সময় আছে আপনার, এমনকী সেই লকডাউনেও, পূর্ণিমার চাঁদ দেখে, সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে হাউ বিউটিফুল ইজ দ্য মুন, সেসব দিনের কথা তো মনে আছে। এ বলার মধ্যে মগ্নতা কই?
আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে
যখন বৃষ্টি নামল তিমির নিবিড় রাতে।
দিকে দিকে সঘন গগন মত্ত প্রলাপে প্লাবন-ঢালা শ্রাবণধারাপাতে
সে দিন তিমিরনিবিড় রাতে॥
তিমির নিবিড় রাতে যখন বৃষ্টি নেমেছে তখন দেখেছেন চরাচর ভেসে যায়? দেখেছেন কালো কালো পাতারা ধারাজল শুষে নেয়, সে মগ্নতার সময় আছে? পরের দিন সকালে একটা স্যান্ডুইচ খেয়ে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে ছুটতে হবে, তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ, ভাবুন, একটু সময় তো পেয়েছেন, মগ্ন হওয়ার সময় বার করুন, করোনা থেকে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার থেকে পার্কিনসন্স ডিজিজ এসে তো সেটাই বলছে।
মৃত্যু ভয়ে যখন ঘুম হচ্ছে না, যখন রোজ দেখছেন হিসেব করছেন কত কিলোমিটার দূরে আছে করোনা, তখন ভেবে দেখেছেন, মানুষটা নিজের মেয়েকে দাহ করার পরেই বসে লিখতে পারে,
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব,
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,
যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো—
তিনি আলো দেখছেন আর আমরা সর্ষেফুল, অথচ আজ সকাল থেকেই ধূপধুনো নিয়ে বসেছি সবাই, প্রাণের ঠাকুরের নিষ্প্রাণ পুজোয়, মিথ্যে আরাধনায়। নয়নের দৃষ্টি জুড়ে শুধুই কালো, সে কি এমনি এমনি? এর আস্তিনে ছুরি, ওর হাতে ধরা রামদা, কী ঘৃণা কত ঘৃণা, নামও ধরে না ঘেন্নায়। ওরা আমরা আমরা ওরাতে আটকে আছে, কথায় কথায় মানুষ মানুষকে কী অবলীলায় মেরেই ফেলছে, থেঁতলে থেঁতলে মারা সেই দেহ শেষবারের জন্য কেঁপে কেঁপে উঠছে আর জ্যান্ত শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে উল্লাস।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো ॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো ॥
আরও পড়ুন: নির্বাচনের আগে আসুন একে একে মোদিজির জুমলাগুলো মনে করিয়ে দিই (পর্ব – ১)
কোথায় ভালো? কিসের ভালো? বৈষম্যের পাহাড় গড়ে উঠছে, আলখাল্লা পরা দীর্ঘদেহী মানুষটা দেখছে, সেই তো এই বৈষম্যের কথা সেই কবেই লিখেছিল,
বিশু। পাঁজিতে তো দিনের শেষ লেখে না। একদিনের পর দুদিন, দুদিনের পর তিনদিন; সুড়ঙ্গ কেটেই চলেছি, এক হাতের পর দু হাত, দু হাতের পর তিন হাত। তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু তাল, দু তালের পর তিন তাল। যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে, কোনো অর্থে পৌঁছয় না। তাই ওদের কাছে আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা। ফাগুভাই, তুমি কোন্ সংখ্যা।
ফাগুলাল। পিঠের কাপড়ে দাগা আছে, আমি ৪৭ফ।
বিশু। আমি ৬৯ঙ। গাঁয়ে ছিলুম মানুষ, এখানে হয়েছি দশ-পঁচিশের ছক্। বুকের উপর দিয়ে জুয়োখেলা চলছে।
চন্দ্রা। বেয়াই, ওদের সোনা তো অনেক জমল, আরো কি দরকার।
বিশু। দরকার বলে পদার্থের শেষ আছে। খাওয়ার দরকার আছে, পেট ভরিয়ে তার শেষ পাওয়া যায়; নেশার দরকার নেই, তার শেষও নেই। ঐ সোনার তালগুলো যে মদ, আমাদের যক্ষরাজের নিরেট মদ। বুঝতে পারলে না?
চন্দ্রা। না।
বিশু। মদের পেয়ালা নিয়ে ভুলে যাই ভাগ্যের গণ্ডির মধ্যে আমরা বাঁধা। মনে করি আমাদের অবাধ ছুটি। সোনার তাল হাতে নিয়ে এখানকার কর্তার সেই মোহ লাগে। সে ভাবে সর্বসাধারণের মাটির টান ওতে পৌঁছয় না, অসাধারণের আসমানে ও উড়ছে।
উন্মাদের মতো মানুষ ছুটছে সোনা খুঁজতে, গোল্ড রাশ, আরও চাই আরও, এ উন্মাদযাত্রায় প্রকৃতি যখনই একটা ছোট্ট ঝটকা দিয়েছে, তাতেই বেসামাল আমরা। দিশাহীন উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলতে চলতে হঠাৎ দেখছি আমাদের হাতে কিচ্ছু নেই। ভেবেছিলাম প্রকৃতিকে জয় করেছি আমরা, আমরা শ্রেষ্ঠ জীব এই দুনিয়ায়, নিজেরাই গড়ে নেব নিজেদের ভবিষ্যৎ, জন্ম-মৃত্যুর সব রহস্য জেনে ফেলার ভান করছিলাম আমরা। এখন দেখছি কিছুই জানা হয়নি, একটা এককোষী প্রাণীও নয়, খানিকটা প্রোটিন নিওক্লিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি জৈব কণা, তার ভয়ে সারা বিশ্ব ঘরঅন্তরীণ। ২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছেন এক ওই করোনাতেই আর কতজন মারা যাবে কে জানে! এখন সেই করোনা রুখতে আমরা যে টিকা নিয়েছিলাম তাতেও নাকি বিষ আছে, আমাদের অনেকের শরীরে সেই বিষ আছে। আমাদের সার্টিফিকেটে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছবিও আছে। কোন সভ্যতা তৈরি করছিলাম আমরা? এখনও কি ভেবে দেখার সময় হয়নি? আমাদের নিম্ন মেধা ক্ষুদ্র বুদ্ধি আর পাহাড় প্রমাণ অহংকার নিয়ে কোন তাসের দেশ গড়ছিলাম, চলো নিয়ম মতে বলে চাবুক হাঁকাচ্ছিলাম, ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস-এ ভরা ছিল চারিদিক, হঠাৎ নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে অকোষী এক জৈব কণা ঘাড়ের ওপর বসে পা দোলাচ্ছে, আমরা চিৎকার করেছি হাইড্রোঅক্সিক্লোরকুইন চাই, দেশের চৌকিদার বলেছেন সামাজিক দূরত্ব চাই, সে বলে বন্ধ হোক সব আনাগোনা, আর একজন বলে এখন থেকে মুখে থাকবে মুখোশ।
বুড়ো চন্দ্রটা, নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার,
মৃত্যুদূতের মতো গুঁড়ি মেরে আসছে সে
পৃথিবীর পাঁজরের কাছে।
একদিন দেবে চরম টান তার সাগরে পর্বতে;
মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায়
পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য,
গিলে ফেলবে দিনরাতের জমাখরচ;
মানুষের কীর্তি হারাবে অমরতার ভান,
তার ইতিহাসে লেপে দেবে
অনন্ত রাত্রির কালি।
কবেই তিনি বলে গেছেন, আজও আমরা তা উপলব্ধির মধ্যে আনতে পারলাম না। আজ এতদিন পর রবীন্দ্রসদনের সামনে তিনি একলা দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসছেন, পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।
তবে উঠে এসো– যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান।
বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা– সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট।
হ্যাঁ শুধু পরমায়ু নয়, শুধু বেঁচে থাকা নয়, দাও আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু। সেই কথা যেদিন বুঝব আমরা, বুঝব যে বেচেঁ থাকাই জীবনের মহোত্তম লক্ষ্য নয়, সম্পদ, প্রাসাদ, মেডেল, খেতাব, খ্যাতি নয়, চাই আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু সেদিন রবীন্দ্র সরণিতে অকাল বসন্ত আসবে, নিষ্পত্র কৃষ্ণচূড়া লাল হবে, কেবলমাত্র একটা ফুল ফোটা একটা সুন্দর ভোর একটা রক্ত পলাশের মতো সন্ধে নামা, একটা মুখের হাসি, একজনের স্পর্শে গেয়ে উঠবে মন আমরা মন থেকে বলতে পারব, তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি।
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।