যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন জুলাই অভ্যুত্থানকে গুলিয়ে দিতে একটা প্রচার শুরু হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই এর পিছনে আছে কিছু ধর্মান্ধ মানুষজন, এক চক্রান্তের অঙ্গ হিসেবেই তাঁরা বাংলাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই ছুড়ে ফেলে দিতে চান। এক দীর্ঘ বঞ্চনা আর অত্যাচারের ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন রুখে দাঁড়িয়েছিল, সেই লড়াই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের লড়াই, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, মাতৃভাষার লড়াই। সেই লড়াইয়ের থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। সেদিন যাঁরা এই লড়াইয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন, সেদিন যাঁরা পাক হানাদারদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি, সেদিন যাঁরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণকেন্দ্রে থাকা বাংলার শিক্ষিত সুশীল সমাজের মানুষজনদের, যাঁদেরকে বাড়ি থেকে বার করে খুন করেছিল খান সেনারা। সেই শক্তি এই ডামাডোলের বাজারে আবার মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাঁরাই দেশের ইতিহাস থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সেই মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিতে চাইছেন। তাঁরা ভুলেই গেছেন দেশটা যেমন কারও বাপের নয়, ঠিক তেমনিই দেশের মুক্তিযুদ্ধও কারও বাপের ছিল না। লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশের মানুষ সেদিন হাতে যা পেয়েছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছিল খানসেনাদের বিরুদ্ধে। এ সত্যিই এক ভয়ঙ্কর প্রবণতা।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ধানমন্ডি ৩২, ভাঙন নিয়ে দু’ চার কথা
এবার আসুন দেখে নেওয়া যাক, যে অভ্যুত্থান হল, তার নায়কেরা এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী বলছেন? এঁদের মধ্যে অন্যতম ছাত্রনেতা মাহফুজ আলম, তাঁর ফেসবুকে যা লিখেছেন, আমি আজ সেটা কেবল পড়ে শোনাব। শুনুন মন দিয়ে। তিনি লিখছেন, মুক্তিযুদ্ধ মানে বাংলাদেশ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মানে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পর কী হয়েছে, তা নিয়ে সমালোচনা করুন। ইতিহাস পর্যালোচনা করুন। কোনও সমস্যা নেই। এমনকী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কী কী ঘটেছে, তা নিয়েও তর্ক উঠতে পারে। কিন্তু, সেসবই হবে মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিয়ে। যেমন, শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা নিয়ে আমরা বলব। উনি ফ্যাসিস্ট ছিলেন। কিন্তু, বাংলাদেশের জন্মে অনেক জাতীয় নেতৃত্বের মতো উনার অবদান অনস্বীকার্য। তাই, আমরা ‘৭২ পূর্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিব। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ ফ্যাসিস্ট হতে পারেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনগণের লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের ফ্যাসিস্ট, ইসলামফোবিক ও খুনি হয়ে ওঠার কারণে আপনি খোদ মুক্তিযুদ্ধ বা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্বীকার কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন না। এটা রাষ্ট্রের ভিত্তির সাথে গাদ্দারি! আমরা ভুলে যাই, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ১০ বছরের ইতিহাস ছিল, ফ্যাসিস্ট মুজিববাদী মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতবিরোধী, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার লড়াইয়ের ইতিহাস। কিন্তু, সেজন্য আধিপত্যবাদবিরোধী কোনও মুক্তিযোদ্ধা খোদ মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার দুঃসাহস করেননি। এখানেই পিকিংপন্থীদের সাথে অন্যদের তফাত। এ দেশের মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও বাংলাদেশের জন্মকে স্বীকার করেই এদেশে রাজনীতি করতে হবে। এর কোনও ব্যত্যয় হলে আপনাদের আমরা বাংলাদেশের পক্ষের, গণ অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসাবে মেনে নিব না। আর, এ গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের পরে ফ্যাসিস্ট মুজিববাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, বাকশাল ২.০-এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। এ গণ-অভ্যুত্থানে বরং শেখ পরিবার ও মুজিববাদী প্রকল্প থেকে মুক্তিযুদ্ধ রিক্লেইমড হল। বাংলাদেশপন্থীদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধপন্থী হতে হবে, তবে এটাও সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধ করা অনেকেই ফ্যাসিস্ট ও তাঁবেদার হয়ে উঠেছিলেন। আজ তাঁরা ছাত্র-জনতার কাছে পরাজিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাঁরা যাবেন, তাঁরাও মজলুম বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে অতীতে পরাজিত হয়েছেন, সামনেও পরাজিত হতে বাধ্য। জুলাই সুযোগ নিয়ে এসেছে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। লীগের সাথে বিচারকার্য সম্পন্ন করে রিকন্সাইল করতেও আমরা আগ্রহী ছিলাম। অথচ, দিল্লির আশ্রয়ে থেকে দেশবিরোধী চক্রান্ত করাকেই তারা বেছে নিল। আপনারাও ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন না। জাতিকে বিভাজন থেকে রক্ষা করতে অবশ্যই ‘৭১ ও ‘২৪ কে নিঃশর্ত ও নিরঙ্কুশ মেনে এগুতে হবে।
মাহফুজ আলম যা বলেছেন তা একজন বাংলাদেশি ছাত্র নেতা হিসেবেই বলেছেন, বাংলাদেশের যে মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চান, যাঁরা সেই প্রথম স্বাধীনতার লড়াইকে অস্বীকার করেই আগামী দেশ গড়তে চান, তাঁরা কোনওদিনই সফল হবেন না। আর এক ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম আরও সাফ বলেছেন একাত্তর মীমাংসিত বিষয়। একাত্তরের পক্ষ ও বিপক্ষ নির্মাণের রাজনীতি আমরা চাই না।