যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। ৩২ নম্বর ধানমন্ডি আর নেই বললেই চলে, ধ্বংসস্তূপ যা পড়ে আছে তা সরিয়ে দিলেই ভালো, কারণ ধ্বংসস্তূপ, খণ্ডহর অনেক কথা মনে করিয়ে দেয়। পিতৃপুরুষের বসতবাটি অবহেলায় এক খণ্ডহর হয়ে থাকলেও মনে তো পড়ে ওইখানে ছিল পালকি, ওইখানে গোয়াল আর সেইখানে ধানের গোলা। কত শত স্মৃতি হু হু করে ছুটে আসে মগজের দখল নিতে। তাই ওই ভাঙাচোরা কঙ্কালসার চেহারা পড়ে থাকলে তা চট করে এক গুলিবিদ্ধ দেহকে মনে করিয়ে দেবে, এক মুক্তিযোদ্ধার ক্রমশ অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার দিনগুলোকেও মনে করিয়ে দেবে। সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর ব্যাপার হবে যখন আমরা ধানমন্ডি লেন দিয়ে হাঁটব, কাজেই সমান করে দেওয়া হোক, যেমনটা আমাদের দেশেই এক্কেবারে সমান করে দেওয়া হয়েছিল বাবরি মসজিদ। কোন কালের বাবর, তার কোন সেনাপতি আর সেই মসজিদের তলায় এক কাল্পনিক, এক মিথ চরিত্রের আঁতুড়ঘর, ভেঙে সমান করে দিয়েছিল, সেখানে আর এক উদ্ধত গর্বের সৌধ বানানোও হয়েছে, যা এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের ৪০-৪২ কোটি সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে হিন্দু ধর্মের সুপ্রিমেসির কথা, মনে করিয়ে দেবে সেই ভাঙন কালের কথা। কিন্তু ধানমন্ডির কথায় এই ধান ভানতে বসলাম কেন?
বসলাম কারণ সেই কবে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে। ৭৫ সালে। তারপর ক্ষমতা বদলেছে বার বার, ছত্ররা রাজপথে এসেছেন বার বার। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবেই সেসব খবরের দিকে আমার অন্তত নজর ছিল। বাকসাল নিয়ে তীব্র সমালোচনা অনেকেই করেছেন, আমারও তা অনেকাংসে জায়জ বলেই মনে হয়েছে। মাথায় রাখুন প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশেও এক স্বৈরতন্ত্র খাড়া হচ্ছে, মাথা তুলছে। ভারতবর্ষ সেই স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করেছিল, সে এক নির্মম পরাজয়। তারপরে সেই জরুরি অবস্থা যিনি জারি করেছিলেন, যাঁর নির্দেশে অসংখ্য মানুষকে জেলে পোরা হয়েছিল, যাঁর আমলে বহু মানুষ খুন হয়েছে, যাঁর শাকরেদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এই বাংলার ছাত্র যুবকদের খুন করেছিল, সেই ইন্দিরা গান্ধীকে ৪ অক্টোবর দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করেছিল, ১৬ ঘণ্টা পরে আদালতের আদেশে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল, তাঁর বাড়িঘর ভাঙা হয়নি। যেমন ভাঙা হয়নি এখনও মুম্বইতে কায়েদে আজম জিন্নাহর বাড়ি। কিন্তু ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীর এই স্বৈরতন্ত্রের কথা মুছে যায়নি, সময়ে অসময়ে বার বার ফিরে এসেছে। এটা তো ঘটনাই যে মুজিবর রহমানের বাকসাল ছিল আদতে এক স্বৈরাচারী ধারণা, তার জন্য তাঁর তীব্র সমালোচনা হোক। হাসিনার আমল ছিল এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, অসংখ্য মানুষকে গুমখুন করা হয়েছে, তার বিচার হোক, পালিয়ে গিয়ে বাঁচবে কী করে? এই ইতিহাসের মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু তার জন্য এক আবাস, এক বাড়ি ভেঙে আসলে সেই বাড়ির মালিককে, সেই ধারণাকেই গুরুত্ব দেওয়া হল। এবং এটা এক আইন বিরোধী কাজ। দেশের কার্যনির্বাহী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫: অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সারাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ড শক্তভাবে প্রতিহত করবে। অন্তর্বর্তী সরকার নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রস্তুত। কোনও ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। হ্যাঁ, এক সরকার, আইনের সরকারের এটাই বলা উচিত, তাঁরা সেটা বলেছেন।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | প্রবেশ, অনুপ্রবেশ, ভারত, বাংলাদেশ, আমেরিকা
এবারে আসুন একটু অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে দেখা যাক। কেন সোভিয়েত বিপ্লবের পরেই বংশসুদ্ধ খুন করা হয়েছিল জার এবং তাঁর সন্তানদের? কেন গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছিল বাস্তিল দুর্গ? কেন দুই জার্মানির মধ্যের প্রাচীর ভাঙা এক উৎসব হয়ে উঠেছিল? অত্যাচার সহ্য করারও এক সীমা থাকে বইকী। দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা আর অত্যাচারে জর্জরিত মানুষের বোধ নিখুঁত পাটিগণিত মেনে কাজ করবে এমন তো নয়। মানুষ উত্তাল, রুটি নেই, খাবার নেই, পারির রাস্তায় সেই ক্ষুধার্ত মানুষকে কেক খাবার পরামর্শ যিনি দিয়েছিলেন তাঁকে গিলোটিনের তলায় প্রাণ দিতে হয়েছিল। সারা দেশে খাবার নেই, জারের প্রাসাদে ফরাসি মদের ফোয়ারা, দেশ জুড়ে জারেদের বিরুদ্ধে কথা বললেই জেল, মৃত্যু, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। মানুষ দখল নিল রাষ্ট্রের, সেদিন সেই ক্ষমতা দখলের পরে সেই অত্যাচারিত মানুষেরা ছেড়ে দেবে সেই অত্যাচারীদের? হ্যাঁ সেদিনও ১৩ বছরের আলেক্সেইকে খুন করেছিল বলশেভিকরা, কমিউনিস্টরা। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মধ্যে সেই বিশাল প্রাচীর যা টপকাতে গিয়ে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, ধারেকাছে এলেও গুলি করে মারা হয়েছে, সেই দম্ভের প্রাচীর ভেঙে দেয়নি মানুষ, যান না বার্লিনে, সেই প্রাচীরের ভাঙা টুকরো এখনও বিক্রি হয় স্যুভেনির হিসেবেই। কাজেই ইতিহাসে ভাঙাও আছে, গড়াও আছে, ইতিহাসে অন্যায় আছে, ন্যায়ও আছে, প্রতিশোধ আছে, মায়া মমতার কাহিনিও আছে। এক কোপে হেরে যাওয়া রাজার মুণ্ড কেটে নেওয়ার গল্পও আছে আবার আলেকজান্ডার পুরুর মতো বীরকে ক্ষমা করেছিলেন, সেটাও ইতিহাসেই আছে। ৩২ নম্বর ধানমন্ডি বহুযুগ পরে হয়তো এক অবহেলা অবচ্ছেদ্দার মধ্যেই পড়ে থাকত, এই ভাঙনের পরে তা এক ইতিহাস, আর আপনি পক্ষেই থাকুন, বিপক্ষেই থাকুন, ইতিহাসকে মোছা যায় না।