যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। শুনেছেন তো গানটা? ২০২২-এ বিএনপির মঞ্চে গাওয়া গান, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মুখে মুখে ঘুরে ঢাকা থেকে কলকাতায় (Kolkata) এসে রাজপথে গাওয়া হয়েছিল, এই গান। ও দেশটা তোমার বাপের নাকি করছ ছলাকলা / কিছু বললেই ধরছ চেপে জনগণের গলা / মনে রেখো যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি / দেশ দেশ দেশ বাঁচাতে রক্ত দিতে রাজি আছি / ভয় দেখিয়ে হবে না রে কাম/ ও বাচারাম ভয় দেখিয়ে হবে নারে কাম। হ্যাঁ, দেশ কারও বাপের নয়, শেখ হাসিনার (Sheikh Hasina) নয়, খালেদা জিয়ার (Khaleda Zia) নয়, ইউনুস সাহেবেরও নয়, ইথুন বাবুরও নয়। ধরুন দেশ কারে কয়? এই প্রশ্নের কি সহজ কোনও উত্তর আছে? ১৯৪৭-এর আগে ঢাকা কিংবা কলকাতার বাসিন্দারা কোন দেশের মানুষ ছিলেন? ভারত? ধুস, ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রই তো আঁকা হল ওই ১৯৪৭-এ।
শোনেননি বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব ছিলেন সিরাজ উদ দৌলা। তার মানে বাংলা এক আলাদা অঞ্চল, বিহার এবং ওড়িশা আলাদা আলাদা অঞ্চল। ওদিকে জাহাপনা আওরঙ্গজেব, জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়ে দিলেন দাক্ষিণাত্য দখল করার জন্য, সে ইচ্ছেও মেটেনি। কোন আক্কেলে তাঁকে ভারতের সম্রাট বলা হবে? পাকিস্তান নিয়েও একই কথা, ইংরেজরা আসার পরে ভারতের যে পলিটিক্যাল ম্যাপ তৈরি হল তাতে পাকিস্তানও ছিল, আফগানিস্তান, বার্মাও ছিল, নেপাল, ভুটানও ছিল। কাজেই মোদিজি যখন বলেন ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে তখন তা যে এক নৌটঙ্কি তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ধরুন আমেরিকা। সে দেশ কাদের ছিল? ইন্ডিয়া খুঁজতে গিয়ে নাবিকের দল চলে গেল সে দেশে, আমেরিগো ভেসপুচি নেমেই বুঝতে পেরেছিলেন কেলো হয়ে গেছে, এলাকার সেই লাল তামাটে লোকজনদের রেড ইন্ডিয়ান বলা শুরু হল, সাহেবদের জাহাজে চড়ে এল ক্রীতদাস, কালো মানুষ, আর রেড ইন্ডিয়ানদের খেদানো শুরু হলো। কারা খেদালেন? অশিক্ষিত কিছু বর্বর, যাঁরা তাঁদের দেশে যথেষ্ট রোজগার করতে পারছিলেন না, বিভিন্ন বেআইনি কাজকর্মের জন্য সমাজে দুর্নাম, সেই সব লুম্পেন বাহিনীকে নিয়ে এসে আমেরিকা দখল করল এই ট্রাম্প (Donald Trump) সাহেবের পূর্বসূরিরা। লাল মানুষদের উচ্ছেদ করে, কালো মানুষের শ্রমে গড়ে উঠল আমেরিকা। আজ তাঁরা, হ্যাঁ সেই লুঠেরারদের বংশধর ট্রাম্প সাহেব অনুপ্রবেশ নিয়ে কথা বলছেন। আরে দেশ তো হয় মানুষের, দেশ তো ভাষার, সংস্কৃতির, যে যেখানে অনায়াসে বাস করে, যে যেখানে নিজের পেট ভরাতে পারে, যে যেখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, সে সেতাকেই তার দেশ মনে করেছে। রাষ্ট্র তো এই সেদিনকার ধারণা।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | টলিউড ডিরেক্টর, টলিউড শ্রমিক
আবার অন্যদিকে দেশ মানে কেবল রাষ্ট্র, দেশ মানে এক সংবিধান, এক আইন, দেশ মানে সেই দেশের এক খণ্ডকাল, এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এক সীমানা ঘেরা ভূখণ্ড। দেশ মানে আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড। তাই খালার বাড়িতে বড়ি বেগুন দিয়ে আড় মাছের ঝোল খেয়ে যে যুবক শুয়ে আছে, সে এই দেশে বিদেশি, যে চট্টগ্রামের সূর্য সেন দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁর বংশধরেরা নিখাদ বিদেশি। যে ছেলেটা চাকরি না পেয়ে, চাকরির জন্য, একটু ভালো করে বাঁচার জন্য টেক্সাস বা আলাবামাতে পেট্রল পাম্পে কাজ করছিল, তার হাতে হাতকড়া, যুদ্ধ বিমানে চাপিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে, দেশে। দেশ এখন মানুষের নয়, নিয়মের, আইনের। দেশ এখন সেই উন্মাদদের অট্টহাসি যারা আগেভাগে দখল নিয়েছে ভূখণ্ডের, পরে যারা এসেছে, আসছে তারা অনুপ্রবেশকারী। মনে পড়ছে জন লেননের ইমাজিন,
ধরে নাও কোনও স্বর্গ নেই
ধরে নাও। ধরে নিতে তো দোষ নেই,
কোনও নরক নেই মাটির তলায়
বসে আছো নীল আকাশ মাথায়
ধরে নাও মানুষ, শুধু আজকের জন্য বাঁচছে।
ধরে নাও এ পৃথিবীতে মানচিত্র মুছে গেছে।
জানি এটা শক্ত, তবু নাও না ধরে,
তোমায় কাউকে মারতে হবে না, বা খামোখা যেতে হবে না মরে
আর ধরে নাও ধর্ম টর্ম উবে গেছে
মানুষ মহা আনন্দে, শান্তিতে বেঁচে আছে
তুমি বলতেই পারো আমি বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখি, তাই না?
কিন্তু এ স্বপ্ন তো শুধু একলা আমিই দেখি না
আমি নিশ্চিত তুমিও একদিন এই স্বপ্নই দেখবে
মিলিয়ে নিও, এ পৃথিবীর কেউ বাদ যাবে না
ধরে নাও আমাদের কারোর নিজের কোনও সম্পত্তি নেই
জানি আমি, কষ্ট হবে ভাবতেই
কারোর লোভ নেই, কেউ ক্ষুধার্ত নয়
বসুধৈব কুটুম্বকম, এ পৃথিবীময়
ধরে নাও না, সোনা,একবারের জন্য
আমাদের সব্বার এই ক্ষেত খামার পাহাড় নদী অরণ্য
তুমি বলতেই পারো আমি বড্ড বেশি স্বপ্ন দেখি, তাই না?
কিন্তু এ স্বপ্ন তো শুধু একলা আমিই দেখি না
আমি নিশ্চিত তুমিও একদিন এই স্বপ্নই দেখবে
মিলিয়ে নিও, এ পৃথিবীর কেউ বাদ যাবে না
যখনই অনুপ্রবেশের কথা বলবে মোদি, ট্রাম্প বা অন্য কোনও রাষ্ট্র প্রধান, তখন মাথায় রাখবেন, দেশ বা রাষ্ট্র এক বানানো ব্যাপার, তা ভাঙাও যায়, গড়াও যায়, আবার ভাঙা যায়, আবার গড়া যায়। টিকে থাকে সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি।
অন্য খবর দেখুন