যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। দেশ দুনিয়ার নানান পদমর্যাদার লোকজন তো আপনারা দেখেছেন, মন্ত্রী, সান্ত্রী, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, ব্যবসায়ী থেকে গোপাল ভাঁড়, সমাজ আর আর রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই লোকজনেরা যখন কোথাও যান, কোনও সভায় বৈঠকে বসেন তখন তাঁদের সামনে ফলাও করে লেখা থাকে কে এই হনু? উনি হলেন রাষ্ট্রপ্রধান, উনি হলেন অমুক কোম্পানির তমুক ইত্যাদি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে? এমনকী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারেও লেখা থাকে না যে তিনি প্রধানমন্ত্রী। কর্মক্ষেত্রে তেমনটা লেখা থাকে একজনেরই, তিনি হলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, ফিল্ম ডিরেক্টর। যদি কেউ না চেনে? তাই চেয়ারের পেছনে লেখা থাকে যে ইনি যিনি বসে আছেন তিনি হলেন পরিচালক, এক মস্ত ব্যাপার। আর হবেন নাই বা কেন? ছবি হিট হলে জয়জয়কার তো ওনার নামেই দেওয়া হয়, খারাপ হলে ফালতু ডিরেক্টর। শাহরুখ, সলমন বা এ পাড়াতে দেব, জিৎ এর কিছু ছবি বাদ দিলে ছবির কৃতিত্ব ওই পরিচালকের আর ছবি ফ্লপ করলে যে কোনও ছবিরই দায় হল ওই পরিচালকের। অবশ্য বাংলার পরিচালকদের, মানে টলিউডের ফিল্ম ডিরেক্টরদেরকে দেশের অন্যান্য প্রান্তের বা বিদেশের সঙ্গে কখনও গুলিয়ে ফেলবেন না কারণ টলিউডের ডিরেক্টরেরা প্রোডিউসার জোগাড় করেন, সে এক বিচিত্র কেরামতির ব্যাপার। তারপর যাও বা হল তারপর কাস্টিং নিয়ে নাকানি চোবানি, প্রোডিউসার বড় কাস্ট চায়, বড় কাস্ট বেশি টাকা চায়, ওদিকে কাশ্মীরের টেররিস্টদের গল্প, শুটিং হবে ইলামবাজার যাওয়ার পথে জঙ্গলে, টেররিস্টরা পার্ক স্ট্রিটের বারে বাউন্সার, লুচি আলুর দম খেয়ে কাঠের একে ফর্টি সেভেন নিয়ে নামবেন। মানে বাজেট যা ছিল সব শেষ, বাকি যা পড়ে থাকে তা যায় টলিউড শ্রমিকদের কাছে।
কারা এঁরা? এঁরা হলেন ক্যামেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট, মেক আপ অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাসিস্টান্ট আর্ট ডিরেক্টর, ক্রেন পুলার, ট্রলি পুলার, প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট, টি বয় ইত্যাকার মানুষজন। এক বড় বাজেটের টলিউড ছবির স্টার কাস্ট খেয়ে যায় ৩৫ শতাংশ, ইকুইপমেন্ট আর পোস্ট প্রোডাকশন ইত্যাদিতে ২০ শতাংশ, ছোট কাস্ট, রোজকার খরচ, গাড়ি ইত্যাদিতে ২৫ শতাংশ আর ১৫ শতাংশ ওই বিশাল লোকজন। যাঁদের ছবি রিলিজ করার সময়ে বলা হয়, এঁরা না হলে ছবিই হবে না, এঁদের ছাড়া ছবিই হত না, সেই টলিউড কর্মীদের জন্য খরচ হয়। হ্যাঁ, এই যাঁরা পথের পাঁচালি থেকে সৃজিত মুখার্জির সত্যি বলতে কিছু নেই এর প্রতিটা দৃশ্যের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছেন অথচ যাঁদের দেখা যায় না, যাঁদের নাম আমরা মরে গেলে জানতে পারি। বারবার কেন এই শ্রমিক আর ওই পরিচালকদের মধ্যে বিরোধ হয়? বারবার কেন এই দুই শ্রেণির বিরোধে কাজ বন্ধ হয়? আজ নয়, এ গল্প বহুকালের। এ কি আসলে মহাকালের রথের দড়ি যাদের হাতে আছে তাদের সঙ্গে মহাকালের এক শেষ হবে না এমন দ্বন্দ্ব? এটা ঘটনা যে বাংলা সিনেমার যাকে বলে স্বর্ণযুগ তখনও এই রথের রশি যাঁরা টানতেন, তাঁদের অর্থনৈতিক হাল দিন আনি দিন খাই-এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না, কাজ করলে টাকা, কাজ থাকবে কি না সেই ভেবেই দিন কাটত, অসুখ বিসুখ হলে কাজও নেই, টাকাও নেই। সেই তাঁরাই এই চাপে পড়েই এক জায়গায় এসেছেন, ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে, গত ১০-১৫ বছরে সেই ইউনিয়নের চেহারা ফিরেছে, তাঁদের মেডিক্যাল ইনসিওর্যান্স হয়েছে, তাঁদের কোওপারেটিভ লোন দেওয়া হচ্ছে, কাজের খানিক গ্যারান্টি এসেছে। কিন্তু বিরোধ? বেড়েই চলেছে, কনফ্লিক্ট শেষ আর হয় না।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | তসলিমা নাসরিন, মিথ্যে বলেই চলেছেন কেন?
এবার আসুন অন্যদিক থেকেও দেখা যাক। বছরে বাংলা ছবি যতগুলো হয় তার ১৫ শতাংশ টাকা ফেরত পায় না, একসময় হল থেকেই টাকা আসতো, গান বেচে লাভ। এখন হল থেকে খুব কম ছবির প্রচারের খরচের বেশি কিছু হাতে আসে। এরপর টিভি চ্যানেল আর ওটিটি ছিল ভরসা। এখন চ্যানেলও সেই ভরসা দিচ্ছে না। হাতে গোনা কিছু সুপার স্টারদের ছবি ছাড়া টাকা ফেরত আসবে প্রযোজকের হাতে, তেমনটা কেউ ভাবেই না। কাজেই হু হু করে ছবির সংখ্যা কমছে, বাড়ছে সেই সব পরিচালকের সংখ্যা যাঁরা কোনওরকম নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ছবি বানাচ্ছেন। শর্ট ফিল্ম এমনকী ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টার ফিল্ম, সে সব ছবি বিদেশেও যাচ্ছে পুরস্কারও পাচ্ছে, কিন্তু টলিউড শ্রমিকদের কাজ নেই, এবারে তাই নতুন করে টিভি সিরিয়াল, ওটিটি ফিল্ম ডিরেক্টরদের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে। আজ টলিউডের অবস্থা রবিঠাকুরের কবিতার মতন,
রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব–হাসে অন্তর্যামী।
সমস্যা হল এই অন্তর্যামী কিন্তু না ওই পরিচালক, প্রযোজক না ওই টালিগঞ্জের ক্যামেরার পিছনের মানুষজন যাঁদের আমরা ক্রিউ মেম্বার বলেই চিনি। না, এঁরা কেউ অন্তর্যামী নন, আমার ধারণা অন্তর্যামী মুম্বাই বা চেন্নাইতে বসে আছেন, হাসছেন। শুনলাম হোলিতে নাকি তিন তিনখানা হিন্দি ছবি আসছে, সব হল নাকি তাদের। হ্যাঁ, এই বিরোধে তাঁদের লাভ কিন্তু সবথেকে বেশি।