যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। পৃথিবীতে কিছু মানুষ এমনও আছেন যাঁরা কেবল বিতর্কিত কথা বলা বা দু’ চার লাইন বিতর্কিত লেখার মধ্যে দিয়েই নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখেন। তাঁরা আসলে ভেসে থাকতে চান। নদীতে সমুদ্রে জীবজন্তুর মৃতদেহ যেমন ভেসে থাকে, কাছে এলেই তাদের দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায় খানিকটা তেমন আর কী। এই গোত্রের কয়েকজন হলেন রমেশ বিধুড়ি, স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা, পুনম পাণ্ডে, মদন মিত্র বা তসলিমা নাসরিন। নিয়ম করে কিছু একটা বলেন, তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে, জানা যায় তিনি বেঁচে আছেন। আচ্ছা শেষ কবে তসলিমা নাসরিনের কোনও উপন্যাস আপনি পড়েছেন? তাঁর লেখা কোন কবিতাটা আপনার ভালো লেগেছে? স্মরণেও আনতে পারবেন না। কিন্তু তাঁকে ভুলেও যাননি কারণ ওই যে, ভেসে থাকার কায়দাটা তিনি রপ্ত করেছেন। ডলার, ইউরোর রোজগার টাকায় খরচ করে বাঁচার আনন্দই আলাদা, সম্ভবত সেই আনন্দেই তিনি বাঁচেন আর মাঝেমধ্যে দু’ চার কথা লিখে আমি আছি জানান দেন।
তো সেই তিনি সেদিন লিখলেন যে হিন্দুদের মাথায় ধর্ম ঢুকলে সে সন্ন্যাসী হয় আর মুসলমানদের মাথায় ঢুকলে সে সন্ত্রাসী হয়। কী দেখে লিখলেন? কোন তথ্য আছে আপনার কাছে? বিশ্বের সমস্ত ধার্মিক হিন্দু সন্ন্যাসী? বিশ্বের প্রত্যেক ধার্মিক মুসলমান সন্ত্রাসী? এরকম এক সিদ্ধান্তে আসার আগে কোন কোন তথ্য জেনেছেন? যে হিন্দু সন্ত্রাসী অনায়াসে গৌরী লঙ্কেশকে খুন করেছিল, সে সন্ন্যাসী ছিল? একজন লেখিকা, সাংবাদিক, সমাজকর্মীকে একলা পিছন থেকে গুলি করে মেরেছিল এক সন্ন্যাসী? নাকি তসলিমা নাসরিন গৌরী লঙ্কেশের নামই শোনেননি। কালবুর্গি, দাভোলকর, পানসারেকে কোন হিন্দু সন্ন্যাসী খুন করেছিল? কোন হিন্দু সন্ন্যাসীর দল সেই খুনিদের আজও শাস্তি না দিয়ে সমাজে অনায়াসে ঘুরে ফিরে বেড়ানোর অধিকার দিয়েছে? কোন হিন্দু সন্ন্যাসীর রথযাত্রার পথে শ’ তিনেক মানুষকে খুন করা হয়েছিল? হাজার হাজার ঘরবাড়িও জ্বালানো হয়েছিল? কোন হিন্দু সন্ন্যাসীর দল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে এক ঐতিহাসিক সৌধকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে চুরমার করেছিল? এই সমস্ত লোকজন ভারতের হিন্দু সন্ত্রাসী নন? তাহলে সন্ত্রাস কাকে বলে তসলিমা?
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | প্রেম করবেন? বিজেপির পারমিশন চাই
এবারে আসুন ওনার কথার দ্বিতীয় ভাগ নিয়ে আলোচনা করা যাক। তানসেন থেকে বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব, পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ পড়তেন, সবকটা রোজা রাখতেন, ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। এনারা সন্ত্রাসী ছিলেন? শের শাহ সূরি, যুদ্ধ বন্ধ রেখে নামাজ আদায় করতেন, সন্ত্রাসী ছিলেন? উলুক বেগ তাঁর শাসনকালে ৪০টার বেশি মাদ্রাসা বানিয়েছিলেন, যার প্রতিটার সঙ্গে ছিল মসজিদ, ইবাদতখানা। পৃথিবীর প্রথম ম্যাপ তৈরি করেছিলেন সেই উলুক বেগ, বিশাল সূর্য ঘড়ি তৈরি করেছিলেন উলুক বেগ, তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন? গালিব না টুপি ছেড়েছিলেন না নুর, সমস্ত সুন্দরের মধ্যেই তিনি আল্লাহকে দেখতেন, তিনিও সন্ত্রাসী? সন্ত্রাসীর কোনও ধর্ম হয়? কোন ধর্মে মানুষ খুন করার নির্দেশ আছে? কোন ধর্ম শান্তির বিরুদ্ধে কথা বলে?
আবার অন্যভাবে বললে কোন ধর্মের মানুষ সন্ত্রাসী নন? এমন কোনও ধর্ম আছে কি যে ধর্মের মানুষের একজনও সন্ত্রাসী নন? তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী? সন্ত্রাস এক অস্ত্র, যা সব ধর্মের মানুষই ব্যবহার করে, কিন্তু প্রশ্ন হল কোনও ধর্ম কি মানুষকে সন্ত্রাসী করে তোলে? সন্ত্রাস দাঙ্গা সাম্প্রদায়িকতা আসলে ধর্মের বিষয় নয়, এগুলো ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র, আমরা জানি, তসলিমা নাসরিনও জানেন। কিন্তু এখন দেশের হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায়, তাঁদের খুশি করে তিনি তাঁর ভিসার মেয়াদকে চিরস্থায়ী করতে চান, কোনওক্রমে একটা নাগরিকত্ব চান, তো সেটাই ভিক্ষা করুন, সেটার জন্য এই মিথ্যাচারের প্রয়োজন কী? এবার এই বিতর্কিত কথা কেবল ভেসে থাকার জন্যই উনি বলেছেন এমন নয়, উনি এই কথাগুলো বলেছেন অমিত শাহ বা মোদিজিকে খুশি করতে, এদেশে আশ্রয় পাওয়ার জন্য তেল দিচ্ছেন তিনি, একবার স্থায়ী সমাধান পেয়ে গেলেই আবার অন্য সুর ধরবেন না এমন গ্যারান্টিও নেই, এবং সেটা দেশের স্বরাষ্ট্র দফতরও জানে। কাজেই ওনাকে আপাতত ঝুলিয়েই রেখে দেবে ভারত সরকার, সে তিনি হিন্দুদের সন্ন্যাসীই বলুন বা মুসলমানদের সন্ত্রাসী।