শুরু করছি কলকাতা টিভির নতুন অনুষ্ঠান সাদা-কালো। যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। পৃথিবীর সব্বাই যদি এক মতের হত, সব্বাই একই সুরে কথা বলত, কী বোরিং হত সেই পৃথিবী, কাজেই তর্ক-বিতর্কে সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে নানান রং ভেসে উঠুক। মাও সেতুং বলেছিলেন, শত ফুল বিকশিত হোক, যত আগাছা নির্মূল হোক। তো ভনিতা ছেড়ে শুরু করি আজকের বিষয়। ইভিএম-এ ঘাপলা করে জিতেই চলেছে বিজেপি। ইভিএম হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। আচ্ছা ইলেকট্রনিক্স বললেই প্রথম যে নামটা ভেসে আসে আমাদের মাথায় সেটা তো জাপান? কেউ কেউ বলবেন চীন। এখন চীন নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই কারণ চীনে আমাদের বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো প্রকাশ্যে নির্বাচন ইত্যাদি হয় না। ওনাদের পার্টি কংগ্রেসে যে নির্বাচন হয়, শুনেছি তা নাকি হাত তুলে। মানেটা হল, ক্ষমতায় যিনি বসে আছেন তিনি মঞ্চ আলো করে বসে থাকবেন, আপনাকে বলতে হবে যে না আমি আপনাকে ভোট দেব না। সেলিম সাহেবদের দলেও এমনটাই চালু আছে।
সেসব বাদ দিলাম, কিন্তু জাপান, ইলেকট্রনিক্সের বাজারে বিরাট নাম। আচ্ছা সে দেশে ইভিএম-এ ভোট হয় না কেন? সে দেশে সাধারণ নির্বাচন ব্যালটে হয় কেন? কারণ সে দেশের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ইট ক্যান বি ম্যানিপুলেটেড, মানে ইভিএম-এর ভোটে ঘাপলা করা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়াতে? না, সেখানেও ব্যালটে। কানাডাতে? না, সেখানেও ব্যালটে। ফ্রান্সে ব্যালটে ভোট হয় কিন্তু দেশের বাইরে থাকা কমসংখ্যক ভোটাররা ইভিএমে দেন। জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, ইউকে-তে ব্যালটেই ভোট হয়। আমেরিকাতে ইভিএমে ভোট হয় কিন্তু তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে। সে থাক। আমার যেটা বলার সেটা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ জায়গাতেই ইভিএম নয়, ব্যালটেই ভোট হয়। কেন? জাপানের মতো দেশ একটা ফুল প্রুফ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তৈরি করতে পারল না? আর একটা দেশ যার নাম এখন ইলেকট্রনিক্সের বাজারে হু হু করে উঠে আসছে, দক্ষিণ কোরিয়া, সেখানেও কিন্তু ভোট হয় ব্যালটে। মানে পৃথিবীর উন্নত এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা ছাড়া বাকিদের প্রায় সবাই ব্যালটে ভোট করায়। প্রশ্ন হল কেন? কারণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বাইরে থেকে কন্ট্রোল করা যায়, ঘাপলা করা যায়, জনমতকে উপেক্ষা করে অন্য রেজাল্ট এনে দেওয়া যায়। আর সেই কারণেই তারা এই হাই ফাই ইলেক্ট্রনিকস সভ্যতার মধ্যেও ব্যালটেই ভোট করায়।
আমাদের এখানে বারবার ভোটের ফলাফল প্রশ্নে মুখে পড়েছে। ধরুন লোকসভার ভোট, মাত্র ক’মাস আগে, মহারাষ্ট্রে ধুয়ে গেল বিজেপি, শিন্ডে, অজিত পওয়ার জোট। চারমাস পরেই কোন ম্যাজিকে তারা মহাবিকাশ আগাড়িকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েই ক্ষমতায় এল? মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার মর্কদ্বাদি গ্রামের কিছু মানুষজন এই রেজাল্ট দেখার পরে একটা ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তাদের দাবি ইভিএম-এ ঘাপলা হয়েছে, তাই ব্যালটে ভোট। সরকার বলতেই পারত, করো, কারণ ওই ভোটে তো ফলাফল বদলাত না। কিন্তু সরকার গ্রামে কারফিউ জারি করে, পুলিশ প্রহরায় সেই ব্যালট ভোট বানচাল করেছে। কেন রে ভাই? ডাল মে কুছ কালা থা কেয়া? হ্যাঁ, মানুষের মনে হতেই পারে যে আছে, কিছু গন্ডগোল আছে। বারবার ক্রুসিয়াল নির্বাচনে বিজেপির জিতে আসা সত্যিই সন্দেহজনক, তাই প্রশ্ন উঠছে, ইভিএম-এ ঘাপলা হয়েছে? ইভিএম-এ ঘাপলা করা যায়? ওই একই প্রশ্নে মুখে দাঁড়িয়েই কোরিয়া বা জাপান বা কানাডা বা ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়াতে ব্যালটেই ভোট হয়, ইভিএম-এ নয়।
আরও পড়ুন: মমতা-বিজেপি সেটিং তত্ত্বে কতটা যুক্তি আছে? কতটা আবেগ?
এবার আসুন অন্যদিকের যুক্তিগুলোও জানা যাক, কারণ একদিকে যুক্তি হল অর্ধেক জ্ঞান, দু’দিকের কথা শুনে নিজের মতামত তৈরি করুন। অন্যদিকের যুক্তি রাহুল গান্ধী বা মমতা ব্যানার্জি কী দিয়েছেন সে কথা পরে আসছি। সদ্য ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটের নেতা ওমর আবদুল্লা বলেছেন যে খামোখা হেরে গেলেই ইভিএমকে দোষ দেবেন না, যখন জিতে যাচ্ছেন সেটা আপনাদের জয়, হেরে গেলেই সেটা ইভিএম-এর দোষ, ইভিএম এর ঘাপলা? পয়েন্ট হ্যাজ, যুক্তি তো আছে। কিছুদিন আগেই কংগ্রেস কর্নাটক জিতেছে, তেলঙ্গানা জিতেছে, তৃণমূল দল বাংলাতে সেই ২০১৯-এ একটা ধাক্কা খেয়েছিল, তার আগে এবং তারপরে তাদের ধারাবাহিক জয়ের কথা আমরা জানি। গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলাতে বিজেপিকে ১২টাতে আটকে দিয়েছে তৃণমূল, মহারাষ্ট্রে বা উত্তরপ্রদেশে দারুণ রেজাল্ট করেছেন বিরোধীরা। কাজেই এটা তো একতরফা জয় নয়।
বিজেপির কাছে কর্নাটক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ কর্নাটক জিতলে তাদের দখিন দুয়ার খুলে যেত, তারা দাক্ষিণাত্যে প্রথমবার নির্বাচনে জিতে নিজেদের সরকার তৈরি করতে পারতেন। যদি ইভিএম-এ ঘাপলা করেই তারা জেতে তাহলে কর্নাটক কংগ্রেসের হাতে তুলে দিল কেন? বা ধরুন বাংলা, কাঁথির খোকাবাবু থেকে টলিউডের পাল্টিদাদা রুদ্রনীল জান লড়িয়ে দিয়ে ৭৭? খেল খতম? ২০২১-এর কথা বলছি। ইভিএম হাতে থাকলে তো এতদিনে রুদ্রনীল আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রী হত তাই না? হল না কেন? ইভিএম-এ গন্ডগোল করা যায় কি না সে এক প্রশ্ন, বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন মতামত আছে, আছে বলেই কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া যেমন ব্যালটে ভোট করে ঠিক তেমনিই আমেরিকা ইভিএম-এ ভোট করায়। কিন্তু আমাদের দেশে বিজেপি ইভিএম-এ ঘাপলা করেই জিতছে, এটা খুব জোলো কথাবার্তা, হেরোদের আক্ষেপ বলেই মনে হয়।
দু’ধারের যুক্তি শুনলেন তো, এবার কালোদার দোকানে যান, কড়া করে এককাপ চাফি, মানে চায়ের উপরে কালোদার ছড়িয়ে দেওয়া কফি খেতে খেতে ভাবুন, কিসমে কিতনা হ্যায় দম? মানে কোন ধারের যুক্তিতে কত দম আছে। হিসেব সেরে? আবার কী, আপনিও মাঠে নেমে পড়ুন। আর যদি মনে হয়, এর বাইরেও আপনার একটা নিজেদের মতামত আছে, তাহলে তা স্যাটাস্যাট লিখে ফ্যাটাফ্যাট পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। এ রাজ্যে অনেক কিছুই তো স্যাটাস্যাট ফ্যাটাফ্যাট হয়, আপনিও লাইনে থাকুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আজ এখানেই শেষ করছি।