যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, ফুরফুরা শরিফ আর দিঘার জগন্নাথ মন্দির।
এটা সত্যিই যে স্বাধীনতার পরে যখন সোমনাথ মন্দির নতুন করে তৈরি হচ্ছিল তখন জওহরলাল নেহরু এমনকী গান্ধীজিও বলেছিলেন যে রাষ্ট্রের টাকায় মন্দির তৈরি হবে না। এই বিরোধ কিন্তু কংগ্রেসের মধ্যেই ছিল, বল্লভভাই প্যাটেল বা কে এম মুন্সির মতো বড় কংগ্রেস নেতারা এই মন্দির বানানোর কাজে নেমেছিলেন, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, নেহরুর আপত্তি না মেনেই উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। নেহরু দেশের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখে বলেছিলেন যে এই উদ্বোধন বা পুনর্নিমাণ রাষ্ট্রের কাজ নয়, সরকারি কাজ নয়। কিন্তু এই বিতর্কে ছিলেন কংগ্রেসের বড় নেতারা, কেউ প্যাটেল, মুন্সির পক্ষে কেউ বা নেহরুর পক্ষে। আসলে কংগ্রেসে সেই শুরুর থেকেই হিন্দু কট্টরপন্থীরা এবং এক্কেবারে নেহরুর ধাঁচে সেকুলার ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজন ছিলেন, বিতর্ক লেগেই থাকত। এ বিতর্ক স্বাধীনতার আগেও ছিল, সেই বিতর্কে নেহরু–সুভাষ এক অবস্থানেই ছিলেন। নেহরু খানিক নাস্তিক ছিলেন, সুভাষচন্দ্র বসু আস্তিক, কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে দুজনেই প্রায় একই অবস্থানে ছিলেন। কেন প্রায় একই বলছি? কারণ ওই পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা আর এক সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথার মধ্যে খানিক ফারাক ছিল বইকী। ত্রিশূল নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে সুভাষ বসু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বইকী, কিন্তু প্রতিদিন পুজো করতেন এবং বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতেও আমরা দেখেছি উনি জোরের সঙ্গেই সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাই বলতেন, যা ছিল আদতে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের কথা। আইএনএ-তে এই সর্বধর্ম সমন্বয়কে এক আদর্শ করে তোলা হয়েছিল। ওদিকে নেহরু বরাবর, মৃত্যু অবধি এক সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ আর পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। স্বাধীন ভারতে নেতাজি বেঁচে থাকলে কী করতেন, কোন পথ নিতেন জানা নেই, কিন্তু আজ সেই পরিস্থিতি নেই। সেদিন আরএসএস–হিন্দু মহাসভা ছিল এক জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন, গান্ধী-হত্যার পরে তো প্রায় শেষ হওয়ার মুখেই ছিল। কাজেই এই ধর্মনিরপেক্ষতা বা সর্বধর্ম সমন্বয়ের সূক্ষ্ণ ফারাক নিয়ে বা তাদের কার্যকারিতা নিয়ে সেরকম কোনও বিতর্ক হয়নি। যেটুকু হয়েছিল তাও ছিল কংগ্রেসের মধ্যেকার বিতর্ক, খানিক অ্যাকাডেমিক ডিসকাশনও বটে। আজ আগামাথা বদলে গেছে, আসুন সেটাই অন্য দিক থেকে দেখা যাক।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | বাংলাদেশ কি তার ইতিহাস ভুলে যেতে চাইছে?
আজ দেশের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীরা এক বিরাট চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ৭৫-৭৮ শতাংশ হিন্দুদের কাছে তাঁদের হিন্দুত্বের চূড়ান্ত বিজয়ের কথাও বলছেন আবার হিন্দুরা যে বিপন্ন সেই কথাও বলছেন। সাড়ে পাঁচশো বছরের মুসলমান শাসনের ফলেই যে আজকের হিন্দুরা বিপন্ন এমন এক উদ্ভট কিন্তু পপুলার ন্যারেটিভ তাঁরা অনেকটা ছড়িয়েও দিতে পেরেছেন। আর এইখানেই তৈরি হয়েছে এক নতুন বিপদ।
কোনও কুস্তিগির কোনও পালোয়ান কুস্তির আখড়াতে নেমে যদি দেখে তাঁর প্রতিপক্ষের হাতে একটা পিস্তল বা ভোজালি, তাহলে যেমন হবে হুবহু সেই অবস্থাতে আজ দেশের মানুষ। বিশেষ করে সেই মানুষ যাঁরা আজ এতদিন ধরে হয় পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতা বা সর্বধর্ম সমন্বয়কেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তুলে ধরেছিলেন। ইশ্বর আল্লা তেরো নাম, সবকো সম্মতি দে ভগবান বলেছিলেন গান্ধীজি আর জওহরলাল বলেছিলেন নতুন কারখানা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই হয়ে উঠুক ভারতের নতুন মন্দির মসজিদ। কিন্তু আজ ওই উন্মাদ হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে যদি আপনি নিজেকে ধর্মবিযুক্ত করার দিকে যান, তা আদতে ওই উন্মাদদেরই সাহায্য করবে। বা বলা ভালো যে এই হিন্দুত্ববাদী আরএসএস–বিজেপি চায় যে বিরোধী সমস্ত দল দেশের হিন্দুদের কাছে অ্যান্টি-হিন্দু বলে পরিচিত হোক। তারা গেরুয়া শুনলে প্রত্যাখ্যান করুক, তারা জয় শ্রীরাম বললে রেগে যাক, তারা রামমন্দির ভূমি পূজন বা উদ্বোধনের দিনে ঘরে বসে থাকুক, তারা রাম নবমী বা গণেশ চতুর্থীকে আরএসএস–বিজেপির অনুষ্ঠান বলেই চিহ্নিত করুন। হ্যাঁ, তাঁরা ঠিক এটাই চাইছেন, দেশের ৭৮ শতাংশ হিন্দু পপুলেশনের কাছে বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল হয়ে উঠুক হিন্দু বিরোধী, মুসলমান তোষণকারী। এটা করতে পারলেই ওই ৭৮ শতাংশ পপুলেশনের ৭৫-৮০ শতাংশ ভোট সিকিওর করতে পারলেই কেল্লা ফতে। ৫৩-৫৪ শতাংশ ভোট এসে যাবে তাদের বাক্সে, এক নিরবিচ্ছিন্ন বিজেপির শাসনতন্ত্র চালু হবে। তারা এই কাজ করার জন্যই দেশ জুড়ে এক প্রচার শুরু করেছে যার মূল কথাই হল বিরোধী রাজনৈতিক দলের ধর্ম নিরপেক্ষতা হল আদতে মুসলমান তোষণ, আদতে হিন্দু বিরোধী এক কর্মসূচি। তাদের প্রচারে সাড়া মিলেছে, বিজেপির ভোট বাড়ছে, লাগাতার বাড়ছে। কিন্তু এখনও হিন্দু পপুলেশনের ৫৫ শতাংশের বেশি ভোট তারা সিকিওর করতে পারেনি। এই জায়গাতেই এসে এই বাংলার রাজনীতিতে নজর দেওয়া যাক। বিজেপির প্রচার ১) জয় শ্রীরাম বললে মুখ্যমন্ত্রী রেগে যাচ্ছেন। ২) রাম নবমীর মিছিলে নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে এই সরকার। ৩) দেশপ্রিয় পার্কে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য পুজো বন্ধ রাখার নির্দেশকে সামগ্রিকভাবেই দুর্গাপুজো বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছে এই সরকার, এটাই প্রচার করা হচ্ছে। ৪) যোগেশচন্দ্র কলেজের সরস্বতী পুজো নিয়ে এক অশান্তিকে সারা রাজ্যে সরস্বতী পুজো করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে প্রচার। ৫) মুখ্যমন্ত্রী ইফতারে যান, উনি মুসলমান তোষণ করেন। ৬) রাজ্যের সরকার বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার নিয়ে কথা বলছে না। ৭) এ রাজ্যে নাকি হু হু করে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা বাড়ছে, কিছুদিনের মধ্যেই তারা হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা প্রচারের উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য কিন্তু এক এবং অভিন্ন। এই রাজ্যের শাসকদল আদতে হিন্দু বিরোধী, মুসলমান প্রেমী। এই ন্যারেটিভটা রাজ্যের গরিষ্ঠাংশ হিন্দুদের কানে দিতে পারলে ফল পাবে এই আশাতেই তারা বসে আছে। এবং এই প্রেক্ষিতে আজকের দিনে পাশ্চাত্য ধর্ম নিরপেক্ষতা কোনওভাবেই এই প্রচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী হবে না। এবং এইখানেই নেতাজি অনেক বেশি কার্যকরী, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ অনেক বেশি কার্যকরী, রাজ্যের মানুষের সামনে এক সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা তুলে ধরাটাই এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত আর সেদিকেই মন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বড়দিনে যাচ্ছেন, তিনি গুরুদ্বারাতে যাচ্ছেন, তিনি দিঘাতে জগন্নাথ দেবের মন্দির উদ্বোধনে যাবেন, তিনি ফুরফুরা শরিফে গেলেন। হ্যাঁ এই সবটাই রাজনীতি, বিশুদ্ধ রাজনীতি, কিন্তু সেই রাজনীতি বিজেপির নোংরা আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশকে বাঁচানোর রাজনীতি। সময়টা বদলাচ্ছে, শত্রু বদলে গেছে, অস্ত্র ধারালো হয়েছে, তীব্র ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বধর্ম সমন্বয়ের রাজনীতিই এখন অস্ত্র হয়ে উঠুক।