যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজকের বিষয়, বাংলাদেশ কি তার ইতিহাস ভুলে যেতে চাইছে?
ইতিহাস চর্চার সেই অমোঘ ক’টা কথা বার বার মনে করিয়ে দিতে হয়, জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষেরা তা বারবার করে মানুষকে মনে করান, কিন্তু মানুষ ভুলে যায়। দোজ হু ফরগেট দ্য হিস্ট্রি, আর কনডেমড টু রিপিট ইট। যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তারা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মুখোমুখি হয়। আমাদের দেশের মানুষের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়, সেই ভুলে যেতে চাওয়া অধ্যায়, দেশ বিভাজন আর হিন্দু মুসলমানের সেই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, একজনের হাতে লাঠি, একজনের আস্তিনে ছুরির সেই দিনগুলো মনে রাখলে আজ কি আবার সেই একই হিন্দু মুসলমান রাজনীতি বাড়তে পেত? যে মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, শুভেন্দু অধিকারী বা আসাদউদ্দিন ওয়েইসির মতো নেতারা ওই হিন্দু-মুসলমান রাজনীতির কথা বলতেন, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করার কথা উঠত। কিন্তু ওই যে, মানুষ ইতিহাস ভুলে যায়, ভুলে যায় বলেই তা আবার ফিরে ফিরে আসে রাষ্ট্রজীবনে, সমাজজীবনে। সেরকমই কিছু ঘটেই চলেছে বাংলাদেশে। পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা বাংলা ভাষার দাবিতে, বা বলা ভালো মাতৃভাষার দাবিকে সামনে রেখে এক স্বাধীন দেশ গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের আপামর হিন্দু-মুসলমানের প্রাণের ভাষা পেয়েছিল তার স্বদেশ। আজ সেই ইতিহাস কি ভুলে যাওয়ার দিন? অবশ্যই সেদিনের তিক্ততা, পাক-বাংলাদেশ যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য শহীদ, অবর্ণনীয় অত্যাচার, নারী ধর্ষণ, শয়ে শয়ে অধ্যাপক, কবি, লেখক খুন, আরও কত কিছুকে ঘিরে। সেই তিক্ততা কি বজায় থাকবে না থাকা উচিত? সভ্য সমাজ বলে এক সময়কালের পরে সেই ঐতিহাসিক তিক্ততা থাকার কথা নয়, থাকা উচিতও নয়, থাকেওনি। দুনিয়ার দেশে দেশে এককালে শত্রু দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে, এবং সেটাকেই তো সভ্যতা বলা হয়। ইতিহাসের কোন মধ্যযুগেকে আমার উপাসনাস্থল ভেঙেছিল, আজ তার উপাসনাস্থল ভেঙে আমি আমার ঘৃণা ছড়িয়ে দেব সমাজের সর্বস্তরে, সেটা আর যাই হোক সভ্যতা নয়। কিন্তু তা বলে কি ইতিহাস ভুলে যাব? মনেই রাখব না সেই ইতিহাস যা রাষ্ট্রসমাজের এক পরম প্রাপ্তি? আসুন আলোচনাটাকে এবারে অন্য আর একদিক থেকে করা যাক?
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | কারাত বনাম ইয়েচুরি
যে কথা বলছিলাম, তা বলে কি ইতিহাস ভুলে যাব? মনেই রাখব না সেই ইতিহাস যা রাষ্ট্র সমাজের এক পরম প্রাপ্তি?ধরুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার সেই দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়াই, জার্মান ফৌজের দানবীয় শক্তিকে আটকে দিয়ে সেই বিরাট জয়। সে কি শুধু কমিউনিস্টদের ছিল? সে কি শুধু স্তালিনের লড়াই? আজ রাশিয়া স্তালিন বিরোধী, আজ রাশিয়াতে কমিউনিস্টরা এই বাংলার মতোই শূন্য, কিন্তু আজও রাশিয়াতে সেই বিজয় দিবস পালন করা হয়, ক্রেমলিনের পাশেই আজও এমনকী ইউক্রেনের কমরেডদের লড়াইয়ের স্তম্ভেও ফুল-মালা দেওয়া হয়, কারণ তা ছিল দানবের বিরুদ্ধে লড়াই। আজও ফ্রান্স সেই বিজয় দিবস পালন করে, যদিও আজ জার্মানি তার বন্ধু দেশ।
কিন্তু কী হল এমন যে বাংলাদেশ তার বিজয় দিবস ভুলে যাবে? আজ মুজিবর রহমানের জন্মদিন, তিনি জাতির পিতা, অনেক ভুলের পরেও মুজিবর রহমান ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। কেউ তাঁর নামও উচ্চারণ করবেন না? তিনি তো স্বাধীনতা যুদ্ধে ছিলেন না, তিনি ছিলেন কারাগারে এমন আহাম্মক যুক্তি নিয়েই সাজাবেন কথামালা? মুজিব কেউ নন? জিয়াউর রহমান কেউ নন? বীর শহীদরা কেউ নন? এরপরে অজান্তেই আসছে আজকের নায়কদের পালা, তাঁরাও ভিলেন হয়ে যাবেন হঠাৎ? ২৬ মার্চ সেই প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল, সেদিন ভুলে যাবেন বাংলাদেশের মানুষ? সেই লড়াই ভুলে যাবেন? এবারে ১৬ ডিসেম্বরও পালন হয়নি, যেন ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ছন্নছাড়া দিন, এক মূল্যহীন ইতিহাস? সেদিন জন্ম নিয়েছিল যে স্বাধীন দেশ, সেই স্বাধীন দেশের মানুষেরাই সেই দিন ভুলে যাবেন? সেই দিনকে ভোলানোর চেষ্টাকে আটকাবেন না? তাই কি হয়? মুজিবকে অস্বীকার করবেন? করুন। যুক্তি সাজান, অস্বীকার করুন। কিন্তু স্বাধীনতাকে? অমন এক বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে? পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক? ১০০ বার হওয়া উচিত, কোথায় ইয়াহিয়া? কোথায় ভুট্টো সাহেব? আজ কোন বাধা আছে দু’ দেশের মধ্যে? বাণিজ্য হোক, সম্পর্ক ভালো হোক, কিন্তু তার জন্য স্বাধীনতার ইতিহাসকেই ভুলে মেরে দিতে হবে, এ এক আহাম্মকি চিন্তা।