যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। কংগ্রেসের বহু ভাগাভাগি হয়েছে, সেরকম এক ভাঙনের সময়ে ‘কংগ্রেস ও’, মানে কংগ্রেস অর্গানাইজেশন, সংগঠন কংগ্রেস বলে এক দল তৈরি হয়েছিল, সামান্য কিছু নির্বাচনী সাফল্য পাওয়ার পরেই দলসুদ্ধ বিলীন হয়েছিল জনতা পার্টিতে। আর কংগ্রেসে কেবল সংগঠন করেছেন, মন্ত্রিত্ব ক্ষমতা ইত্যাদিতে যানইনি এমন একজনই ছিলেন, তিনি হলেন মহাত্মা গান্ধী। কমিউনিস্টদের অবশ্য বরাবরই দলে এমন ভাগাভাগি আছে, সেই কাকাবাবু মুজফফর আহমেদ থেকে শুরু করে প্রমোদ দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস, বিমান বসু প্রত্যেকেই ছিলেন সংগঠনের নেতা। আর বিধানসভা লোকসভা, নির্বাচন ইত্যাদিতে থেকেছেন জ্যোতি বসু, কৃষ্ণপদ ঘোষ, বুদ্ধ ভট্টাচার্য, সুভাষ চক্রবর্তী। বিজেপিতে অবশ্য এরকম কোনও ভাগ নেই কারণ ওনাদের আদর্শ আর সংগঠন তো দেখে আরএসএস, ইন ফ্যাক্ট বিজেপি দল তৈরিই হয়েছে নির্বাচন, সংসদীয় রাজনীতির জন্য। মতাদর্শ প্রচার এবং সেই কাজগুলো দেখে আরএসএস। সেই সংগঠন আর সংসদীয় রাজনীতির কোন খাপে আছেন শুভেন্দু অধিকারী? উনি তো আদি বিজেপি নন, নতুন কাকে কী যেন বেশি খায়ের মতো উনি যতই ওই হিন্দুত্ব আর আরএসএস শাখার গল্প করুন না কেন, মমতাকে বেগম মমতা বলা ছাড়া সেই দিকে বিরাট কোনও অ্যাচিভমেন্ট তো নেই।
আসুন একটু বোঝা যাক, এই সংগঠন আর সংসদীয় রাজনীতির কোনখানে তিনি আছেন। তাহলে এক্কেবারে গোড়ার আলোচনায় যাওয়া যাক বিজেপি এই কাঁথির খোকাবাবুটিকে দলে নিয়ে গেল কেন? তার প্রথম কারণ হচ্ছে বিজেপির সারা দেশের আদত স্ট্র্যাটেজি হল অন্য দল ভাঙাও, অন্য দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের গদির লোভ দেখিয়ে দলে আনো, তারপর তারা যদি নিজেদের প্রমাণ করতে পারে তো ভালো, তারা হেমন্ত বিশ্বশর্মা হবে, মাধব রাও সিন্ধিয়া হবে আর না হলে থাকবে টিকটিকির যেমন ল্যাজ থাকে, খসে যাবে আবার নতুন ন্যাজ গজাবে। তো ওনারা মুকুল রায়কে নিয়েছিলেন, মুকুল রায়ের ভয় ছিল জেল যাওয়ার, ইডির, সিবিআই-এর, উনি মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালে ভবিষ্যৎ আপনার, মমতা শোনেননি। উনি বিজেপিতে গিয়েছিলেন কিন্তু উনি চাণক্য ইত্যাদি বাওয়াল খুব তাড়াতাড়ি মানুষ আর বিজেপি বুঝে ফেলেছিল। কাজেই এবারে তাঁদের কাঁথির এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাকে মনে ধরল, এনারও ওই ইডি-সিবিআই-এর ভয় ছিল বইকী, তো তাঁকে আনার তোড়জোড় হতেই তিনি জানিয়ে দিলেন, দল পুরো আড়াআড়িভাবে ভেঙে নিয়ে যাবেন, বিধানসভার নির্বাচনে ১২০টার মতো পেলেই মাঠ তৈরি করে ফেলেছেন।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | হয়েছে যাবজ্জীবন আর হতে পারত ফাঁসি
সে তখন কী দহরম মহরম, রাজ্যে যে বিজেপি নেতারা গত ১৫-২০-৩০ বছর ধরে জনসঙ্ঘ তারপরে বিজেপি করছেন তাঁরা দেখলেন, নেতারা এসেই জিজ্ঞেস করছেন শুভেন্দু কিধর হ্যায়? সেই দিনগুলোর কথা মনে করুন, কী সংগঠনের বৈঠকে কী নির্বাচনী স্ট্রাটেজির বৈঠক, সর্বত্র শুভেন্দু ছা গয়া। তারপর ফুউউউউউউউস। আড়াআড়ি ছেড়ে দিন, যাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ওই এক চোখে আঙুল দাদা ছাড়া আর কেউ দলে নেই। বিজেপির উপর মহলে ভুরু কুঁচকোল, কাকে দিয়েছি রাজার পার্ট, তারপরে এটা ফার্স্ট চান্স ছিল, কাজেই আবার বাওয়াল ২০২৪, ২৯ তো বটেই ৩১ হতে পারে যদি আমার কথা শোনেন। কিছু আসনে ওনার কথা শুনেই নাকি সিটিং এমপিকে অন্য আসনে লড়তে পাঠানো হল, আমও গেল, ছালাও গেল। সংগঠন নয়, ওনাকে সংসদীয় রাজনীতি করতেই আনা হয়েছিল, আটারলি ফেলিওর।
এবারে আসুন সংগঠনের দিক থেকে ব্যাপারটা বোঝা যাক। ছাতার আড়ালে থাকলে চেহারা বোঝা যায় না, আর সেই ছাতার নাম যদি মমতা হয়, তাহলে তা আরও অসম্ভব। এই বাংলাতে সত্যি বলতে কী, বিধানসভার ২৯৪ আর লোকসভার ৪২টা আসনের প্রত্যেকটাতেই লড়েন মমতা, প্রত্যেক ক্যান্ডিডেট, সে সৌগত রায় হোন আর মালা রায়, ব্রাত্য বোস হোক বা বীরবাহা হাঁসদা, ক্যান্ডিডেট আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাইনাস মমতা ওই আসনে জামানত রাখার জন্যও প্রচুর চেষ্টা করতে হবে ওই প্রার্থীদের। আবার সংগঠন? সেখানেও একটিই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। উনিই প্রতিটা সিদ্ধান্তের আগায় এবং পিছনে, উনিই প্রতিটা সাংগঠনিক রদবদলের কাণ্ডারি, উনিই প্রোগ্রাম ঠিক করেন, উনিই এগজিকিউট করেন। কাজেই সেখানে কোন খাঞ্জা খাঁ নিজেকে কী ভাবল তা নিয়ে যারা ভাবে তাঁদের বলব কচি পাঁঠার রাংয়ের মাংস কচি পেঁপে দিয়ে ঝোল করে খেয়ে শুয়ে পড়ুন, শুনেছি এতে গ্যাস অম্বল নাকি কমে।
তো সেই হেন ছবিতে এক মূষিক নিজেকে ঐরাবত ভাবতেই পারেন, যেমনটা ভেবেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, এত্ত বড় বিজেপির সাপোর্ট সিস্টেম, যে দলে থাকলে যে কারও ঘরে ইনকাম ট্যাক্স থেকে ইডি-সিবিআই-এর রেড করানোর ধমকি দেওয়া যায়, সেখানে থেকেও ওনার নিজের উঠোনে নিজেই হেরে গেলেন। কাঁথি সমবায় ব্যাঙ্ক কেবল শুভেন্দুর নয়, এ হল অধিকারী পরিবারের শান, তো সেই ব্যাঙ্কের নির্বাচনে গোহারা হেরেছেন, সেই হারের জন্য কত দাম দিতে হবে তা আগামী দিনে বোঝা যাবে। কিন্তু এই হার অন্তত এটা বলে দেয় যে আদত সংগঠন নিয়ে শুভেন্দুর হাতে কিন্তু রয়েছে পেনসিল। তো এখন রাজ্যের বিজেপি সংগঠন কে দেখছেন? সুকান্ত মজুমদার, এবং তিনিই বলে দিয়েছেন যে এই সংগঠন ইত্যাদির ব্যাপারে শুভেন্দু কমফর্ট ফিল করেন না, উনি স্বচ্ছন্দ নন, গোদা বাংলাতে শুভেন্দু সংগঠনটা বোঝেন না।
এবার আসুন শেষ হিসেবটা কষে ফেলি, কাঁথির এই খোকাবাবু নির্বাচনে সেই জয় যাকে বলে তা এনে দিতে পারেননি, ওনার পারার কথাও নয়, এটা বুঝে গেছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আবার উনি সংগঠনটাও বোঝেন না, সেটা জানিয়েই দিলেন সুকান্ত মজুমদার। তাহলে উনি ধর্মেও নেই, জিরাফেও নেই, জানতে মুঞ্চায় উনি আছেন কোথায়? কোথায় আছেন শুভেন্দুবাবু?