Placeholder canvas

Placeholder canvas
Homeচতুর্থ স্তম্ভসন্ধ্যে নেমে এলে, রাক্ষসেরা আসে, ইডি ডাকে আয়, আয়, আয়

সন্ধ্যে নেমে এলে, রাক্ষসেরা আসে, ইডি ডাকে আয়, আয়, আয়

Follow Us :

নিশির ডাক তো জানে সবাই৷ কেউ কেউ নাকি সে ডাক শুনেছে। নিশুথি রাতে নিশি ডাকে আয় আয় আয়, তারপর মুখে ফেনা ওঠা, ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকা দেহ পাওয়া যায়। কাদের ডাকে নিশি? তার বেছে নেওয়ার পদ্ধতির কোনও সমীকরণ নেই৷ ডাকে, যাকে ইচ্ছে ডাকে। ইডি কিন্তু তেমন নয়৷ তার ডাকার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে৷ সে পদ্ধতি কারোর কাছেই অজানা নয়। এই ভারতবর্ষে দু’ধরনের এলাকা আছে৷ বিজেপি বা তার বন্ধুদের শাসিত রাজ্য এবং বিজেপি বিরোধী দল শাসিত রাজ্য। প্রয়াগ সঙ্গমে গেলে দেখবেন, গঙ্গার জল ঘোলাটে, যমুনার জল সাদা, স্বচ্ছ। খানিকটা সেইরকম আর কি৷ ইডি বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিরোধীদের ঘরে কড়া নাড়ে আর অবিজেপি শাসিত রাজ্যে শাসকদলের দরজায় টোকা দেয়৷ রাতে নয়, দিন দুপুরে প্রেম পত্র আসে৷ চলে আসুন কথা আছে৷ আপনি অভিযুক্ত? আপনি কোনও অন্যায় লেনদেনের সাক্ষী? না, এসব জানানোর দায় ওনাদের নেই।

ধরুন পুলিশ আপনাকে ডাকছে, কেন ডাকছে? জানাতে হবে৷ আপনি অভিযুক্ত নাকি সাক্ষী, তা জানাতে হবে৷ এনফোর্সমেন্ট ডিরেকটরেটকে সে সব জানাতে হবে না। ধরুন পুলিশ আপনাকে ডাকল, কলার চেপে রুলের গুঁতো দিয়ে বলল, বলে ফ্যাল চুরি করেছিস। গুঁতো খাবার ভয়ে আপনি বলে দিলেন৷ কিন্তু আদালতে গিয়ে বেমালুম অস্বীকার করতে পারেন৷ পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দী আদালতকে মেনে নিতেই হবে, এমন তো নয়। কিন্তু ইডির কাছে? যা বলেছেন, তা আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার হতে পারে৷ মানে চার দেওয়ালের ভেতরে আপনাকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নেওয়া যা কিছু, তার সবটাই আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার হতেই পারে।

এরপর আসবে জামিনের কথা৷ জামিন পাওয়াটা অভিযুক্তের অধিকার৷ দয়া বা করুণা নয়। কিন্তু ইডি ধরলে বিচারক কখন জামিন দিতে পারে? মনি লন্ডারিং এর মামলায় যদি বিচারক মনে করেন যে আপনি নির্দোষ, তাহলেই একমাত্র জামিন দিতে পারেন, কী কাণ্ড বলুন তো? বিচারক যদি মনে করেন আপনি নির্দোষ, একমাত্র তখনই আপনাকে জামিন দিতে পারবেন৷ কিন্তু বিচারকের চোখে  আপনি যদি নির্দোষই হন, তাহলে মামলাটা চলছে কেন? জবাব নেই। এই মনিলন্ডারিং নিয়ে যে আইন, তা কংগ্রেস বা ইউপিএর আমলেই গোলমেলে হয়ে উঠেছিল৷ এখন তা আরও শক্তপোক্ত হয়েছে৷ এমন ক্ষমতা এই আইনে দেওয়া হয়েছে, যাতে ইডি আপনাকে চাইলে বছরের পর বছর ডাকতে পারে, জেরা করতে পারে, জেলে পুরে রাখতে পারে, আবার ছেড়েও দিতে পারে। মজার কথা হল, কতদিন পুরনো লেনদেন নিয়ে এই মামলা হতে পারে? রেটড়োস্পেকটিভ এফেক্ট যাকে বলে, সেখানে কোনও বাধা নেই৷ ১৯৪৭ সালের লেনদেনও স্ক্রুটিনির মধ্যে আসতেই পারে৷ আপনি কোম্পানির মালিক ছিলেন না, ডিরেক্টর ছিলেন না, পরে এসেছেন, তাতে কী? আপনাকে ডাকতে পারে, জেরা করতেই পারে৷ এটা না বলেই যে আপনি মনি লন্ডারিং এর মামলায় দোষী? অভিযুক্ত? নাকি সাক্ষী?

আইন তৈরি হয়েছিল দুনিয়া জোড়া ড্রাগ কার্টেলের টাকা কোথায় আসছে, কোথায় থাকছে, তা খুঁজে বার করার জন্য৷ এরপর উগ্রপন্থার বিষয়টা জুড়ে যায়৷ এখন প্রায় সব কিছু৷ কপিরাইট ভায়োলেশনের বিষয়েও মনি লন্ডারিং, টাকা তছরুপের মামলা করা যায়, এবং মজার কথা হল যেই মাত্র আপনি পদ্ম হতে ধরবেন, সেই মাত্র আপনি মিঃ ক্লিন, আপনার ডাক পড়বে না৷ নিশি নয় ইডিও আপনার কাছ থেকে দূরে থাকবে৷ কিন্তু বিজেপি বিরোধী হলে? উদার গণতান্ত্রিক মতের এক সাংবাদিক হলে? কিংবা কোনও কারণে মোদি – শাহের কুনজরে পড়লে ইডি ডাকবে আয় আয় আয়। কলকাতায় থাকেন? তাতে কী? দিল্লিতে আসুন৷ জেরা? কত ঘন্টা চলবে কেউ জানে না। সাত থেকে ৭০ ঘন্টা, যা খুশি৷ বা বলা ভালো যেমন কর্তার নির্দেশ এবং তার সঙ্গে সিলেক্টিভ লিকেজ, মানে জেরা বা পাওয়া ডকুমেন্ট, ছবির খানিকটা চলে যাবে বাছাই করা সাংবাদিকদের কাছে৷ সক্কাল থেকে তাঁরা ব্রেকিং নিউজ চালাবেন৷ অবশ্য এটা কেবল ইডি নয়, এনআইএ, নারকোটিক্স ব্যুরো, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স মায় থানার কনস্টেবলও জেনে গিয়েছে, কোন খবর লিক করে দিলে কর্তারা খুশি হবে৷ আফটার অল কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, ইহাই শ্রমিকদের ধর্ম।

শাহরুক খানের ছেলে ড্রাগ পাচারে জড়িত, গ্রেফতার আরিয়ন খান। একে শাহরুখ, তারপর খান সব মিলিয়ে টিআরপি রকেটের মত উঠছে৷ এবার সেই ঘটনার আঁখো দেখি বিবরণ, চার মাস পরে জানা গেল, আরিয়ন নির্দোষ৷ তার কাছ থেকে কোনও ড্রাগ বাজোয়াপ্ত হয়নি৷  তখন জানা গেল যিনি এই গ্রেফতারি নিয়ে সবচেয়ে বেশী আওয়াজ তুলেছিলেন, বলার চেষ্টা করছিলেন যে এটা একটা ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের প্রমাণ দিচ্ছিলেন, সেই নবাব মালিক খান নাকি মনি লন্ডারিং এ যুক্ত, তাঁকে ধরা হল, তিনি জেলে বসে খবর পেলেন, আরিয়ন ছাড়া পেয়েছে, কিন্তু তিনি আনন্দ করবেন কি? তিনিই তো জেলে, ইডি ডেকেছে, জেরা করেছে, গ্রেফতারও করেছে। এই নবাব মালিকের ইডি মামলাটাও বেশ ইন্টারেস্টিং, বলি তাহলে?

গতবছর ৯ নভেম্বর দেবেন্দ্র ফড়ণবীস, একদা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির নেতা, একটা টুইট করলেন, তাতে লেখা হল, “নবাব মালিক, আপনি মুম্বইয়ের হত্যাকারীদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কেন? তিনি সাংবাদিকদের বললেন, নবাব মালিকের কোম্পানি মুমাবির কুরলাতে গ্যাংগস্টারদের কাছ থেকে, তিন একরের একটা সম্পত্তি কিনেছেন৷ চার মাস পরে এনআইএ চলে এল৷ ৩ ফেব্রুয়ারিতে এফআইআর হল, জানালো রিলায়েবল ইনফর্মেশন, ভরসা করা যায় এমন খবর পাবার পরেই এই এফ আই আর করা হয়েছে, সেই রিলায়েবল ইনফরমেশন এ আরও বলা হয়েছে যে, এই সম্পত্তি গ্যাংগস্টার দাউদ ইব্রাহিমের ডি কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে, এই টাকা বিভিন্ন নাশকতার কাজেও লাগানো হতে পারে, অতএব ইউ এ পি এ র ধারাও দেওয়া হল, এর ১১ দিন পরে ইডি মনি লন্ডারিং এর মামলা আনল, ঘটনা টা কী? মুম্বই এয়ারপোর্টে দক্ষিণে একটা সম্পত্তি ছিল, যার অনেকটা এক গ্যারাজ মালিক দখল করে রেখেছিল৷ সম্পত্তির মালিক মুনিরা এস প্লাম্বারেবং তাঁর মা। তাঁরা এই জায়গা থেকে ওই গ্যারাজকে তুলতে ১৯৯৯ সালে, একজনকে নিয়োগ করে, যাঁর নাম সলিম প্যাটেল, তিনি দাউদের বোন হাসিনা পার্কারের ড্রাইভার ছিলেন৷ ওই নিয়োগের সময় প্যাটেলের কাছে সম্পত্তির মালিক একটা পাওয়ার অফ আটর্নি দেয়৷ প্যাটেল সেটাকে কাজে লাগিয়ে সম্পত্তিটা বিক্রি করে, সলিডাস ইনভেস্টমেন্ট নামে এক কোম্পানির কাছে, ২০০৩ এ, সেই কোম্পানির মালিকানা নবাব মালিকের পরিবারের হাতে ছিল, যদিও মধ্যে ছ মাস বাদ দিলে নবাব মালিক এই কোম্পানির কোনও পদেই ছিলেন না৷ কেনার সময়ও নয়, নবাব মালিকের দাদা, যিনি এই সম্পত্তি কিনেছিলেন, তিনি মৃত।

তখনও মনি লন্ডারিং আইন তৈরিই হয়নি৷ কিন্তু নবাব মালিক জেলে, বের হবার সম্ভাবনা? বিজেপি ব্রান্ডের সাবান মাখলে হবে। এরপর ইডির চোখ, শিবসেনা নেয়া সঞ্জয় রাউতের ওপরে, যিনি সাফ জানিয়েছিলেন, ইডি গ্রেফতার করলেও তিনি উদ্ধব ঠাকরের বিরুদ্ধে যাবেন না৷ কিন্তু শিবসেনাকে রাজ্যে ভাঙার পর এবার নজর দিল্লির দিকে৷ কাজেই ইডি ডেকে পাটিয়েছে সঞ্জয় রাউতকে। দেশের প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য বিজেপি বিরোধী নেতা, ইডি র ডাক পেয়ে গিয়েছেন, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, এই বাংলায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমেত আরও অনেকে, লালু প্রসাদ যাদব, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, শরদ পাওয়ার, কে নয়? স্বাধীনতার পরে এই প্রথম এক সরকার যারা কেবল রাজনীতি নয়, কখনও সখনও পুলিশ নয়, দেশের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক অপরাধ ধরার এজেন্সিকে ব্যবহার করছে বিরোধীদের বিরুদ্ধে৷

এ এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা, আমাদের সংবিধানের রচয়িতারা, এরকম কোনও অবস্থা হতে পারে, তার কথা মাথাতেও আনেননি, কিছু হিসেব দিয়ে বোঝানো যাক, কতটা ব্যাপক হয়েছে  এই আক্রমণ, ২০০৫ থেকে ২০১৪ র মধ্যে এই মনিলন্ডারিং মামলায় সার্চ করা হয়েছে ১১২ টা ঘটনায়, ২০১৪ থেকে ২০২২ এর মধ্যে সার্চ করা হয়েছে ২৯৭৪ জায়গায়, ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মামলা করা হয়েছে ১৮৬৭ টা, সেটাই ১৪ থেকে ২২ এর মধ্যে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৭০ টাতে। তদন্ত করে, ২০০৫ থেকে ১৪ র মধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১০৪ টাতে, ১৪ থেকে ২২ এ ৮৩৯ টা ক্ষেত্রে এবং এই ১৭ বছরে দোষী সাব্যস্ত কত মামলায়? মাত্র ২৩ টা মামলাতে দোষীদের শাস্তি দেওয়া গেছে, কিন্তু এই ক বছরে ঐ যে নিশির ডাক, থুড়ী ইডির ডাক, কতটা বেড়েছে? ২০১৬-১৭ তে ৪৫৬৭ জন কে সমন ধরানো হয়েছে, ২০১৭-১৮ তে ৫৮৩৭ জন কে, ২০১৮-১৯ এ ৯১৭৫ জন কে, ২০১৯-২০ তে ১০৬৬৮ জন কে, ২০২০-২১ এ ১২১৭৩ জনকে, ২০২১ – ২২ এর নভেম্বার পর্যন্ত ১১২৫২ জন কে মনি লন্ডারিং মামলায় সমন ধরানো হয়েছে, পরিস্কার ছবি, পরিস্কার মেসেজ, ওহে এখনও বলছি সাবধান হও, নাহলে নবাব মালিক এর হালটা দেখে নাও। লাউড আন্ড ক্লিয়ার মেসেজ, কিন্তু সমস্যা হল, সব্বাইকে শিরদাঁড়াহীন ভাবলে চলবে? সব্বাই তো ওই বীইইইর সাভারকার নয় যে মুচলেকা দেবে, তাই না?

RELATED ARTICLES

Most Popular