২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার,
1
2
3
4
5
6
7
8
9
10
11
12
K T V Clock
হিরোর একটা গাড়ি নয় তিনটে, বাড়ি আড়াই কোটির
Fourth Pillar | টালিগঞ্জ, সিনেমা এবং অবক্ষয় আর দুর্নীতি  
কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক
কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক Published By:  কৃশানু ঘোষ
  • আপডেট সময় : ১৫-০৩-২০২৩, ১০:৩০ অপরাহ্ন

১/১ বিশপ লেফ্রয় রোড। বিজয়া রায়, কোলে সন্দীপ, ট্যাক্সিতে চড়লেন, গেলেন টালিগঞ্জের ফিল্ম ল্যাবে। সেখানে ট্যাক্সিতে ট্রাঙ্কগুলো তোলা শেষ হলে ট্যাক্সিতে চেপে বসলেন সত্যজিৎ রায়, ট্যক্সি চলল এয়ারপোর্টের দিকে। সেখানে প্লেন ছাড়ার সময়ের পরেও অপেক্ষা করছিল। নির্দেশ গিয়েছিল স্বয়ং বিধান রায়ের কাছ থেকে, ট্রাঙ্কগুলো চড়ানোর পরে ওই ট্যাক্সিতেই ফিরছেন সত্যজিৎ, বিজয়া, সন্দীপ। বিজয়া প্রশ্ন করলেন, সাব টাইটল হয়েছিল? সত্যজিৎ জানালেন হয়নি, ছবির ভাষা মানুষ ছবি দেখেই বুঝবে। ছবি উড়ে গেল। ১৯৫৬, আনন্দবাজার দফতরে টেলিপ্রিন্টারে খবর এল, “Indian film Pather Panchali wins Best Human Document award in Cannes Film Festival.” হ্যাঁ, ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ নিদেনপক্ষে একটা ল্যান্ডমাস্টারে নয়, সর্দারজির চালানো ট্যাক্সিতে চেপে পথের পাঁচালি রওনা দিয়েছিল কান-এ। ১৯৫১ সাল, তারাশঙ্করের নাগিনী গল্প নিয়ে সিনেমা করছেন ঋত্বিক ঘটক, তার আগেও একবার এ ছবি হতে গিয়েও বন্ধ হয়েছিল। এবার আরও পয়সার অভাব, ২০ দিন ধরে একটা ভাঙাচোরা ক্যামেরা নিয়ে কাজ করার পর ঋত্বিক ঘটকের হতে পারত প্রথম ছবি। কেবলমাত্র যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য নষ্ট হয়ে যায়। ঋত্বিকের বাজারে ধার কয়েক হাজার টাকা। যে মানুষ মধুমতীর মতো বাজার সফল ছবির চিত্রনাট্যকার তিনি অনায়াসে বম্বে ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। 

১৯৭০, মৃণাল সেন ৬৯-এই তৈরি করে ফেলেছেন ভুবন সোম, চমকে গেছে বাংলার দর্শক। তারপরের কথা, কলকাতা ৭১-এর শুটিং শেষে একটা ট্যাক্সিতে পাঁচজনে চেপে ঘরে ফেরা। শুটিং চলাকালীন প্রত্যেক শিল্পী টেকনিসিয়ানদের জন্য বরাদ্দ খাবারই খেতেন মৃণালদা, এ গল্প শুনেছি সেদিনের প্রোডাকশন ম্যানেজার শৈল চ্যাটার্জির মুখে। আচ্ছা কেন হঠাৎ এই ঋত্বিক, মৃণাল সত্যজিতের গল্প আজ? তাহলে বলি কেবল তাঁদের গল্পই নয়, গোটা টলিউডের সাধারণ গল্পটাই ছিল এইরকম। তুলসী চক্রবর্তী, যিনি ইউরোপ বা আমেরিকায় কাজ করলে গোটা পাঁচেক অস্কার পেতেই পারতেন, তিনি শেষ বয়সে অর্থাভাবে কষ্ট পেয়েছেন। জহর রায়ের কথা আমরা জানি, আরও অনেকের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিতেন, যাব তোমাদের অনুষ্ঠানে কিন্তু গাড়ি পাঠাতে হবে, আমার ঝরঝরে গাড়িখানা বড্ড তেল খায়, অত তেল জোগান দিতে পারছি না। তাঁর বাড়ির অদূরে থাকেন এক হিরো, যার একটি সিনেমাও আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। সেই হিরো বনি সেনগুপ্তের গাড়ির দাম ৪০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তারপরেও তাঁদের সেই দারিদ্র লজ্জার ছিল না, সেই দারিদ্র মানুষগুলোকে ছোট করে দেয়নি। আজ তাকিয়ে দেখুন। সাকুল্যে ৪-৫-৭ খানা ছবি, এক আধটার নাম হয় তো বা কেউ শুনেছে, কিন্তু সেই নায়িকার কলকাতার বুকে ২টো রেস্তরাঁ। একটা ছবিরও নাম জানা নেই, সেই নায়িকা অভিনেত্রী তো বটেই, তার ওপরে তিনি প্রযোজিকা, কোথা থেকে আসছে পয়সা? বাংলা ছবি চলছে না, সত্যিই তো চলছে না, এদিকে হিরোর একটা গাড়ি নয় তিনটে, বাড়ি আড়াই কোটির। সব নাকি মাচা থেকে আসছে, তো এই করোনার বাজারে তো মাচা বন্ধ ছিল, ওই লকডাউনের ক’দিন বাদ দিলে বিদেশ ভ্রমণের ছবি কি কম পড়িয়াছিল? না, আজ বালি তো কাল মরিসাস, ফেসবুকে নীলা আসমান, সামনে বেঢপ কোমরওলা নায়িকার উল্লাস, বডি শেমিং নয়, রুচির প্রশ্ন। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | রাহুল গান্ধী, দেশ এবং দেশদ্রোহিতা   

এবং আপাতত তাদের লাইন দেখা যাচ্ছে ইডি দফতরের সামনে, সিবিআই ডাকছে, কারণে অকারণে তাদের নাম ভেসে আসছে। তাদের বিত্ত আর বিলাসের অশ্লীল ছবি, পার্টিতে নাচন কোঁদন আর কুরুচির ছবি। অথচ এই অনুষঙ্গেই শিল্প মাধ্যমের অন্যতম এক মাধ্যম সিনেমার কথাই এসে যাচ্ছে, যা এই বাংলার একদা গৌরব ছিল, কী মেইন স্ট্রিম কী অন্য ধারার ছবি। সে যাই হোক, তাকে ঘিরে থাকা মানুষজনের এমন চূড়ান্ত রুচিহীনতা তো আগে দেখা যায়নি। দেখেছেন নাকি বাস্তবের উত্তমকুমারের ঘরে ইনকাম ট্যাক্স রেড? ঋত্বিক ঘটকের নামে চাকরি চুরির অভিযোগ? সত্যজিৎ রায়কে প্রোডিউসারের কাঁচা টাকায় নিদেনপক্ষে একটা ফিয়েট কিনতে? ইম্পা, ইস্টার্ন মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন, কারা এই অ্যাসোসিয়েশন চালাতেন? কারা এখন চালান? নামগুলো পাশাপাশি রাখলেও বিবমিষার কারণ হবে। কিন্তু আসুন বিষয়টা আরও একটু খতিয়ে দেখা যাক। দুর্নীতি যে কেবল টলিপাড়ায় তাও তো নয়, সর্বত্র, রাজনীতি, সরকার, সরকারি দফতর, পুলিশ, প্রশাসন, ব্যবসা, শিল্প, সর্বত্র একই দুর্নীতির ছবি, এত টাকা যা হাতে গোনাই যায় না, মেশিন লাগছে গুনতে। এবং সত্যি বলতে কী, এই সর্বব্যাপী দুর্নীতি ক্রমশ আমাদের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে নাকি? আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো আগে রাগ হত না? যখন জানতেন দুর্নীতির এই খবর, টিভিতে হোক, খবরের কাগজে হোক। দুর্নীতির খবর পড়লে গা ঘিনঘিন করত না? এখন? টাকার পাহাড়ের পাশেই অপার গল্প, বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি চুরির দায়ে জেলে, তারা ভার্চুয়লি আদালতে এসে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিচ্ছে! খুনসুটি করছে একে অন্যের সঙ্গে, সে খবর আমরা চেটেপুটে খাচ্ছি। 

দুর্নীতির থেকেও বড় খবর হয়ে দাঁড়াচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষটার বিলাসবহুল জীবন, তার খামারবাড়ি, তার ৫০ লাখের গাড়ি। আর আরও বড় দুর্নীতি হলে সে তো শিল্পপতি, সে তো আদানি, আম্বানি। ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার অশ্লীল বৈভব প্রদর্শনীর বিবরণ খবরের কাগজের পাতায় পাতায়। আম্বানির বউ দেড় কোটির শাড়ি পরে হাজির পার্টিতে, এ খবর কি আমরা পড়িনি। গত ২০-৩০ বছর ধরে হাজারো দুর্নীতির খবর আমরা কি দেখিনি? কে শোনেননি বোফর্স দুর্নীতির কথা? কোনও গোদি মিডিয়া নয়, দ্য হিন্দু পত্রিকা ফাঁস করেছিল সেই দুর্নীতি, একসঙ্গে হাত ধরে মান্ডার রাজা ভি পি সিং, অটলবিহারী বাজপেয়ী, জ্যোতি বসু অন্যান্য বিরোধী নেতারা কি বলেননি যে রাজীবের সরকার ফেলে দিন, আমরা বোফর্স ঘুষ যারা খেয়েছে তাদের নাম প্রকাশ্যে এনে দেব? বলেননি এ কথা। বলেছেন তো, গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়। তারপর রাজীব গান্ধীর সরকার পড়েছে, বোফর্স-এর কথা আর শুনেছেন, ততদিনে শুরু হয়ে গেছে মণ্ডল আর কমণ্ডল। তারপরে কয়লা ঘোটালা, টু জি স্ক্যাম আরও কত শত স্ক্যামের কথা মানুষ জানলো। ইন্ডিয়া এগেইন্সট করাপসন-এর মঞ্চে আন্না হাজারের সঙ্গে কেজরিওয়াল আছেন, জেটলি আছেন, কিরণ বেদী আছেন, বাবা রামদেবও আছে। মোদিজি প্রত্যেক জনসভায় বললেন এই দুর্নীতিবাজ সরকারকে ফেলে দিন আমরা সুদিন আনব, অচ্ছে দিন আয়েগা। সেসব কালাধন নাকি ফিরিয়ে আনা হবে তারপর সেই ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার বাওয়ালি। হল কি? কতজন কয়লা চোরের জেল হল? টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কতজনের জেল হল? একজনেরও না। তারপর রাফাল, এল চলে গেল, নারদা কেলেঙ্কারি তো আমাদের রাজ্যের, ছবিতে দেখা গেল টাকার হাতবদল হল, ভোটের আগেই সে ছবি এল, মানুষ পাত্তাও দিল না। সারদা কেলেঙ্কারি, সেও অথই জলে। আপাতত শিক্ষা, চাকরি দুর্নীতি, এও সময়ের অপেক্ষা, অন্তত সাধারণ মানুষ তো এরকমই মনে করে, কেবল নাটক হচ্ছে চারিদিকে। 

আগেও হত, এখনও হচ্ছে। আগেও ইডি, সিবিআইকে কাজে লাগাত সরকার, হালকা একটা নিয়ম ছিল, খানিকটা গ্যাংস্টারদের মতো। যা হবে আমাদের মধ্যে হবে, আমি ক্ষমতায় থাকলে আপনাকে গ্রেফতার করব, আপনি থাকলে আমাকে গ্রেফতার করবেন, ছেলে, মেয়ে, পরিবার নিয়ে টানাটানি করবেন না, করাও হত না। অমিত শাহকে জেলে পোরা হয়েছিল, বউ-ছেলেকে তো নয়। কিন্তু মোদি-শাহ জমানা সেই গ্যাংস্টার রুল ভেঙে চুরমার করে দিল, লালু, রাবড়ি, তেজস্বী, মিসা, অনুব্রত, সুকন্যা, চন্দ্রশেখর রাও, তাঁর কন্যা, অভিষেক ব্যানার্জি, তাঁর স্ত্রী, তাঁর শ্যালিকা সব্বার ঘরে ইডি, সিবিআই, ভিজিলেন্স। রোজ সেনসেশনাল নিউজ, রোজ কালীঘাটের কাকু, হুগলির জেঠুর নাম ভেসে আসছে, রোজ হাজিরা। ইডির ১২৮ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১২৪ জন বিরোধী নেতা আজ ডাক পাচ্ছেন জেরার জন্য বা জেলে। এর সবটাই যে এক মেসেজ নিয়ে হাজির হচ্ছে তাও পরিষ্কার। এটা কেবল ওই নেতারা বুঝছেন তাও নয়, মানুষের কাছেও এটা পরিষ্কার। কাজেই দুর্নীতি শব্দ, যা নাকি পাহাড়ের চেয়েও ভারি হবার কথা তা এখন বেলে হাঁসের ডানার পালকের চেয়েও হালকা, গুরুত্বহীন। চায়ের ঠেকে খবর এল অমুক নেতা ২০ কোটি সমেত ধরা পড়েছে, আলোচনা শুরুর আগেই শেষ কারণ পাঠানের ১২০০ কোটি টাকার ব্যবসা তার চেয়ে বেশি আলোচনা করার মতো খবর। তাহলে? সেই প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের লেখা বইয়ের কী হবে? বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগে লিখছেন, “পরের দ্রব্যে হাত দিও না। না বলিয়া, পরের দ্রব্য লইলে, চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া, তাহাকে সকলে ঘৃণা করে। চোরকে কেহ কখনও প্রত্যয় করে না।” মাস্টারমশাই এখনও এটা পড়াবেন তো? বাড়িতে বাচ্চারা সুর করে এই পাঠ পড়বে তো? নাকি নতুন বর্ণপরিচয় লেখা হবে, নতুন প্রজন্মের শিশুরা পড়বে, চুরি এক সাধারণ বিষয়, চুরি করা মহাপাপ তো নয়ই, পাপ বলেও গণ্য করা হয় না।

 

Tags : Tollywood Cinema Corruption ED CBI টলিউড সিনেমা দুর্নীতি ইডি সিবিআই

0     0
Please login to post your views on this article.LoginRegister as a New User

শেয়ার করুন


© R.P. Techvision India Pvt Ltd, All rights reserved.