আর্জেন্তিনা–৩ ক্রোয়াশিয়া–০
(লিওনেল মেসি-পেনাল্টি, জুলিয়েন আলভারেজ–২)
জীবনের শেষ বিশ্ব কাপে ট্রফিটা হাতে তোলবার সৌভাগ্য হয়েছিল শচীন তেন্ডূলকরের। তার আগেও বিশ্ব কাপ ফাইনাল খেলেও ট্রফি থেকে গিয়েছিল অধরা। টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। লিওনেল মেসির কপালেও মনে হচ্ছে শচীনের মতো জীবনের শেষ বিশ্ব কাপটা নাচছে। লিটল মস্টারের মতো তিনিও একবার বিশ্ব কাপ ফাইনাল খেলেছেন এবং অধরা থেকে গেছে কাপ। মনে হচ্ছে, এবার মনে হয় কাপটা নিয়েই কাতার ছাড়বেন। যে দাপটে মঙ্গলবার রাতে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে মেসি এবং তাঁর দলবল বিশ্ব কাপের ফাইনালে উঠল তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার। কাপ জেতার জন্য আর্জেন্তিনা তৈরি। চার বছর আগে যে টিমটার কাছে ০-৩ গোলে হারতে হয়েছিল মেসিদের, সেই টিমটাকেই যেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিশ্ব কাপ থেকে ছিটকে দিল মেসির দল। মেসি নিজে প্রথম গোলটা করলেন। আর শেষ গোলটা করালেন। তবে মেসির মঞ্চেই নায়ক হয়ে গেলেন বাইশ বছরের একটা ছেলে। নাম তার জুলিয়েন আলভারেজ। খেলেন ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে। আর্জেন্তিনার তিনটি গোলের মধ্যে দুটো গোল তাঁরই। প্রথম গোলের পেনাল্টিটাও তাঁর জন্যই আদায় হয়েছে। দলকে ফাইনালে তোলার দিনেই দেশের হয়ে গোল করার রেকর্ড করে ফেললেন মেসি। এত দিন এই রেকর্ডটা ছিল গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার। তাঁর ১০ গোলকে ছাপিয়ে ১১ গোল হয়ে গেল মেসির। এখনও একটা ম্যাচ বাকি। রবিবসারীয় সন্ধ্যায় বিশ্ব কাপ ফাইনালে তাদের মোকাবিলা ফ্রান্স এবং মরক্কোর জয়ীদের সঙ্গে।
সত্যি কথা বলতে কী, আর্জেন্তিনা প্রথম আধ ঘন্টার পর যে ফুটবলটা খেলল তাতে ক্রোয়েশিয়া তো বটেই ফ্রান্স কিংবা মরক্কোও ভয় পাবে। প্রথম ৩০ মিনিট দু পক্ষেই সমান তালে পাল্লা দিয়েছে। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলেছিল লুকা মদ্রিচের দল। এদিন কিন্তু তারা প্রথম থেকেই অ্যাটাকিং ফুটবল খেলতে থাকে। কিন্তু আর্জেন্তিনার ডিফেন্ডারদের সঙ্গে লড়াইয়ে গোলের দরজা খুলতে পারেনি। রাইট বাক মোলিনা তো ওরই মধ্যে বার বার ওভারল্যাপে উঠেছেন। ইদানিং তো ওভারল্যাপ দেখাই যায় না। সেই কাফু যেতেন ওভরল্যাপে। তারপর এই মোলিনা। অ্যাটাকের পাশাপাশি বেশ আঁটোসাঁটো ছিল আর্জেন্তিনার ডিফেন্স। নিকোলাস ওটেমন্ডির নেতৃত্বে নীল-সাদা ডিফেন্স ছিল যেন একটা দুর্গ, যার কোনও ছিদ্র ছিল না। ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলারদের বয়স বেশি। তাদের বেশির ভাগ ছেলেরই বয়স তিরিশের বেশি। আর আর্জেন্তিনার ঠিক উল্টো। মেসি ছাড়া বাকিদের বয়স তেইশ থেকে সাতাশের মধ্যে। এই অ্যাডভ্যান্টাজকে কাজে লাগাল তারা। গতি, গতি এবং স্রেফ গতিতে বাজিমাৎ করল আর্জেন্তিনা। ডিফেন্স করার সময় যেমন চার পাঁচজনে একত্র হয়ে গেল, অ্যাটাকের সময়ও তাই। এ যেন এক নতুন আর্জেন্তিনা। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হারার পর প্রতি ম্যাচে উন্নতি করেছে লিওনেল স্কালোনির দল। সেমিফাইনালে তো দাঁত ফোটাতে দিল না ক্রোয়েশিয়াকে। গত বারের রানার্স লুকা মদ্রিচরা যতই সেমিফাইনালিস্টদের তকমা নিয়ে টুর্নামেন্ট ছাড়ুক না কেন, এবার তাদের জন্য বলার মতো কিছু নেই। কী করে যে টিমটা সেমিফাইনালে গেল তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
প্রথম আধ ঘন্টার পর দাপট বাড়তে লাগল আর্জেন্তিনার। তাদের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল এবার তারা গোল করবে। এবং করলও। বাইশ বছরের জুলিয়েন আলভারেজ বক্সের মধ্যে ঢুকে যখন গোলকিপার লিভাকোভিচকে টপকাতে যাবেন তখন উপায় না দেখে ক্রোট গোলকিপার তাঁকে ট্রিপ করলেন। পেনাল্টি নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। মেসি গোলটা করলেন গোলকিপারের বাঁ দিকে উঁচু শটে। ৩৪ মিনিটের এই গোলটার পর পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দ্বিতীয় গোল জুলিয়েন আলভারেজের। একটা সোলো রান সমাপ্ত হল গোলের মধ্য দিয়ে। প্রথমে জুরাকোভিচকে শরীরের মোচড়ে হারানো, তার পর বোর্না সোসা এবং লিভাকোভিচকে টপকে গোল করলেন জুলিয়েন আলভারেজ। এই বিশ্ব কাপের অন্যতম সেরা গোল। বিরতির আগে দু গোল হয়ে গেলে এই ধরনের ম্যাচে আর কিছু থাকে না। কিন্তু আর্জেন্তিনার গোল ক্ষুধা তো তাতে কমবার কথা নয়। এবং ৬৯ মিনিটে এল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। ঘাড়ের কাছে ডিফেন্ডারদের নিয়ে দ্রুত গতিতে বল নিয়ে উঠলেন মেসি। এবং উঠতে উঠতেই দেখে নিলেন ফাঁকায় দাঁড়ানো আলভারেজকে। এর পর তাঁর মাপা পাস গিয়ে পড়ল আলভারেজের পায়ে। দিনটা তো মেসির মতো তাঁরও ছিল। গোল করতে ভুল করেননি আর্জেন্তিনার ৯ নম্বর।
অতএব ২০১৪-র পর আবার ২০২২-এ বিশ্ব কাপের ফাইনালে আর্জেন্তিনা। সেবার গ্যালারিতে ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। এবার তিনি নেই। তাঁর অকাল প্রয়াণের পর এই প্রথম বিশ্ব কাপ। এবং মনে হচ্ছে মেসিরা কাপটা জিতেই তাঁকে প্রণাম জানাবেন। ভুলে গেলে চলবে না আর্জেন্তিনার শেষ বিশ্ব কাপ জয় তো মারাদোনার হাতেই। গুরুদক্ষিণা দেওয়ার শেষ সুযোগটা কি মেসি হারাবেন? মনে তো হচ্ছে, না।