২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। সিপিএম জমানায় (CPM Era) লাল হয়ে গিয়েছিল এক অজানা অখ্যাত গ্রামের পথ। গ্রামের নাম নন্দীগ্রাম (Nandigram)। ১৬ বছর আগে আজকের এই দিনে সামান্য এক কৃষক আন্দোলনকে (Farmer’s Protest in Nandigram) কেন্দ্র করে গোটা বিশ্বের নজরে চলে এসেছিল এই জনপদ। ১৪ জন তাজা মানুষের মৃতদেহ আর অসংখ্য মহিলার ধর্ষিতা শরীর সেদিনের সাক্ষী। রাজ্য রাজনীতির পালাবদলেরও বীজবপন হয়েছিল সেই দিনই। ২০১১ সালে তো সেই পালাবদলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছিল।
১৪ মার্চ, ২০০৭। কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেটের (Rubber Bullets) পর গ্রামবাসীদের (Villagers) দিকে তাক করে গুলি চালায় পুলিশ (Police)। মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১৪ জনের। নিখোঁজ আর আহতের (Missing and Injured) সংখ্যা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। ১৪ মার্চের প্লট তৈরি হয়েছিল তৎকালীন সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের (Lakshman Chandra Seth) একটি নোটিসকে কেন্দ্র করে। সেই নোটিসের (Notice) তারিখ ছিল ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৬। নন্দীগ্রামের জমিতেই ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠী (Salim Group, Indonesia) শিপ্ল গড়ে তুলবে। লক্ষ্মণ শেঠের নিয়ন্ত্রণাধীন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের তরফে ২০০৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর যে নোটিস জারি করা হয়, তার বিষয়বস্তু ছিল, নন্দীগ্রামের ২৫টি মৌজা ও খেজুরির ২টি মৌজা মিলিয়ে মোট ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করবে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। এর কিছুদিন আগে বাংলা উত্তাল হয়েছিল সিঙ্গুর (Singur) নিয়ে। তাই নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের নোটিস আগুনে ঘি ঢালল। তৃণমূল দাবি করে, কৃষকদের চাষের জমি নন্দীগ্রামে জোর করে কেড়ে নিতে চাইছে সরকার (Government)। এই দাবির পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় বিতর্ক (Controversy)।
আরও পড়ুন: Recruitment Scam | কুন্তল, শান্তুনুকে বহিষ্কার করল তৃণমূল
এরপর, এল ১৩ জানুয়ারি, ২০০৭। জ্বলে উঠল আগুন। লক্ষ্মণ শেঠের ওই নোটিসের বিরুদ্ধে জমির দাবি নিয়ে কালীচরণপুপ পঞ্চায়েত দফতরে সমবেত হন জমিরক্ষার আন্দোলনকারীরা। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে লাঠি চালায় পুলিশ। উত্তেজিত জনতা নন্দীগ্রামের একাধিক রাস্তা কেটে দেয়। সংঘর্ষ শুরু হয় নন্দীগ্রামের সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে। অবস্থা এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায় যে নন্দীগ্রামে সিপিএম সমর্থকরা (CPM Supporters) নদীর ওপারে খেজুরিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
৫ জানুয়ারি, ২০০৭: জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে তৈরি হয় ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি (Bhumi Uchhed Pratirodh Committee)’। সেই কমিটিকে সমর্থন জানায় তৃণমূল (TMC), কংগ্রেস (Congress) এবং এসইউসি (SUC)।
৭ জানুয়ারি, ২০০৭: স্থানীয় সিপিএম নেতা শঙ্কর সামন্তের (Shankar Samanta) বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ফের গুলি চলে নন্দীগ্রামে। মৃত্যু হয় ৫ জনের অনেকের অভিযোগ, সেদিন গুলি চলেছিল শঙ্কর সামন্তের বাড়ি থেকেই। এই ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee, Former Chief Minister of West Bengal) লক্ষ্মণ শেঠের হলদিয়া উন্নয়ন পরিষদের ওই নোটিসকে ভুল বলে মেনে নেন।
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭: লাগাতার সংঘর্ষ সিপিএম সমর্থক বনাম ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির। সিপিএম ক্যাডাররা গ্রামে গ্রামে মানুষের মনে ভয় ধরানো শুরু করে। সিপিএম দাবি করে, নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে মাওবাদীরা (Maoist)। এদিকে এই টালমাটাল পরিস্থিতিতেই নন্দীগ্রাম লাগোয়া খেজুরিতে সভা করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
১৪ মার্চ রক্তাক্ত নন্দীগ্রাম: ঠিক এর আগের দিন, ১৩ মার্চ তৎকলীন তৃমমূল বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) একটি চিঠি লেখেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। তাতে জানান, নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে পুলিশ। মানুষের মধ্যে ত্রাস ছড়াচ্ছে। এই জিনিস বন্ধ হওয়া দরকার। তার ঠিক পরদিনই নন্দীগ্রামে ঘটে যায় সেই ভয়ানক ঘটনা। ঘটনার পর প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, নন্দীগ্রামের কাটা রাস্তা মেরামত করতে যাচ্ছিল পুলিশ। কিন্তু বিরোধী দল এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির দাবি ছিল, এদিন জমি অধিগ্রহণ করতে এসেছিল প্রশাসন। তাই তার প্রতিরোধ হয়।
প্রতিরোধে ঝাঁটা, লাঠি, কাটারি নিয়ে সামিল হয়েছিলেন প্রায় ৫ হাজার সাধারণ গ্রামবাসী, যার নেতৃত্বে ছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। তেখালি ব্রিজ এবং ভাঙাবেড়া ব্রিজ নন্দীগ্রামের দু’ধারে। এই দু’দিক দিয়েই পুলিশ গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে। খণ্ডযুদ্ধ বাঁধে পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পুলিশ প্রথমে কাঁদানে গ্যাস (Tear Gas), রাবার বুলেটের পর গুলি চালায়। মৃত্যু হয় ১৪ জনের। আহত অগণিত, নিখোঁজ অসংখ্য। এই ঘটনা অন্য মাত্রা পায়, যখন ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। অভিযোগ ওঠে, নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীন ধর্ষিতা হন মহিলারা। সবক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে, তৎকালীন শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে, সেদিনের হাজারও পুলিশের সঙ্গে ছদ্মবেশে গ্রামে ঢুকেছিল চপ্পলধারী সিপিএম ক্যাডাররা (CPM Caders)। কিন্তু প্রাণ দিয়ে নন্দীগ্রামের মানুষ পুলিশ ও ক্যাডারদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করেন। অনেক জীবনের বিনিময়ে ব্যর্থ হয় পুলিশের সেদিনের অভিযান।
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী (Gopalkrishna Gandhi, Former Governor of West Bengal) এই নৃশংসতার তুলনা করেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের (Jallianwala Bagh Massacre) সঙ্গে। নন্দীগ্রামে সেদিন গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত ভুল বলে বলে পরবর্তীকালে মেনে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বাবু। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের জোয়ারে ভেসেই রাজ্যে লাল জমানার ইতি টেনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee, Chief Minister of West Bengal)। তারপর থেকে প্রত্যেক বছর এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে তৃমমূল। রাজনৈতিক মহলের মতে, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কৃতিত্ব এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এখন ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, সেদিনের আন্দোলনের রাশ কার হাতে ছিল, তা নিয়ে। কিন্তু একটা জিনিস বাস্তব। নন্দীগ্রামই সিপিএম’কে বাংলায় কার্যত শূন্য করে ছেড়েছে। রাজ্যের রাজনৈতিক মসনদে পরিবর্তন হয়ত ঘটেছে ২০১১ সালে। কিন্তু তার বীজবপন হয়েছিল ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ।
আজকের নন্দীগ্রামে বিরাট শহীদ বেদি হয়েছে। সেই সময়কার কর্মীদের অনেকেই এই ক’বছরে নেতা হয়েছেন। অধুনা এই নেতাদের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি হয়েছে, যা দেখে ক্রুদ্ধ হন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু নন্দীগ্রামের ক্ষতে প্রলেপ পড়েছে কি? নন্দীগ্রামের মানুষ কি মনে রেখেছেন শহীদদের? সেদিনের অপরাধীদের অনেকেই আজ শাসকদলে। অনেকেই আজ মুক্ত। অথচ আজও জবাব খুঁজে চলেছে নন্দীগ্রাম।