সে আজ থেকে ৪৫ বছর আগেকার কথা। কিন্তু চোখ বুঁজলে যেন মনে হয় পঁয়তাল্লিশ দিন আগের ঘটনা। হঠাৎই খবরের কাগজে বেরোল সেই অপ্রত্যাশিত খবর। ফুটবল সম্রাট পেলে আসছেন কলকাতায়। নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবের জার্সিতে তিনি খেলবেম মোহনবাগান ক্লাবের বিরুদ্ধে। সবুজ মেরুনের কিংবদন্তী সচিব ধীরেন দে–র ব্যাক্তিগত উদ্যোগে কসমস ক্লাব আসছে কলকাতায়। সেই ক্লাবে তখন শুধু পেলেই নন, আছেন জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার, ইতালির চিনাগ্লিয়া এবং পেলের শেষ বিশ্ব কাপ জয়ের ক্যাপ্টেন কার্লোস আ্যালবার্তো। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে একটা নামই যথেষ্ট। পেলে। ম্যাচের দিন ধার্য হল ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। খেলা হবে ইডেন গার্ডেন্সে।
বলাই বাহুল্য, পেলে আসার খবরে সব ফুটবল প্রেমীরই আগ্রহ একটা টিকিট জোগার করে মাঠে ঢোকার। তখন এই কলমচি বি এ ক্লাসের তৃতীয় বছরের ছাত্র। টিকিট জোগার করার সামর্থ্য কম। এদিকে মোহনবাগান ক্লাব ঘোষণা করেছে, প্রত্যেক সদস্যকে দুটো করে টিকিট দেওয়া হবে। একটি টিকিট ৬০ টাকার, অন্যটি ৩০ টাকার। পাড়ার এক দাদার একটা সদস্য কার্ড ছিল মোহনবাগানের। সেই কার্ডটা করে দিয়েছিলাম আমি। তা তিনিই দয়াপরবশ হয়ে আমাকে ৩০ টাকার টিকিটটা দিয়ে দিলেন। আকাশের চাঁদ হাতে পেলেও যে রকম আনন্দ হয়, তার চেয়েও বেশি আনন্দ হল ওই টিকিটটা পেয়ে। ম্যাচের দিন যত এগিয়ে আসছে, টিকিটের দাম তত বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত কাগজে দেখলাম, ৬০ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকায়। পেলেকে মাঠে দেখবার জন্য ওইটুকু খরচ ফুটবলের শহর করতে পিছপা হচ্ছে না।
সেপ্টেম্বর মাস। আকাশে কালো মেঘ। কদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। ইডেন গার্ডন্সের এঁটেল মাটির কাদায় মাঠে পা ফেলা দায়। সেই ম্যাচটা ছিল পেলের জীবনের শেষ ম্যাচের আগের ম্যাচ। তার কদিন পরেই নিউ ইয়র্কে পেলে খেলেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ ফুটবল ম্যাচ। প্রথমার্দ্ধে স্যান্টোসের হয়ে। বিরতির পর কসমসের হয়ে। আসলে আন্তর্জাতিক ফুটবল যত দিন খেলেছেন পেলে, তাঁকে ব্রাজিল সরকার বিদেশে খেলতে দেয়নি। ব্রাজিল সরকার পেলেকে জাতীয় সম্পত্তি বলে ঘোষণা করেছিল। তাই নিজের জীবনের দুরন্ত ফর্মে পেলে ইউরোপে খেলতে পারেননি। সারা জীবন তাঁকে স্যান্টোসের হয়েই খেলতে হয়েছে। তবে ১৯৭০–এর বিশ্ব কাপের পর পেলে বলে দিলেন দেশের জার্সিতে আর তিনি খেলবেন না। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ হয়নি। জন্মই তো ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। আর সত্তরের বিশ্ব কাপ ফাইনাল হয়েছিল জুলাই মাসে। তা তিরিশে পা দেওয়ার আগেই তিনটে বিশ্ব কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে, জুলে রিমে কাপ চিরদিনের জন্য ব্রাজিলে নিয়ে গিয়ে পেলে গিয়েছিলেন কসমসে খেলতে।
আর কলকাতায় ছিল তাঁর কসমসের হয়ে শেষ পুরো ম্যাচ। কিন্তু বৃষ্টির জন্য ইডেনের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে পেলের সঙ্গে যে সব ইনসিওরেন্সের কর্তারা এসেছিলেন তারা রাজি হচ্ছিলেন না ওই রকম মাঠে পেলেকে খেলার অনুমতি দিতে। শেষ পর্যন্ত কলকাতাকে বাঁচিয়ে দিলেন পেলেই। বললেন, এত আবেগ যেখানে সেখান থেকে তিনি না খেলে যাবেন না। ম্যাচ ছিল বিকেল তিনটেয়। আমরা মাঠে ঢুকে গেলাম দুপুর দেড়টায়। এখনও মনে আছে আমাদের গেট নম্বর ছিল ১৬। মোহনবাগানের কোচ তখন প্রদীপ ব্যানার্জি। পেলেকে রোখার জন্য তিনি দুজনকে দায়িত্ব দিলেন। মহম্মদ হাবিব এবং গৌতম সরকার। এদের পিছনে ছিলেন স্টপার সুব্রত ভট্টাচার্য। তা সত্ত্বেও পেলে এই সব বাঁধা টপকে তিন বার গোল করার জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে গোল করতে দেননি গোলকিপার শিবাজি ব্যানার্জি। তিন বারই তিনি পেলের পা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বল তুলে নিয়েছিলেন। শেষ বার যখন বলটা ঝাঁপিয়ে পড়ে শিবাজি তুলছেন তখন পেলে লাফ মেরে শিবাজির মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় শিবাজির মাথায় চাপড় মেরে তাঁর প্রশংসা জানিয়েছিলেন পেলে। অকালপ্রয়াত শিবাজি পরবর্তীকালে ঘরোয়া আড্ডায় সে কথা বলতেন বার বার। ম্যাচে পেলের কসমস প্রথমে গোল করলেও মোহনবাগান পর পর দুটো গোল করে ফেলে। গোল করেছিলেন মহম্মদ হাবিব এবং শ্যাম থাপা। শেষ দিকে পেনাল্টি থেকে কসমস গোল শোধ করেছিল। ম্যাচের ফল ছিল ২–২।
ম্যাচের শেষে গ্র্যান্ড হোটেলে মোহনবাগানের পক্ষ থেকে একটা পার্টিতে ফুটবলারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় পেলের। গৌতম সরকারের সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তখন পেলে বলে উঠলেন, “ইউ আর দ্যাট নাম্বার ফোর্টিন, হু ডিড নট আ্যালাউ মি টু প্লে।” সেই ছবিটা গৌতম এখনও তাঁর বাড়িতে রেখে দিয়েছেন সযত্নে। এর বছর নয়েক পরে ১৯৮৬ সালে গৌতম গিয়েছিলেন মেক্সিকোতে বিশ্ব কাপ দেখতে। নিজের খরচেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনালের টিকিট ছিল না। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে সংগঠকদের অফিসে গিয়ে তদ্বির করেন একটা টিকিটের জন্য। নিজেকে পরিচয় দেন ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে। কিন্তু অফিসের লোকেরা সেটা বিশ্বাস করছিলেন না। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে গৌতম পকেট থেকে ছবিটা বার করে দেখালেন। পেলের সঙ্গে তাঁর ছবি। এই ছবিতেই কাজ হয়ে গেল। একটা নয়, দুটো টিকিট পেয়েছিলেন তিনি। পেলে নামের এমনই জাদু।
(২)
পেলেকে এর পর দেখি ১৯৯৪ সালের আমেরিকা বিশ্ব কাপে। পেলে তখন ভিসা কার্ড মাস্টার কার্ডের অ্যাম্বাসাডার। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা বড় হোটেলে মাস্টার কার্ডের প্রেস কনফারেন্স। তাদের প্রতিনিধি হয়ে পেলে এলেন সাংবাদিকদের সামনে। সেই প্রথম পেলেকে এত কাছ থেকে দেখা। পরনে কালো ট্রাউজার, কালো কোট এবং কালো টাই। আমি সেবার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পেলের আত্মজীবনী মাই লাইফ আ্যান্ড দ্য বিউটিফুল গেম বইটি। যদি সুযোগ হয় তাহলে পেলের একটা অটোগ্রাফ করিয়ে রাখব। যেটা হবে আজীবনের সম্পদ। প্রেস কনফারেন্সের সময় আমার ব্যাগে রয়েছে পেলের সেই বই। এত কাছে পেলে, এবার তো সই মিলবেই। একটু কাডেফরপরেই পেলে সেবারের বিশ্ব কাপের মাস্টার কার্ডের সেরা একাদশ ঘোষণা করলেন। এবং তার পর সাংবাদিকের সঙ্গে শুরু করলেন আড্ডা। এই ফাঁকে আমি সেরা একাদশটা ফোনে অফিসে ধরাতে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম পেলে চলে গেছেন। সারা জীবনের মতো একটা আফসোস থেকে গেল। সেই আফসোসটা মিটল ২০১৫ সালে যখন পেলে দ্বিতীয় বারের জন্য কলকাতায় এলেন। তখন তিনি বৃদ্ধ। বয়স ৭৫। হাতে ওয়াকিং স্টিক। প্রথমে বাই পাসের ধারে একটা সাংবাদিক সম্মেলনে এবং পরে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পেলের সংবর্ধনায় যে পেলেকে দেখলাম তাঁকে দেখে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। তবে আমার সহকর্মী সঙ্গীতা দে-র ব্যবস্থাপনায় পেলের দ্বিতীয় আত্মজীবনী পেলে-তে একটা অটোগ্রাফ পাওয়া গেল। বইটির প্রচ্ছদেই রয়েছে পেলের অটোগ্রাফ। সাত রাজার ধন এক মানিক।
পেলের সঙ্গে আবার দেখা হল প্যারিসে। ১৯৯৮ -এর ফ্রান্স বিশ্ব কাপের সময়। প্যারিসের গরমকালে সূর্য অস্ত যায় রাত নটায়। আর কলকাতায় আমাদের খবর পাঠাতে হত রাত সাড়ে আটটার মধ্যে। প্যারিসে তখন বিকেল পাঁচটা। মাথার উপর গনগনে সূর্য। তা সেদিন ছিল শনিবার। আমরা প্যারিসের উত্তরে গ্র্যান্ড স্লাম সেন্টার রোলাঁ গারোতে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে গেলাম পাশের প্যারিস সাঁ জাঁমা ক্লাবের আর্কাইভ দেখতে। আমার সঙ্গী ছিল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ক্রিস্তোফ রেমি। ওর ডাক নাম কুশল। ওর বাবা ফরাসি, মা সুদীপ্তা বাঙালি। কুশলই আমার দোভাষী। মেসি-নেমারদের ক্লাবের সামনে গিয়ে শুনলাম সেদিন ক্লাবে ঢোকা যাবে না। কারণ রাতে আছে ব্রাজিলের কার্নিভাল। প্যারিসের ক্লাবে তখন খেলতেন রাই, যিনি আগের বিশ্ব কাপে ব্রাজিলের অধিনায়ক ছিলেন। কুশল জানতে চাইল কার্নিভালে প্রবেশ মূল্য কত। ওরা বলল দুশো ইউরো। দরদস্তুর করে দুজনের জন্য তিনশো ইউরোতে রাজি হল। গ্যালারিতে ঢুকলাম। কিন্তু যেখানে কার্নিভাল হচ্ছে সেটা মাঠের এক ধারে। আমাদের গ্যালারি থেকে অনেক দূরে। যাই হোক মাঠে ঢোকার প্রহরীকে ম্যানেজ করে অনেকের চোখ এড়িয়ে আমরা চলে গেলাম স্টেজের সামনে।
রাত নটায় শুরু হল কার্নিভাল। ব্রাজিলের নাচ গান। হঠাৎ ঘোষিকা ঘোষণা করলেন এবার আমাদের সামনে আসছেন পেলে, পেলে, পেলে। মনে হল ঠিক শুনছি তো। কিন্তু মিনিট খানেকের মধ্যেই স্টেজে এলেন পেলে। সেই কালো কোত, কালো ট্রাউজার। এবং এ বার বো টাই। শুরু হল গান ওলে, ও–লে, ও–লে, ও লে। আর পেলে শুরু করলেন নাচতে। একটার পর একটা সুন্দরীর সঙ্গে গানের তালে তালে চলছে পেলের নাচ। ব্যাপারটা চলল প্রায় আধ ঘন্টা। এর পর আর কার্নিভাল দেখার জন্য আমরা থাকিনি। সেই রাতের স্মৃতি সারা জীবন মনে থাকবে।
২০১২ সালে গিয়েছিলাম ব্রাজিলে। প্রথমে রিও দে জেনেইরো। তার পর সাও পাওলো। এই শহরেই পেলে থাকতেন। এই শহরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন। কালান্তক কোলন ক্যানসার তাঁকে ছিনিয়ে নিল। এক মাস লড়েও পারলেন না ফিরে আসতে। এই শহরের স্যান্টোস ক্লাবেই তিনি খেলে গেছেন সারা জীবন। স্যান্টোস ক্লাবে যাব না তা কি হয়। গেলাম স্যান্টোসে। মাঠটা ছোট। অনেকটা আমাদের মহমেডান মাঠের মতো। স্যান্টোসের জার্সিও সাদা কালো, মহমেডানের মতো। পেলেদের ড্রেসিং রুমে ঢোকবার সুযোগ হল। এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে পেলের লকার। রয়েছে পেলের চেয়ার, যে চেয়ারে বসে তিনি ম্যাচের আগে এবং পরে বিশ্রাম নিতেন। এই মাঠ চেনে তাঁর সব কিছু। শুনলাম, এই স্যান্টোস ক্লাবেই হবে তাঁর স্মরণ সভা। এখান থেকেই মিছিল করে তাঁকে সমাহিত করা হবে।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর চলে গেছেন দিয়েগো মারাদোনা। এবার ২০২২-এর ২৯ ডিসেম্বর চলে গেলেন পেলে। মর্তের সীমানা ছাড়িয়ে অমর্ত্যলোকে চলে গেলেন গত শতাব্দীর দুই সেরা ফুটবলার। রাজপুত্র আগেই গেছেন। এবার চলে গেলেন সম্রাট। গত শতাব্দীর ফুটবলটা এবার সত্যিই অতীত হয়ে গেল। এখন সবই বর্তমান।