'স্টেডিয়ামে ঢুকেই পিলে চমকে উঠল আমার। দেখলাম, অনুষ্ঠানস্থলে বহু খালি চেয়ার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। মূল মঞ্চের কাছে ঘন ভিড় থাকলেও সহজেই একটি চেয়ার পেয়েও গেলাম। এদিকে, মঞ্চের অন্যদিকে প্রথম স্তরের দর্শকাসন অর্ধেক খালি। দ্বিতীয় এবং চতুর্থ স্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু লোক বসে আছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক আসনই খালি রয়েছে ওই এলাকায়। যা দেখে অবাক হওয়ার কিছু বাকি রইল না।' অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আয়োজিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুষ্ঠানের বর্ণনায় কথাগুলি লিখেছেন 'দ্য ওয়্যারের' বিবেক আসরি নামে এক অস্ট্রেলীয় লেখক এবং সাংবাদিক।
সপ্তাহখানেক ধরে তিন দেশ সফর শেষ করে বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতের মাটিতে পা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। এই সফরকে ঘিরে ভারত সরকার মোদিকে নিয়ে ঢক্কানিনাদ করলেও প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। শুধু তাই নয়, মোদি ভজনায় প্রাণমন ঢেলে দেওয়া এদেশের সাংবাদিককুল কীভাবে এই অনুষ্ঠানের লাইভ বর্ণনা করেছেন তাও উঠে এসেছে আসরির লেখায়। দেশের প্রচারসর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল যেভাবে গদগদ হয়ে বিদেশের মাটিতে ভারতের মাহাত্ম্য কীর্তন করেছে, তা যে অন্তঃসারশূন্য ফাঁকা আওয়াজ, তার ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
আরও পড়ুন: Calcutta High Court | বদল হল কলকাতা হাইকোর্টের রোস্টার
মোদির এই অনুষ্ঠানকে নিয়ে কয়েক মাস আগে থেকেই বিজেপির প্রচার-মোসাহেবরা বাজনা বাজিয়ে এসেছে। বিনামূল্যে টিকিট দেওয়া হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নাম নথিভুক্তির জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের তৎপরতা ছিল দেখার মতো। তা সত্ত্বেও টিকিট বণ্টনের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার চাদর ঢেকে রাখা হয়েছিল। কেউ জানতে পারছেন না, কে বা কারা টিকিট পাচ্ছেন। গোটা অনুষ্ঠানকে এক গোপনীয়তার মোড়কে রাখা হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মোদির অনুষ্ঠান প্রায় ৯ বছর পর হল। আর তাকে ঘিরে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে টানা প্রচার চলছে। এর আগের অনুষ্ঠানে 'ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি' নামে একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন খুবই সক্রিয় ছিল। এবার তারা প্রায় উধাও থাকায় সকলের নজর কাড়ে। বিশেষত তাদেরই প্রাক্তন সভাপতি সিডনির সাম্প্রতিকতম ধর্ষণকাণ্ডে জঘণ্য ধর্ষণকারীর তকমা পায় অস্ট্রেলিয়ার আদালতে। আদালত তাকে একাধিক মহিলাকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর থেকেই ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি কোথায় গেল তা একটি চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে।
গত এপ্রিল মাস থেকে 'অস্ট্রেলিয়া ওয়েলকামস মোদি' এই নামে হোয়াটস অ্যাপে বন্যা শুরু হয়। সেখানে জানানো হয় যারা ইচ্ছুক তারা নাম নথিভুক্ত করে টিকিট সংগ্রহ করতে পারে। আচমকাই ইন্ডিয়ান অস্ট্রেলিয়ান ডায়াসপোরা ফাউন্ডেশন নামে অভিবাসী ভারতীয়দের একটি সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এই সংগঠনের উদ্যোক্তা এবং ওয়েবসাইটটি কাদের সে সম্পর্কে তথ্য ছিল না। শেষমেশ জানা যায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে এটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।
বাস্তব প্রেক্ষিত হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় মোদিভক্তের সংখ্যা কম হওয়ার কথা নয়। আইএডিএফের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩৫০টি ভারতীয় অভিবাসী সংগঠন নাম নথিভুক্ত করে। অনুষ্ঠানের দু সপ্তাহ আগে তারা ঘোষণা করে ২০ হাজারের বেশি মানুষের ভিড় হওয়ার আশা করছে তারা। যদিও স্টেডিয়ামের সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা ১৮ হাজার ৫০০। ফলে বোঝাই যায়, সাধারণ মানুষ কিংবা কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন, এমন কেউ মোদির অনুষ্ঠানে ঢুকতে পারবেন না। তারা বলে, স্টেডিয়ামের বাইরে জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হবে, যাতে সাধারণ মানুষ মোদিকে দেখতে পান। সংবাদ মাধ্যমের ভিতরে-বাইরে ঘোরাফেরায় কোনও বাধা ছিল না। এমনকী যতজন খুশি সহকর্মী নিয়ে আসার অধিকার ছিল সংবাদমাধ্যমের।
আসরি লিখেছেন, 'ঢোকার আগে ভেবেছিলাম আমাকে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে। যদি বসতেও পাই, তাহলে আর উঠতে পারব না। কারণ উঠলেই যদি চেয়ার চলে যায়। কিন্তু, ঢুকেই অবাক হওয়ার পালা। হলের অর্ধেক অংশই ছিল খালি। এমনকী ভিআইপি লেখা এলাকাতেও অনেক চেয়ার খালি ছিল। আমার পাশে থাকা একজন বললেন, গত মাসে একটি মন্দিরের উৎসবেও এর থেকে ভিড় বেশি হয়েছিল।'
'মঞ্চে একজন বললেন, ২৫ হাজার মানুষ এসে গিয়েছেন। ডেইলি মেইলের এক সাংবাদিক আমার চোখে চোখ রেখে হাসলেন। আমিও হেসে প্রত্যুত্তর দিলাম।' আসরির বর্ণনায়, ভারতীয় সাংবাদিকরা তখন লাইভে বলে চলেছেন, স্টেডিয়াম খচাখচ ভরা হুয়া হ্যায়। কিংবা জ্যাম প্যাকড অথবা ইলেকট্রিফাইং। দর্শকাসন থেকে ধ্বনি উঠছে মোদি, মোদি। একধারে ভোরা সম্প্রদায়ের একদল লোক পরম্পরাগত পোশাক পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি। অনুষ্ঠানে গুটিকয় শিখ সম্প্রদায়ের লোক এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় যেখানে প্রায় ১০ লক্ষ ভারতীয় বসবাস করেন, সেখানে সাড়ে ১৮ হাজারের স্টেডিয়ামেও মোদির ভাষণ শুনতে লোক সমাগম হয়নি।
তবে অস্ট্রেলিয়া সরকারের তাবড় মন্ত্রীরা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানেজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে 'দি বস' বলে সম্বোধন করেন। যা নিয়ে আলবানেজ নিজের দেশেই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকরা মোদির মতো উদ্ধত প্রকৃতির রাষ্ট্রনেতার উদ্দেশে এহেন মন্তব্য করা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইলে অস্বস্তিতে পড়েন আলবানেজ। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম এই অনুষ্ঠানের সংবাদে ভারতে মানবাধিকার ভঙ্গের বিষয়টি তুলে ধরেছে।
বিবেক আসরি সবশেষে লিখেছেন, 'যখন ফিরছিলাম, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপরিচিত অস্ট্রেলীয় মহিলা জানতে চাইলেন আমি মোদির অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম কি না। তিনি নিজেই বললেন, ব্রিসবেন, ক্যানবেরা এবং মেলবোর্ন থেকে চার্টার্ড বাস ভর্তি করে লোক আসা দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছেন। এমনকী চলতি ভাষায় 'মোদি এয়ারওয়েজ' ডাকনামের বিমানেও লোক এসেছে দেখে তিনি বিস্মিত। মহিলার কথায়, কিন্তু আমি শুনেছি যে, সেদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নাকি মোদি অত্যন্ত কঠোর মনোভাব নিয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ভারতের অনেক মানুষ নাকি মোদিকে অপছন্দও করেন!
শেয়ার করুন