কলকাতা: আর দু’দিন পর গুজরাত(Gujarat), হিমাচল প্রদেশের (Himachal Pradesh) বিধানসভা ভোটের (Assembly elections) ফল প্রকাশ (results) হবে। বুধবার ফল প্রকাশ হবে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অফ দিল্লিরও (municipal corporations of Delhi)। কয়েকটি উপনির্বাচনেরও ফলাফল জানা যাবে ৮ ডিসেম্বর। বুথ ফেরত সমীক্ষায়(exit polls) বিভিন্ন সংস্থা গুজরাতে বিজেপিকে (BJP) অনেক এগিয়ে রেখেছে। হিমাচলে কংগ্রেস (Congress) এবং বিজেপির মধ্যে সমানে সমানে টেক্কা চলেছে। বুথ ফেরত সমীক্ষায় (exit polls ) দুই দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। দিল্লির পুরভোটে অবশ্য সব সমীক্ষাতেই আম আদমি পার্টিকে (Aam Admi Party) অনেক এগিয়ে রাখা হয়েছে।
গুজরাতে বিজেপির জয় হওয়ার মানে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi), অমিত শাহের (Amit Shah) দাপট আরও বাড়বে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের (2024 Loksabha elections) আগে বিজেপির হিন্দুত্বের (hinduism) ধ্বজা আরও বেশি করে উড়বে। আগামী বছর বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটেও যে বিজেপি কট্টর হিন্দুত্বের তাস খেলবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন: মোদি-শাহের বিরুদ্ধে কমিশনে বিধিভঙ্গের নালিশ জানাতে পারে কংগ্রেস
এরকম একটা আবহের মধ্যে মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার (Babri Masjid demolition) ৩০ বছর পূর্তি দিবস। এক কথায় যা কালা দিবস বলে পরিচিত। আজ থেকে ৩০ বছর আগে এই দিনেই হাজার হাজার উন্মত্ত হিন্দু করসেবক (karsevaks) অয়োধ্যার (Ayodhya) বাবরি মসজিদ একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। করসেবকদের সেই তাণ্ডব বসে বসে সেদিন উপভোগ করেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি (Lal Krishna Advani), মুরলী মনোহার যোশী (Murli Manohar Joshi), অশোক সিঙ্ঘল (Ashok Singhal), উমা ভারতীর (Uma Bharti )মতো বিজেপি নেতারা। উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্ভরা (Sadhvi Ritambhara) প্রমুখ স্লোগান তুলেছিলেন, এক ধাক্কা আউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো (Ek dhakka aur do, Babri Masjid tod do)। আপামর বিশ্ববাসী সেদিন টিভির পর্দায় দেখেছিলেন উন্মত্ত গেরুয়া বাহিনীর নৃশংস উল্লাস।
তারপর গঙ্গা, যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে বিপক্ষে বহু মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) বাবরি ভাঙার কাজকে অবৈধ বলে আখ্যা দিয়েই দায় সেরেছে। শীর্ষ আদালত অযোধ্যার বিতর্কিত সমস্ত জমি রাম মন্দির (Ram Mandir) তৈরির জন্য সরকারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টের হাতে তুলে দিতে বলে। তারও পরে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাবরি মামলায় অভিযুক্ত আদবানি, যোশী, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী-সহ ৪৯ জনকেই বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত (Special CBI court in Lucknow)। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মামলা চলতে চলতে অভিযুক্ত অনেকেই মারা গিয়েছেন। এত বড় অপরাধের পরেও কী করে আদালত আদবানিদের মুক্তি দিল, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্নও ওঠে। ওই বিশেষ আদালত বলে, বাবরির ধাঁচা ধ্বংসের পিছনে আদবানিদের কোনও হাত ছিল না। গোটা ঘটনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষ। আদালতের দাবি, আদবানিরা বরং মসজিদ ভাঙার বিরোধিতা করেছিলেন। বাবরি ভাঙার পিছনে সমাজবিরোধীদের ভূমিকা ছিল।
আরও পড়ুন: নাবালিকার সম্মতি আইনের চোখে সম্মতি নয়, ধর্ষণের মামলায় জামিন নাকচ অভিযুক্তের
বস্তুত, সেদিন থেকেই বিজেপি সচেতনভাবে ভারতের মতো একটা ধর্মনিরপেক্ষ বিশাল দেশকে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী মৌলবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপর থেকে বিজেপির হিন্দুয়ানি ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও বিজেপি তার হিন্দুত্বের তাস হাতছাড়া করতে রাজি নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে, ততই বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্বের (BJP-RSS) আস্ফালন বাড়ছে। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (minority community) এই হিন্দু আস্ফালনের দাপটে দিন কাটাচ্ছে।
অনেকেই বলেন, সেই সময় কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও (Congress PM PV Narasimha Rao) কড়া মনোভাব দেখালে হয়ত বাবরি ভাঙা এড়ানো যেত। ১৯৯২ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠকে প্রয়াত সিপিএম নেতা এবং তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু (Jyoti Basu) এবং হরকিষেণ সিং সুরজিত (Harkishen Singh Surjeet) প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে কল্যাণ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। রাও দুই কমিউনিস্ট নেতাকে জানান, হিন্দুত্ববাদীরা সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বস্ত করেছে কোনও হাঙ্গামা হবে না। শান্তি বজায় রাখা হবে। দিনের শেষে দেখা গিয়েছিল, কীরকম শান্তিপ্রিয় ছিল সেদিনের করসেবকরা।
আরও পড়ুন: নাবালিকার সম্মতি আইনের চোখে সম্মতি নয়, ধর্ষণের মামলায় জামিন নাকচ অভিযুক্তের
সাধে কি প্রয়াত জ্যোতিবাবু বিজেপিকে অসভ্য(savage) এবং বর্বর(barbarian) আখ্যা দিয়েছিলেন? ১৯৯৯ সালের ২০ মার্চ এনডিএ (NDA) সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী (Ata Behari Bajpayee) বাজপেয়ী কলকাতায় এসেছিলেন। রাজভবনে (Raj Bhavan) তিনি জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। তখন বাজপেয়ী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি সব সময় বিজেপিকে অসভ্য, বর্বর বলেন কেন। জবাবে জ্যোতিবাবু বলেন, যারা বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়, তারা অসভ্য, বর্বর ছাড়া কী। বাজপেয়ী বলার চেষ্টা করেছিলেন, এটা একটা দুর্ঘটনা। কোনও সংগঠিত অপরাধ (organised crime) নয়।
আজ জ্যোতিবাবু নেই, নেই বাজপেয়ীও। বেঁচে থাকলে জ্যোতিবাবু আজও বিজেপিকে অসভ্যই বলতেন। আদবানি, যোশী, উমা ভারতীরা অবশ্য বেঁচে রয়েছেন। গত ৩০ বছরে বিজেপি-আরএসএসের অসভ্যতা আরও বেড়েছে। হিন্দুত্বের আগ্রাসন বিজেপির আরও তীব্র হয়েছে। গুজরাত বিজয়ের পর তা যে আরও বাড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।