পুরুলিয়া: ‘ডন কো পাকড় না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়’।–জঙ্গলমহল এলাকায় কার্যত ছয় দিন ধরে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল বাঘিনী (Tigress) জিনাত (Zeenat)। ওই দেখা যায়-পরক্ষণেই তাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনটি রাজ্যের বনদফতরের (Forest Official) কর্মীরা চিরুনি তল্লাশি করে শকুনের নজরে খুঁজছিলেন। কখনও ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে হালুম করে উঠছিল। ব্যস বনকর্মীরা সব সরঞ্জাম নিয়ে সেদিকে ছুটছিলেন। কিন্তু, ততক্ষণে জিনাত ১২ হাত লাফ দিয়ে পগারপাড়। বেলপাহাড়ি থেকে কখনও পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের পাহাড়ি এলাকায় উঠে রেলা দেখাচ্ছিল। বাঘে ছুঁলে কত ঘা ভেবে এলাকার বাসিন্দাদেরও আত্মারাম খাঁচাছাড়া দশা হয়েছিল। প্রাণভয়ে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক হয়েছিলেন তাঁরা। ছাগল, মোষ কোনও টোপই কাজে আসছিল না। ঘুম উড়েছিল এলাকাবাসীর। কখনও গ্রামের মেঠো পথ ধরে দাপিয়ে ছুটেছে। কখনও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দুর্দান্ত বেগে এগিয়েছে। ওড়়িশা-ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের যে পথ দিয়ে গিয়েছে সেই সব এলাকার বাসিন্দারা তটস্থ ছিলেন। বন কর্মীদের পাতা জাল, নাইলন দড়ি দিয়ে জঙ্গল ঘেরা, রেডিও কলার ট্র্যাক, ট্রাঙ্কুলাইজ করার পরিকল্পনা, আগুন জ্বালানো কোনও কিছুই কাজে আসছিল না। শীতের নিস্তব্ধতাকে লাথি মেরে জিনাতকে নিয়ে কোলাহলে উত্তপ্ত ছিল ওই সব এলাকা। কয়েক দিন ধরে সবাইকে ঘোল খাইয়ে অবশেষে রবিবার পড়ন্ত বিকেলে ঘুমিয়ে পড়ল অবসন্ন জিনাত। ব্যাঘ্রাচার্যের বৃহল্লাঙ্গুলের খেলা শেষ। নাটকীয় তেজ দেখানোর পর অবশেষে তিন রাজ্যের বন দফতরের উদ্যোগে বাঘ-বন্দি। বাঁকুড়ার (Bankura) গোঁসাইডিহির জঙ্গলে এদিন বিকেলে বনকর্মীদের ঘুমপাড়ানি গুলিতে তেজ কমে আসায় ধরা পড়ল সে। ওড়িশার সিমলিপাল থেকে যে উৎকণ্ঠার শুরু হয়েছিল ঝাড়খণ্ড, ঝাড়গ্রামের বেলাপাহাড়ি, পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, মানবাজার পেরিয়ে বাঁকুড়ায় তার অবসান হল। চারি দিকে কয়েকদিনের যে হৈচৈ চলছিল, তা যেন অতর্কিতে থেমে গেল। দাপিয়ে খেলা তিন বছরের জিনাত এখন শিশুর মতো তন্দ্রাচ্ছন্ন। এখন তাকে ওড়িশায় নিয়ে যাওয়া হতে পারে, তারই প্রস্তুতির তোড়জোড়।
সূত্রপাত নভেম্বরের ১৫ তারিখ। মহারাষ্ট্রের তাডোবা আন্ধেরি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে বছর তিনেকের জিনাতকে ওড়িশার সিমলিপালে আনা হয়। সেখান থেকেই ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়া রেঞ্জের রাজাবাসার জঙ্গল হয়ে চিয়াবান্ধি এলাকায় পৌঁছয়। ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি থানার কাটুচুয়া জঙ্গলে ঢুকে পড়ে সে। সেখান থেকে চলে যায় পুরুলিয়ার জঙ্গলে। শনিবার সকালে যায় গোঁসাইডিহি গ্রামে। রেডিয়ো কলারের সিগন্যাল ট্র্যাক করে জানা যায় মুকুটমণিপুর জলাধার লাগোয়া ছোট জঙ্গলে আছে জিনাত। বনকর্মীদের উদ্বেগ বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। এই পালিয়ে বেড়ানো পরিস্থিতিতে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের ছিল। কারণ উদ্ধার করতে গিয়ে বাঘের মৃত্যু ঘটেছে এর আগে এমনও হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এভাবে ভারতে একটি বাঘের মৃত্যু হয়। এমনকী হামলা থেকে বাঁচতে বাঘকে মেরে ফেলা হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের জঙ্গি জাভেদ মুন্সিকে ধরা রাজ্য পুলিশেরই সাফল্য, জানালেন ডিজি রাজীব কুমার
অবশেষ মধুরেণ সমাপয়েৎ। বাঘটিকে ঘুমপাড়ানি গুলি করা হলেও তার শারীরিক অবস্থা ভালো রয়েছে। হাসি ফুটেছে আশেপাশের বাসিন্দাদের মুখে। ব্যাঘ্রপ্রেমীরাও খুশি যে তাকে সুস্থ অবস্থায় ধরা সম্ভব হয়েছে। শুধু তো পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিই নয় কলকাতা থেকে কাকদ্বীপ, সকলেই চঞ্চল শৈশবের জিনাতকে ভালোবেসেও ফেলেছে এই কয়েক দিনে। প্রতি মুহূর্তে জিনাতের গতিবিধির নজর রাখছিলেন তাঁরাও।
দেখুন অন্য খবর: