নয়াদিল্লি: ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্প পড়ে বা উত্তম কুমার অভিনীত সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলেননি এমন কাউকে হয়তো পাওয়া যাবে না। সেখানে ভৃত্য রাইচরণের অসাবধানতায় তাঁর মালিক অনুকূলবাবুর শিশু সন্তানকে খোয়াতে হয়েছিল। বিবেকের তাড়নায় ভৃত্য রাইচরণ (উত্তম কুমার অভিনীত) নিজের ছেলেকে বহু বছর পরে আচমকাই হাজির হয়ে অনুকূলবাবুকে দিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, এটাই তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলে। তারপর অনুকূলবাবুর স্ত্রী কোনও প্রশ্ন, কোনও বিচার না করে কোলে বসিয়ে, স্পর্শ করে আঘ্রাণ নিয়ে, তার মুখ দেখে আনন্দে কেঁদে, হেসে ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভৃত্য রাইচরণ বলেছিলেন, এমন কাজের প্রমাণ কী করে থাকবে? আমি যে তোমার ছেলে চুরি করেছিলাম, সে কেবল ভগবান জানেন, পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। কিন্তু ভাগ্যিস তখন তো ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। মহৎ উদ্দেশ্যে মনিবের (মালিকের) পরিবারের অতৃপ্তি পূরণ করতে নিজের কোল খালি করে আত্মত্যাগ করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন ভৃত্য রাইচরণ। সিনেমা-গল্পের মতো উত্তরপ্রদেশের গায়িজাবাদে (Ghaziabad) এক যুবক দাবি করেছিল সে ওই পরিবারের ৩০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া শিশু (Lost Child)। তাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল পরিবারটি। কিন্তু, ঘটনাক্রমে সুখের সমাপ্তির পরতে পরতে আন্তঃরাজ্য ঘটনার চাঞ্চল্যকর রহস্য বেরিয়ে এল।
সংবাদমাধ্যমের সামনে ওই যুবককে জড়িয়ে ধরে আবেগপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছিল পরিবারের সদস্যরা। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় ঘরের বিছানায় ফুলপ্যান্ট পরে বাবু হয়ে বসে আদর যত্নে খাবার খাচ্ছে ওই যুবক। গোল করে তার মুখের দিকে অপত্য স্নেহে চেয়ে আছেন বাড়ির প্রবীণ সদস্যরা। কখনও বাড়ির গৃহবধূ ভাইয়ের ভালোবাসায় হাত জড়িয়ে ছবি তুলছেন। কিন্তু, ক্রমশ তার পাল্টে যেতে থাকা আচরণে কেমন যেন সন্দেহ হওয়ায় মন ভাঙতে থাকে পরিবারটির। পুলিশকে জানানোর পর ডিএনএ পরীক্ষা। তাতেই রহস্যের কিনারা। কিন্তু, তারপরে তদন্তে নেমে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। এইভাবে বহু পরিবারে আবেগপূর্ণ আচরণ করে চুরি করে পালিয়ে যেত সে। এবং এই কাজ সে করেছে আন্তঃরাজ্য জুড়ে। পঞ্জাব, হরিয়ানা, পঞ্জাবেও। সব জানতে পেরে যুবককে ভালোবেসে ফেলা গাজিয়াবাদের ওই পরিবারটিই এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ওই যুবকের ঠাঁই হয়েছে শ্রীঘরে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতের নাম ইন্দ্ররাজ ওরফে রাজু ওরফে ভীম। বাড়ি রাজস্থান। তবে সবাইকে অবাক করেছে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ও সে ভাবলেশহীন হয়ে প্যান্টের দুপকেটে হাত ভরে হাসতে হাসতে থানায় ঢুকেছে। তার শ্রীঘরে ঢোকার এই ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর কী প্রতিক্রিয়া দেওয়া হবে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যাওয়ার দশা কমেন্টবক্সে প্রতিক্রিয়াশীল নেট নাগরিকদেরও।
আরও পড়ুন: মাঝরাতে কেন খান স্যারকে আটক করেছিল পুলিশ?
গাজিয়াবাদের ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ নিমিশ পাটিল জানিয়েছেন, এক যুবক পুলিশের কাছে দাবি করে সে দীর্ঘকাল আগে হারিয়ে যাওয়া শিশু। অবশেষে বাড়ি ফিরে এসেছে। ১৯৯৩ সালে তার সাত বছর বয়সে অপহরণ করা হয়েছিল। সে নিজেই পুলিশের কাছে এসে বলেছিল, ৩০ বছর পর ফিরে এসেছে। মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় হারানো শিশু সম্পর্কে জানানো তথ্য অনুযায়ী ওই পরিবারকে খুঁজে পেতে পুলিশের সহায়তা চায়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে সরল-সাদা চালচলনের ওই যুবকের কথায় বিশ্বাস করে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তার জন্য খাবার ও কাপড়ের ব্যবস্থা করে। এরপর ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আসলে এটা ছিল তার মোডাস অপারেন্ডি। সে প্রায়ই বাড়িগুলিকে টার্গেট করে ডাকাতির জন্য এটা করত। পুলিশ তার প্রতারণামূলক ইতিহাস বের করেছে। তদন্তে জানা গিয়েছে, চুরি করার অভ্যাস থাকায় রাজুকে নিজের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সে আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের বাড়ি থেকেই চুরি করত। যে কারণে তার পরিবার তার উপর বিরক্ত হয়ে ২০০৫ সালে তাকে তাড়িয়ে দেয়। তারপর সে তার পরিচয় গোপন করে ওই কাজ করত। যখনই রাজু কোনও পরিবারকে দেখতে যেত, তখন সে তাদের কী সম্পত্তি আছে তা নিয়ে কথা বলত। রাজু অবশ্য পুলিশকে বলেছিল যে তার মায়ের মৃত্যুর পরে, সে বিনামূল্যে খাবারের জন্য অন্যের বাড়িতে থাকত। পুলিশ অন্তত পাঁচটি জায়গা নিশ্চিত করেছে যেখানে সে তার পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিল। সন্দেহ করা হচ্ছে আরও থাকতে পারে। ২০২১ সালে ধরা পড়ার পরে জেলেও গিয়েছিল সে। পঞ্জাব, রাজস্থানের জয়সলমের এবং হরিয়ানার হিসার, সিরসাতে একই ধরনের অপরাধ করেছিল। পুলিশ এখন তদন্তে অন্য রাজ্যে দল পাঠাবে। তার বিরুদ্ধে একটি জালিয়াতির মামলা দায়ের হয়েছে।
দেখুন অন্য খবর: