জয়জ্যোতি ঘোষ
২০১৭ সালে আগস্টের মাঝামাঝি। শহর কলকাতায় এক বিজ্ঞাপনী প্রচারে হঠাৎই হাজির বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা।ঝটিকা সফরের জন্য শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন এই অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার। এক সময়ের স্লেজ-মাস্টার বা মাইন্ডগেমের কারিগর বললেও অত্যুক্তি হবে না। শচীন থেকে সারওয়ান সবাই তাঁর স্লেজিং এর শিকার হয়েছিলেন একসময়। তবে ব্ল্যাক টি-শার্ট এবং ব্লু-জিন্সের এই ম্যাকগ্রা কিন্তু একেবারে অন্য মানুষ।ম্যাকগ্রা-কে যতটা আবিষ্কার করলাম তাতে বুঝলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যতই তিনি ৯৪৯ উইকেট নিয়ে থাকুন না কেন সবসময় মাটিতে পা রেখেই চলতে ভালোবাসেন। সবুজ গালিচার আগ্রাসী ম্যাকগ্রার সঙ্গে ব্যক্তি ম্যাকগ্রাকে এক করে ফেললে চলবে না। সেদিন দুপুরে সাংবাদিক হিসেবে একটা ছোট সাক্ষাৎকার পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু তাতে মন ভরল না। এত বড় ক্রিকেট তারকাকে এরপর এতকাছে পাবো কিনা জানা নেই। তাই ম্যাকগ্রাকে আরও ভালোভাবে জানার সুপ্ত বাসনা মনে মনে দানা বাঁধছিল। তাই সেই পাঁচতারা হোটেলের এক বিশ্বস্ত উচ্চপদস্থ দাদাকে অনুরোধ করি যে দেখুন না কোনও ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা যাতে আরও কিছুটা সময় ম্যাকগ্রাকে একান্তে পাওয়া যায়!
তিনি সপাটে বললেন-‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করছি।’ কিছুক্ষণ পরেই মোবাইল হঠাৎ ভাইব্রেট হয়ে উঠল। দেখলাম সেই দাদারই ফোন। ফোনের ওপার থেকে আওয়াজ আসল- ‘সন্ধ্যে ঠিক ৬ টায় হোটেলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করুন। তবে বুম-ক্যামেরা নিয়ে আসবেন না।’ বলেই ফোন কেটে দিলেন। আমি যে কিছু বলব সেটার সুযোগও পেলাম না। কথামত ঠিক সন্ধ্যা ৬ টায় গিয়ে হাজির আমি। আর দাদার দাক্ষিণ্যে সেই সন্ধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলাম ম্যাকগ্রার অন্দরমহলে। যে রুমে ম্যাকগ্রা বসেছিলেন সেখানে খুব বেশী আলো নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক রিল্যাক্সড মুডে রয়েছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। নিজে গ্লাসে রেড ওয়াইন নিয়ে আমাকেও অফার করলেন। কলকাতার আকাশে তখন সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। গো-ধূলি বেলা কাটিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
‘ভারতে যতবার এসেছি দারুণ অনুভূতি কাজ করেছে। ক্রিকেট নিয়ে ভীষণ প্যাশনেট এখানকার মানুষ। গত ২৪ বছর ধরে আসছি ভারতে। এই দেশ আমা্র কাছে রীতিমত সেকেন্ড হোম। আর ভারতে আসলে আমি রুমের এসি বন্ধ করে রাখতাম। ধীরে ধীরে ভারতীয় আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম-’ ভিন্ন মেজাজে বলে গেলেন ম্যাকগ্রা।
পাল্টা বললাম- ‘তবে ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগীরা বোধহয় আপনাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। কারণ একটাই-বহুবার শচীনকে সমস্যায় ফেলেছিলেন। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের ক্ষত এখনও যায়নি। প্রথম ওভারেই শতকোটির স্বপ্নভঙ্গ করেছিলেন আপনি…’
রেড ওয়াইনে গলা ভিজিয়ে হাসিমুখে ম্যাকগ্রা প্রত্যুত্তরে বললেন, “আপনাদের শচীনও তো আমাকে বহুবার সমস্যায় ফেলেছে। হি ইস জাস্ট এবসোলিউট জিনিয়াস। মনে রাখবেন শতাব্দীতে শচীনের মতো কমপ্লিট ব্যাটসম্যান একবারই জন্মায়।কী সব ইনিংস রয়েছে শচীনের নামের পাশে।এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শততম শতরান করার কল্পনাও কেউ করতেন না। শচীনের মত এত বড় মাপের ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে বল করা আমি নিজেও ভীষণ উপভোগ করতাম।”
– শচীন এবং লারা দুজন-কেই আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। দুই তারকা ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধেই বল করেছেন। দুজনেই একই সময়ের ক্রিকেটার। তাই তুলনাটা স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। আপনি এই দুজনের মধ্যে কাকে এগিয়ে রাখবেন?
– “দেখুন দুজনেই দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান। ব্রায়ান চার্লস লারা টেস্ট ক্রিকেটের বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান। তাঁর এক-একটি শট ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। টেস্টের শেষ দিনে যদি ৪০০-র কাছাকাছি টার্গেট চেজ করতে হয় তাহলে আমার বাজি অবশ্যই হবে ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’। তবে ওডিআই তে এগিয়ে রাখব শচীন-কে। ৯৮ এর শারজায় মরুঝড় কিংবা ২০০০ আইসিসি নক আউট টুর্নামেন্টে আমাকেও রেয়াত করেননি মাস্টার-ব্লাস্টার। প্রত্যেক ম্যাচে কিছু না কিছু গেমপ্ল্যান নিয়ে নামতাম শচীনের বিরুদ্ধে।কখনও সেটা খাটত কখনও বা না-” একনাগাড়ে বলে গেলেন ‘পিজিওন’।
শুনতে শুনতে চোখের সামনে অনেক পুরানো স্মৃতি ফ্ল্যাশব্যাকে ধরা পড়ল। শচীন-লারা-ম্যাকগ্রা এবং সঙ্গে রেড ওয়াইন সেই সন্ধ্যার মাদকতা যেন দ্বি-গুন বাড়িয়ে তুলেছিল।
একইসঙ্গে জানতে চাইলাম, বিরাট কোহলিকে আধুনিক শচীন বলা হয়। কতটা মিল খুঁজে পান দুজনের মধ্যে?
– “আমি দু’জনের মধ্যে তুলনা করতে চাই না। কোহলি খুব ভালো ব্যাটসম্যান। তবে শচীনের সঙ্গে তুলনা এখনই নয়। কোহলিকে শচীনের সমকক্ষ হতে গেলে আগামী বেশ কয়েক বছর একই ফর্মে খেলে যেতে হবে।”
হোটেলের মায়াবি আলোয় মনে হতে লাগল একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মের বোলার সেই প্রজন্মের ব্যাটসম্যানকেই সবসময় এগিয়ে রাখেন। লারউড কখনও ডন ব্র্যাডম্যানের উপর কাউকে স্থান দিয়েছেন বলে জানা নেই। স্বভাবতই ম্যাকগ্রা তাঁর স্টান্স বদলাবেন কেন?
আরেকটি প্রশ্ন না করলেই নয়। কিছুটা রসিকতার ছলেই করলাম। ক্রিকেটীয় কেরিয়ারে আপনি সবথেকে বেশী কাকে স্লেজিং করেছিলেন?
এবারে ম্যাকগ্রার মুখে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ধরা পড়ল। বললেন-‘স্লেজিং কী শুধু আমি একাই করি? অন্যান্য তারকা ক্রিকেটাররাও কিন্তু করে। কারও নাম সামনে আসে, কারও আসে না। বলতে পারেন এটা স্ট্র্যাটেজির একটা অংশ। স্লেজিং করেছি বটে, কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি। সারওয়ান যেটা আমার সঙ্গে করেছিল সেটা ব্যক্তিগত আক্রমণ।’(হাসি মুখে হঠাৎই বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট)
মনে মনে ভাবলাম এই প্রসঙ্গ আর বাড়ানো ঠিক হবে না। এখানেই ‘দ্য এন্ড’।
সাইন অফ করলাম শুধু একটা কথা বলে-‘ভাবী ম্যাকগ্রা হিসেবে কাউকে দেখছেন?’
-(উধাও হওয়া হাসি আবার ফেরৎ) ‘এভাবে বলবেন না। প্রত্যেক বোলারের কিছু বিশেষত্ব থাকে। সেই অনুযায়ী তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। বাধ্যবাধকতা নেই যে তাকে ম্যাকগ্রা-ই হতে হবে। ভাবী ম্যাকগ্রা কিনা জানিনা তবে মিচেল স্টার্ক ভীষণ ইম্প্রেসিভ!’
সত্যি! হোটেলের নিয়ন আলোয় সন্ধেটা দারুণ কেটেছিল। এরকম মায়াবি সন্ধ্যা খুব কমই আসে লাইফটাইমে। আজীবন যত্ন করে সাজিয়ে রাখব এই মুহূর্তটুকু। হোটেল থেকে ফেরার পথে কানে হেডফোন গুঁজে রেট্রো টিউনে নিজেকে আবিষ্ট করলাম- ‘ইয়ে শাম মস্তানি…’
অন্য খবর দেখতে ক্লিক করুন: