Thursday, July 3, 2025
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | ন্যায়সংহিতাতে কতটা ন্যায়?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | ন্যায়সংহিতাতে কতটা ন্যায়?

গোটা ন্যায়সংহিতা আসলে এক চূড়ান্ত অন্যায় সংহিতা, এক স্বৈরাচার

Follow Us :

এই ক’দিন হল মোদিজির সংবিধান-ভক্তি উথলে পড়ছে, দুধ গরম হলে যেমন হয় আর কী। পুরনো সংসদে গিয়ে সংবিধান নিয়ে মাথায় ঠেকাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে আর অযোধ্যায় গেলেন না, সেখানে তো মুখ পুড়েছে। এখন ভাষণেও উনি সংবিধানের কথা বলেন কিন্তু এই সংবিধান যখন দেশের মানুষের প্রতি উৎসর্গ করা হল, তখন এই বিজেপির ভিত্তিভূমি আরএসএস-এর পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে এই সংবিধান দেশের লোক মেনে নেবে না। এখনও সেই লেখার জন্য আরএসএস ক্ষমা চেয়েছে? চায়নি। এই সংবিধান তৈরি হচ্ছিল তখন সংবিধান সভায় হাজির বিভিন্ন দল, বিভিন্ন ব্যক্তি নানান সংশোধনী এনেছিলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক হয়েছিল। সেসব আলোচনা আজও পড়লে মনে হয় ওই মানুষগুলি দেশের জন্য কত চিন্তাভাবনা করে, কত পড়াশুনো করে, কত তর্ক করে, কত যত্ন নিয়ে সংবিধান বা আগামী ভারতের এক একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এক সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। এবং মজার কথা হলো তারপরেও তাঁরা সংবিধানের ভিত্তিভূমি, বেসিকস অফ আওয়ার কনস্টিটিউশন বাদ দিয়ে সমস্ত কিছুর সংশোধন হওয়া সম্ভব সেটাও ভেবেছিলেন। এই মানুষগুলোই তো জেলে গেছেন, ইংরেজদের হাতে মার খেয়েছেন, কালাপানিতে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন, কিন্তু যারা সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেনি, যারা সেদিন উল্টে ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল, যাঁরা সেদিন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করেছিলে, তাঁরা কিন্তু এই সংবিধান সভাতেও ছিলেন না, তাঁরা সংবিধান রচনাতে অংশগ্রহণ করেননি। তাঁরা সংবিধানকে মেনেও নেননি। সেই আরএসএস হিন্দু মহাসভা গান্ধী হত্যাকারীর দল সেদিন খুব স্পষ্ট বলেছিল, আমাদের সংবিধান তো মনুসংহিতার আদলেই হওয়া উচিত, পাশ্চাত্যের কিছু ধারণা নিয়ে আমাদের দেশ চলবে কেন? এবং এগুলো তাঁরা গোপনে বলেননি, প্রকাশ্যে বলেছেন, তাদের মুখপত্রে সেসব কথা ছাপা হয়েছে, রাখা আছে। কাজেই তারা ক্ষমতা পেয়ে যে আমাদের সংবিধানকে আগাপাশতালা বদলাবে এ তো জানাই ছিল।

২০১৯ থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, আর এবারের ৪০০ পারের টার্গেট ছিল তো ওই কারণেই। দেশের সংবিধানকে তারা পুরনো পার্লামেন্টেই ছেড়ে এসেছে, নতুন ভবনে তো রাজদণ্ড, সেঙ্গাল। তো সে নিয়ে কথা আর একদিন। এই সংবিধানের খোলনলচে বদলানোর এক অঙ্গ ছিল আমাদের আইপিসি, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডকে পাল্টানো। এখন আইন যা ছিল তাই রেখে ওনাদের প্রিয় শব্দসংহিতা করতে চাইলে, ন্যায়সংহিতা করতে চাইলে আমাদের তো আপত্তি ছিল না, কিন্তু ওনারা কেবল তা তো করেননি। সবচেয়ে বড় কথা হল আমাদের দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়, আইন বিচার ব্যবস্থার কম্পাস এই পেনাল কোড বদলানো কি কেবল কয়েকজনের বিষয়, যা এক দীর্ঘ আলোচনা, বহু সংশোধন সংমার্জনে তৈরি হয়েছে তাকে দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী নেতা, ১৪৩ জন বিরোধী সাংসদকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করে প্রায় বিনা আলোচনাতেই পাশ করানো হয়েছে। দেশের আইন ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সংশোধন নয়, খোলনলচে বদলানো হল আর বিরোধী দলের একজনেরও বক্তব্য শোনাই হল না এটা ভাবাও যায় না। কিন্তু হয়েছে। এই একই স্পিকার, এই একই প্রধানমন্ত্রী যিনি বা যাঁরা সহমতের কথা বলছেন, সংসদ চালানোর প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছেন, এঁরাই সেদিন সমস্ত বিরোধী সাংসদদের বহিষ্কার করে, বের করে দিয়ে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের বদলে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা, সিআরপিসি-র বদলে ভারতীয় সুরক্ষা সং আর এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর বদলে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম পাশ করিয়েছিলেন যা চালু হয়ে গেল আজ থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ দেশের বিরোধী দলনেতা সহ অনেকেই লিখিত আবেদন করেছিলেন, বহু বিশিষ্ট নাগরিক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ইত্যাদিরা আবেদন করেছিলেন যে এই আইন লাগু না করে পুনর্বিচার করা হোক। কিন্তু ওই যে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। মোদিজি মুখে বলবেন সহমতের কথা কিন্তু আদতে সহমত তাঁর ধারণাতেই নেই। স্বৈরাচারকেই লালন করেছেন আজন্ম। আসুন দেখা যাক ঠিক কোন বিষয়গুলোতে আমাদের খুব আপত্তি আছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | সংসদে দাঁড়িয়ে কাকে ইতিহাস পড়াচ্ছেন, মোদিজি?

আমরা আজ ১৪টা বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, যা আমরা মনে করি খুব জরুরি। ১) নতুন আইনের ১৮৭ ধারা অনুযায়ী আগের আইন অনুযায়ী আদালতের অনুমতি নিয়ে একজন অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখা যেত, এখন তা বদলে ৬০ বা প্রয়োজনে ৯০ দিন পর্যন্ত করা হয়েছে। মানে হেফাজতে রেখে নৃশংস অত্যাচার করে বয়ান দেওয়ানোর ঘটনা বাড়বে। ২) নতুন আইনের ৫৩ ধারা বলছে আগের আইনে থাকা বন্দিদের প্রতি ৪৮ ঘণ্টা অন্তর মেডিক্যাল এগজামিনেশন আর করাতে হবে না, একবার দেখার পরে আবার যদি ডাক্তার মনে করেন, ডাক্তার কীভাবে মনে করবেন? তিনি নিজে নিজেই মনে করবেন কেন? কী করে? আসলে হাজতে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে গায়ের দাগ শুকানোর পরে যাতে আবার অভিযুক্তকে কাঠগড়াতে নিয়ে যাওয়া যায়, মধ্যে আর মেডিক্যাল টেস্টের লাফড়াটাকেই তুলে দেওয়া হচ্ছে। ৩) ধরুন আপনাকে অ্যারেস্ট করাই হল না, তাহলে পুলিশ কতক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রাখতে পারে? ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির না করে এক ঘণ্টাও নয়, কিন্তু নতুন আইনে আপনাকে ২৪ ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে নতুন আইনের ১৭২ নম্বর ধারায়। ৪) আপনি দোষ করেছেন প্রমাণ হওয়ার আগে আপনার ছবি প্রকাশ করতে পারে না পুলিশ, এটাই নিয়ম, কারণ ছবি ছাপা হলে, প্রকাশ করা হলে সেই মানুষটার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে, নষ্ট হবে, ওই দেখ তোর বাবা চোর, শুনতে হবে। কিন্তু নতুন আইনের ৩৭ ধারা অনুযায়ী পুলিশ মনে করলে এই কাজ করতেই পারে, থানার বাইরে প্রকাশ্য জায়গাতে আপনার ছবি টাঙিয়ে দিতে পারে। ৫) নতুন আইনের ৪৩ (৩) ধারা অনুযায়ী অভিযুক্তকে হ্যান্ডকাফ পরানোর ব্যবস্থা করা হল, সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কবেই রায় দিয়েছে। ৬) নতুন আইনের ১০৭ ধারা অনুযায়ী তদন্ত চলাকালীনই কারও সম্পত্তি অপরাধের সূত্রে প্রাপ্ত বলে কোর্টের মাধ্যমে তা বাজেয়াপ্তই শুধু নয় জেলাশাসকের মাধ্যমে বিলিবণ্টনও করে ফেলা যাবে। মানে শেষে যদি আপনি নিরপরাধও সাব্যস্ত হন, তাহলেও আপনার বাড়িতে আপনার ঢোকার অধিকার থাকবে না কারণ ততদিনে তা বিলি বন্দোবস্ত হয়ে গেছে।

৭) এই আইনের ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী সম্পত্তির ছবি তুলে ১৪-১৫ দিনের মধ্যে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশও ওই ম্যাজিস্ট্রেট দিতে পারে। ৮) নতুন সাক্ষ্যদানের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের আলোচনার সময়ে ওই এক্সপার্টদের সাক্ষ্য নাও নেওয়া হতে পারে, মানে সেটা জরুরি রইল না। ওই যে পয়সা নিয়ে বড়লোকের বাবার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের অপরাধের প্রমাণ মুছে তা আর একজনের নামে চালাতে এখন সুবিধে বাড়ল। ৯) ওই সাক্ষ্য আইনের ৩৪৯ ধারা অনুযায়ী এখন যে কোনও নাগরিককে চাইলেই তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ভয়েজ স্যাম্পল দিতে বাধ্য করা যাবে। ১০) ওই একই সাক্ষ্যদানের ৩৫৬ ধারাতে বলা হচ্ছে, বিচারের সময় পলাতক ঘোষিত হলে অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয়ে যাবে। আপনার বিরুদ্ধে আমি মামলা করলাম, আর কোনওভাবে আপনাকে কিডন্যাপ করে কোথাও রেখে দিলাম, আপনি আদালতেও হাজির হতে পারলেন না, কিন্তু আপনার বিচার হয়ে যাবে। ১১) নতুন আইনে বলা হচ্ছে থানাতে গেলেই আপনার অভিযোগ পুলিশ নেবে তেমন নয়, পুলিশ যদি মনে করে যে এই অভিযোগের ভিত্তিতে ৩–৭ বছর সাজা পেতে পারে একমাত্র তাহলেই সে এফআইআর নিতে বাধ্য। মানে আপাতত সবটাই দারোগার মর্জি, আর দারোগার মর্জি কখন হয় তাও তো সব্বার জানা। ১২) ন্যায়সংহিতার ২২৬ ধারা বলছে, সরকারের নিষেধ না মেনে আপনি যদি একতরফা অনশনে বসেন, তাহলে আপনার জেল হতে পারে। মানে সরকার পারমিশন দিলে তবে অনশন করা যাবে, আমাদের জাতির পিতার নাম মহাত্মা গান্ধী, তিনি নিশ্চয়ই হাসছেন। ১৩) কথা আর ছবিতে আপনি উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন, দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, এরকম মনে হলেই আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে। ১৪) ন্যায়সংহিতার ১১৩ ধারা, হুবহু ইউএপিএ, থানার এসআই আপনার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে পারে, অনুমোদন দেবেন এসপি, নির্দোষ প্রমাণের দায় আপনার আর সাজা সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড। এই মাত্র ১৪টার কথা বললাম, গোটা ন্যায়সংহিতা আসলে এক চূড়ান্ত অন্যায় সংহিতা, এক স্বৈরাচার। মানুষের সভ্যতা যত এগোয়, যত বিস্তৃত হয় তত তা শিথিল হয়, মানুষ অপরাধ প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসে, এখানে গোটা সমাজকেই এক অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী হিসেবেই দেখা হয়েছে আর নিজেদের মতো করেই সেই অপরাধকে নির্মূল করার বদলে আরও বিশাল আকার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত দানবীয় আইন আসলে আরও বড় দানবের জন্ম দেয়, ইতিহাস তো তাই বলে।

আর দানবের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাস নয়, দানবের দমন পৃথিবীর ইতিহাস।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Kasba Incident | কসবা কাণ্ডে ধৃত মনোজিতের বিরুদ্ধে তৎকালীন উপাচার্যের চিঠি লালবাজারে
00:00
Video thumbnail
Mahakumbh 2025 | মহাকুম্ভের মৃ/ত্যুর সরকারি হিসেব ভুয়ো? বিবিসির অন্তর্তদন্তে ফাঁ/স চাঞ্চল্যকর তথ্য
00:00
Video thumbnail
Samik Bhattacharya | Dilip Ghosh | শমীক রাজ‍্য সভাপতি, ডুগডুগি হাতে নিয়ে কী বললেন দিলীপ?
00:00
Video thumbnail
Weather Forecast | অতি ভারী বৃষ্টি সঙ্গে ঝোড়ো হওয়ার দাপট! ভাসবে কোন কোন জেলা? দেখুন ওয়েদার আপডেট
00:00
Video thumbnail
Weather Forecast | অতি ভারী বৃষ্টি সঙ্গে ঝোড়ো হওয়ার দাপট! ভাসবে কোন কোন জেলা? দেখুন ওয়েদার আপডেট
03:29
Video thumbnail
Ali Khamenei | খামেনিকে মা/রা অসম্ভব কেন? দেখুন স্পেশাল রিপোর্ট
04:22:14
Video thumbnail
Good Morning Kolkata | সকালের গুরুত্বপূর্ণ খবর, দেখুন একনজরে সরাসরি
03:45:12
Video thumbnail
Samik Bhattacharya | Dilip Ghosh | শমীক রাজ‍্য সভাপতি, ডুগডুগি হাতে নিয়ে কী বললেন দিলীপ?
01:23
Video thumbnail
Alifa Ahmed | বিধানসভায় শপথ গ্রহণ আলিফার, দেখুন এই ভিডিও
04:28:10
Video thumbnail
Stadium Bulletin | চূড়ান্ত একাদশ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক! ব্যাট হাতে শাসন শুভমানের
19:03

Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39