এ এক অদ্ভুত আন্দোলন চলছে, রোজ সরে যাচ্ছে গোলপোস্ট, রোজ নতুন দাবি, রোজ নতুন স্লোগান। গতকাল সবথেকে মজার ব্যাপার হল ডাক্তারদের কাছে যে শেষ চিঠিটাও এসেছিল সরকারের তরফ থেকে, যে চিঠিটা মুখ্য সচিবের তরফে পাঠানো হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল যে ১৫ জন আসতে পারেন আর লাইভ স্ট্রিমিং হবে না। স্পষ্ট, নিট পাশ করা ডাক্তারদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার তো কোনও কারণ নেই। কিন্তু তাঁরা গেলেন ৩৪ জন। বেশ, সেটাও মেনে নিল সরকার, এরপরে তাঁদের দাবি, লাইভ স্ট্রিমিং করতেই হবে না হলে বৈঠক নয়। হল না বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, যদি ওঁরা আবার চায় আবার আলোচনা হবে। এক প্রবল জেদ দেখা যাচ্ছে এখনও এই আন্দোলনকারীদের। কোথা থেকে আসছে এই জোর? আসুন একটু পিছিয়ে যাই। সেই ১৪ তারিখের রিক্লেম দ্য নাইটকেই যদি আরজি কর ধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের বড় প্রতিবাদের দিন বলে ধরে নিই, তাহলে তার পর থেকে আজ এই স্বাস্থ্যভবনের সামনে জমায়েত পর্যন্ত ৩০টা দিন কলকাতা সমেত রাজ্যের প্রায় প্রতিটা জেলা সদরে সমাবেশ মিছিল মিটিং হয়েছে। একটা নবান্ন অভিযান হয়েছে, একটা বন্ধ হয়েছে, লালবাজার অভিযান হয়েছে। ঘটনা বলতে সেই ১৪ তারিখ রাতে আরজি করে ব্যারিকেড ভেঙে ভাঙচুর, আর নবান্ন অভিযানে জল কামান। না আর কিছু হয়নি, হিসেব বলছে কম বেশি ১৫-২০ লক্ষ মানুষ এইসব সমাবেশ ধর্নাতে অংশ নিয়েছেন, একজনও গুরুতর আহত নন, কিন্তু পুলিশের একজন মহিলা সমেত তিনজন গুরুতর আহত, একজন একটা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বলে এখনও বলা হচ্ছে। প্রায় ১০ দিন আগেই বলেছিলাম যে এই আন্দোলন তার উচ্চতা স্পর্শ করেছে, এরপর যা হবে তা বিক্ষিপ্ত, প্রতিবাদ মিছিল ইত্যাদি এবং আইনি বিষয় আর জটিলতায় ক্রমশ এই উদ্দাম আকর্ষণ, এই রোমাঞ্চ থিতিয়ে আসবে। যদি না আবার নতুন কোনও বিরাট ভুল করে বসেন রাজ্য সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী বা শাসকদল, যার প্রবণতা তাদের বেশিরকম আছে, তাঁরা ঘোলা জল ঘুলিয়ে খেতে বেশি পছন্দ করেন।
কেন বলছি? ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করুন, ৮০-৮৫ জন বলবেন ১২ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড না করে, তার চাকরিটি না খেয়ে তাঁকে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে না বসালে আজকের এই দিন দেখতেই হত না, এত দিনে মুখ্যমন্ত্রী প্যান্ডেলে চণ্ডীপাঠ করতেন। কিন্তু স্রেফ ওই কারণেই ঘটনার এই পরিণতিই বলে দেয় এই আন্দোলনের ভিত্তি এক তরল আবেগ, আন্দোলনের দিশা যদি শুরু থেকেই হত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতি, গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাব অভিযোগ, যাঁরা চিকিৎসা নিতে আসেন তাঁদের স্বার্থ, সুবিধে আদায়, তাহলে তা অনেক বেশি কার্যকর হতেই পারত। এখন এ এক এলিট স্পেকট্যাকল, এ এক বর্ণাঢ্য আন্দোলন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে আন্দোলনে ৪০-৫০ লাখ টাকা ফিজ নিয়ে যারা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ চালায় সেই কোম্পানি খাবার জোগান দিচ্ছে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরিচিত চিকিৎসক মাফিয়ারা আর লাভ হচ্ছে প্রাইভেট, কর্পোরেট হাসপাতালের, শুনেছি ৪০ শতাংশ বেড়েছে তাদের রোগী, আর বেওসা। আন্দোলনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে খুন আর মানুষকে হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া ক্রিমিনালকে, দেখা যাচ্ছে ড্রাগ পাচারে অভিযুক্তকে এবং অবশ্যই আছেন হাজার হাজার মানুষ তাঁদের সৎ আবেগ আর কষ্ট নিয়ে। কারণ ওই যে বললাম, এ এক বর্ণাঢ্য আন্দোলন, টুকরো টুকরো ছবি আর ভিডিও ক্লিপ দিয়ে বাস্তিল দুর্গ জয় কিম্বা কিউবান বিপ্লবে সান্তা ক্লারাতে শেষ লড়াইয়ের উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar| উৎসব কাদের? উৎসব কী? উৎসবে নেই কারা?
কিন্তু তাকিয়ে দেখুন আপনার চারপাশে সেই হতভাগ্যদের দিকে, যাঁদের দিন আনি দিন খাই জীবনে এক ধর্ষণ শুধু ধর্ষণ, এক দুর্নীতি শুধু দুর্নীতি। তারপর তাদের প্রতিদিনের পেটের লড়াই, বাজারের আগুন দাম, চিকিৎসা তো বিলাসিতা হয়ে উঠেছে, তার কাছে সময় নেই আপনার এই বর্ণাঢ্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার। তাঁরা নেই এই বৃত্তে, হ্যাঁ বেঁচে যাওয়া খাবার তাদের মধ্যে বিলি করেছেন, তাদের কারও কারও মনে হতেই পারে ডাক্তারবাবুরা এরকম আন্দোলন করলে, করতে থাকলে বেশ হয়। আর তাদের সেই বেঁচে যাওয়া খাবার বিলি করে সারি দিয়ে ছবি তোলার মধ্যে আবার বিপ্লব নয় এক মাদার টেরেজার আবেগও থাকে। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত মন রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাতেই ফেরা যাক। আজ ৩০ দিন রাজ্যজুড়ে এই প্রতিবাদের পরেও পুলিশ লাঠি চালায়নি, গুলি চালানো তো দূরস্থান, একজন ডাক্তার বা রিক্লেম দ্য নাইটের হোতাকে জেলে পোরাও হয়নি। এটা বেশ অভিনব ব্যাপার। রাইটার্স-এর সামনে, প্রথম বামফ্রন্ট সরকার শপথ নিচ্ছিল, মঞ্চ থেকে বলা হয়েছিল আমরা গণ আন্দোলনে লাঠি গুলি চালাব না, আমরা রাইটার্স থেকে প্রশাসন চালাব না। আর পরে ঘোষণা হয়েছিল সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করা হল, যা ছিল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। কিন্তু মাত্র ১৯৭৮, খিদিরপুর ডকে গুলি চলল, শ্রমিক মারা গেল তারপর থেকে বহু বহু বার। প্রথম নির্লজ্জ পুলিশি অভিযান দেখেছিল সুন্দরবনের মানুষ, মরিচঝাঁপিতে একদিকে ক্যাডার অন্যদিকে পুলিশ, মধ্যে কিছু অসহায় উদ্বাস্তু, ভিটেহারা মানুষ, না ছিল ফেসবুক না ছিল টুইটার। আসুন ওরা ত্রিপল চাইছে, খাবার চাইছে, হুউউউস করে খাবার আর ত্রিপল, না বিপ্লবের এমন চটজলদি জোগানদার ছিল না। নজরকাড়া আন্দোলন ছিল কানোরিয়া জুট মিলে, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, কুশল দেবনাথ হয়ে উঠেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো, চে গ্যেভারা, মানুষের সমর্থন ছিল দেখার মতন, তারপর সে লড়াই ক্রমশ আইনি ঘেরাটোপে গেল। গড়ে উঠবে যৌথখামার-এর বদলে কী গড়ে উঠল তা আজও জানি না।
কিন্তু সে আন্দোলনে লাঠি চলেছে, জেলে পোরা হয়েছে নেতাদের। তার আগে ৮৩তে জুনিয়র ডক্টরস আন্দোলন, বেধড়ক লাঠি পেটানো হয়েছে। নো ভোটার কার্ড নো ভোট, সব্বাই জানেন সেই গুলি চালানো আর অতগুলো মানুষের শহীদ হওয়া। এরপরে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড়, লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, যৌথবাহিনী, সব ছিল। আর অন্যান্য রাজ্য সরকার? কেন্দ্রীয় সরকার। বাকিদের কথা ছেড়েই দিন, কেরালাতে মৎস্যজীবীরা আন্দোলন করছিলেন, ভিজিঞ্জাম বন্দর আদানিদের হাতে যাচ্ছে যাদের কাজ শুরু হলে সেই মৎস্যজীবীরা কাজ হারাবেন, বিক্ষোভ ক’দিনের মধ্যেই পিটিয়ে জেলে পুরে থামিয়ে দিয়েছে বিপ্লবী সরকার। মোদি-যোগীর কথা তো বাদই দিলাম, কৃষক আন্দোলনের ছবি তো আমরা দেখেছি। উত্তাল প্রতিবাদী সময়ে রাষ্ট্রের এই ব্যবহার খুউউউব স্বাভাবিক, কারণ রাষ্ট্রের কাছে আছে তো পুলিশ, আছে তো লাঠি গুলি, তারা তা তাদের শাসন বাঁচাতে ব্যবহার করবে না তো কি হাতির পাল তাড়ানোর জন্য রেখেছে? কিন্তু এক দীর্ঘ সময় ধরে আমরা দেখলাম এই সরকার আগের সরকারগুলোর কাছ থেকে অন্তত এই শিক্ষাটুকু নিয়েছে। সেই ২০১১ থেকে আজ অবধি, যাকে বলে গণ আন্দোলন, সেরকম কোনও একটা সিচুয়েশনেও গুলি চলেনি, লাঠি? হ্যাঁ চলেছে, কিন্তু সেই হিংস্র লাঠি চালিয়ে প্রবীর দত্তকে মেরে ফেলার ইতিহাস যাদের মনে আছে তারা একমত হবেন যে তেমন লাঠি চালানোর ঘটনাও ঘটেনি। অথচ আন্দোলন কি হয়নি? হয়েছে। কেবল ভাঙড়ের আন্দোলনের কথাই ভাবুন না, দেড় মাসের ওপর এক দুর্গ বানিয়ে রাখা হয়েছিল ভাঙড়কে, ভেতরে নেতা বসে আছেন, সব্বাই জানেন। আমি নিজে জানি ওই আন্দোলনের কয়েকজন ম্যাপ বানিয়ে সেই নেতার অবস্থান তুলে দিয়েছেন এক আইপিএস অফিসারের হাতে। সেই অফিসার বলছেন অর্ডার দিন, নির্দেশ আসছে না, ওরকম জনবহুল এলাকায় এসব করতে গেলে মানুষ মরবে, যা কাম্য নয়। সে আন্দোলন মিটেছে। দেউচা পাচামি, রেজিস্ট্যান্স কম ছিল, ম্যানেজ করা হয়েছে, তার জন্য বিভিন্ন ম্যানেজমাস্টারদের ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু গুলি চলেনি এবং কাজও শুরু হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, মমতা ব্যানার্জি আক্ষরিক অর্থে গণ আন্দোলনে গুলি চালাব না এরকম কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি বটে, কিন্তু কিন্তু তাঁর আগের সরকারগুলোর কাছ থেকে শিক্ষাটা নিয়ে একটা বেসিক ফারাক তৈরি করেছেন। হ্যাঁ, ইউএপিএ জারি করা হয়েছে, আবার কোথাও সেই পদক্ষেপের পরেই সরকারি তরফেই বিষয়টাকে প্রায় ছেড়ে দেওয়ার ফলেই আজ এই মুহূর্তে ইউএপিএ-তে এই রাজ্যে গণ আন্দোলনের কোনও কর্মী জেলে আছেন বলে আমার জানা নেই। মাওবাদীদের আমি রাজনৈতিক কর্মী বলে মনে করি না, তাদের গায়ে নানান গণ আন্দোলনের তকমা থাকলেও তাঁদের ঘোষিত নীতিই সশস্ত্র আন্দোলন, ক্ষমতা দখল, কাজেই তাদের এর বাইরে রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। যে কথা বলছিলাম, এই সরকার সাধারণ আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর পুলিশি দমন নিপীড়ন নামিয়ে আনেনি, সেটাই আবার আমরা গত ৩০ দিনে দেখলাম। এই একই আরজি কর ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়েছিলেন দিল্লির জুনিয়র ডাক্তারেরা, ২১ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। না, এখানে এফআইআর তো দূরস্থান, তাঁরা নবান্নে জেনেই গিয়েছিলেন যে লাইভ স্ট্রিমিং হবে না, গেলেন ফিরে এলেন। এই জেদ সরকার লাঠি গুলি চালাচ্ছে না বলে?