দেশের জনসংখ্যার ৭৫% প্র্যাকটিসিং হিন্দু, মানে অন্তত হপ্তায় একবার মন্দিরে যান, পুজো করেন। এদিকে বিজেপি লাগাতার নিজেদেরকে হিন্দুদের পার্টি হিসেবেই প্রজেক্ট করে চলেছে। আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তো বলেই দিয়েছেন ওনার দরকার নেই সংখ্যালঘু ভোটের, কেবল হিন্দুদের ভোটেই তিনি দখল করবেন বাংলার মসনদ। কিন্তু এত কিছুর পরেও দেশের ৫০% হিন্দু বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে, তার বেশি নয়, মানে এখনও ৫০% হিন্দু সঙ্গে নেই। ২০১৯-এর নির্বাচনেও বিরোধীদের কোনও ঐক্যই গড়ে ওঠেনি, না বরং একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়েছে মন দিয়ে, তা সত্ত্বেও মুড অফ দ্য নেশন বলছিল ২৮২ তো দূরস্থান, ২৩০ পার করতে দম হালকা হয়ে যাবে। কারণ মানুষ চাকরি, পানীয় জল, বাসস্থান ইত্যাদি নিয়ে বিষম চিন্তিত। এই সময়েই হল পুলওয়ামা। সরকারে আছে বিজেপি, এক প্রকাণ্ড ব্যর্থতার জন্যই এতজন জওয়ানের মৃত্যু হল, কিন্তু বিজেপি সেই আবেগকে এক চূড়ান্ত জঙ্গি জাতীয়তাবাদী আবেগে পালটে দিল, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, মিডিয়ার প্রচার সব মিলিয়ে বিজেপি ৩০৩। এবং এইবারে ক্ষমতায় এসেই বাকি যা যা ছিল, কাশ্মীর থেকে তিন তালাক, সবকটা ইস্যু নিয়ে নামল বিজেপি, মেক ইন ইন্ডিয়া, সারা দেশের বিভিন্ন নির্বাচিত সরকার ভেঙে এক কালাপাহাড়ের রাজনীতির শুরুয়াত হয়ে গেল। এই পর্যায়ে হিন্দুত্ব আরও বড় ইস্যু হয়ে উঠল শুধু নয়, মুসলমানদের ধরে পেটানো, গণধোলাই, বুলডোজার, রামমন্দির উদ্বোধন, দিল্লি সাজানো, নতুন সংসদ ভবন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে খুব পরিষ্কার যে বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদ ছাড়া এক পা চলতে পারবে না সেটা বুঝেই আরও কড়া হিন্দুত্ববাদকে নিয়েই এগিয়ে চলেছে। দেশের প্রতিটা নির্বাচনের মূল ইস্যু হিন্দুত্ব, সংখ্যালঘুদের জন্য ঘৃণা ছড়াচ্ছেন মোদিজি নিজেই। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে আবার সেই অর্থনীতি বেহাল এবং এত কিছুর পরেও হিন্দুদের সমর্থন সেই ৫০%-এর উপরে উঠতেই চায় না।
কেবল একটাই সুবিধে, বিরোধীরা একে অন্যের সঙ্গে লড়তে ব্যস্ত, তাদের মোর্চা হচ্ছে আর ভাঙছে। যেটুকু গড়ার সম্ভাবনা ছিল সেটাও বিজেপি নিজের মতো করে ব্যবস্থা করে নিল, ২০২৪-এর আগে শিবসেনা দু’ টুকরো, এনসিপি দু’ টুকরো, নীতীশ কুমার আবার ফিরেছেন, কমিউনিস্টরা বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও শক্তিই নয়, অতএব অবকি বার ৪০০ পার। কেন ভাই ৪০০ কেন? কারণ সংবিধানটাকে আগাপাশতালা পালটে দেবেন ওনারা, ব্যাখ্যা এল বিজেপির দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতাদের থেকে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর বেশ কিছু সংগঠন প্রকাশ্যে হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলছে, গডসে দেশপ্রেমিক আর নেহরু দেশবিরোধী গোছের ন্যারেটিভ নিয়ে সিরিয়াস ডিবেট হচ্ছে। কিন্তু মানুষ, দেশের দলিত পিছড়ে বর্গের মানুষ সামাল দিলেন। আবার একটা সুযোগ দেশের মানুষের সামনে, দেশের বিরোধী দলের সামনে, বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার আগেই আটকে দিল মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতারা খেয়োখেয়িতে ব্যস্ত, কিন্তু মানুষ আটকাল, যে যেখানে যেমনভাবে পারল। বাংলাতে, উত্তরপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রে বিজেপি বড় ধাক্কা খেল, এই নির্বাচনে আগে বিজেডি নেতা নবীন পট্টনায়ক বা ওই ওয়াইএসআর রেড্ডির ছেলে জগন রেড্ডি যদি বিজেপির বিরুদ্ধে জোটে আসত তাহলে বিজেপি বিদায় হত, কিন্তু তারা বা বলা যাক ওই দুটো রাজ্যের মধ্যে ওড়িশা চলে গেল বিজেপির হাতে। অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডু জিতলেন কিন্তু তিনি ততদিনে আবার বিজেপির সঙ্গী। বিহারে নীতীশ কুমারকে পেয়ে আবার বিজেপির জয়। বিজেপি ২৪০ নিয়ে দুটো দলের সাহায্য নিয়ে সরকারে এসেছে, আমরা মনে করেছিলাম বিরোধীরা এবারে চেপে ধরবে, কোথায় কী? আবার বিরোধীরা ক্রমশ ছত্রভঙ্গ, শরদ পাওয়ার তাঁর দলের বচাখুচা এমএলএ-দের বলেছেন, আপনারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিন, কাশ্মীরে ওমর আবদুল্লা লিখেছে আরও লড়ে মরো, তিনি দিল্লির সঙ্গে সদ্ভাব রেখে কাশ্মীরের রাজ্য তকমা ফিরে পেলেই সমর্থন জানিয়ে দেবেন। নীতীশ কুমারের কাছে আর কোনও রাস্তাই নেই, বিহারে এবারে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় আসবে, বা না আসলেও নিজেদের সরকার করার মতো অবস্থায় থাকবে। বাকি রইল বাংলা, সেটা দখল করার জন্য রেকর্ড ভেঙে আরএসএস প্রধান ১২ দিন কাটিয়ে গেলেন এই বাংলায়, আবার আসবেন, দলও ভাঙার চেষ্টা চলছে, নতুন ইস্যু তৈরির চেষ্টাও চলছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ট্রাম্প সাহেবের নায়েবমশাই
আগামী ন’ মাস নির্বাচন নেই, এরপর বিহার নির্বাচন, এখনও পর্যন্ত যা খবর তাতে বিহারে বিরোধীরা জয়ের কাছাকাছিও যেতে পারবে না। কাজেই নেক্সট লড়াই বাংলায়। এবং এবারের লড়াইয়ে কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই, সাফ দুটো দিক, হয় তৃণমূল না হয় বিজেপি, আগামী মে মাসে বাংলা রুখে দাঁড়াবে? না বাংলা হেরে যাবে? হিসেব বলছে এখনও প্রায় ৬%-এর ব্যবধান, কিন্তু সেটা মোটেই যথেষ্ট নয়। হ্যাঁ এখান থেকেই আলোচনার সূত্রপাত। খেয়াল করেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে টিকে থাকার একটাই মাত্র সূত্র, বিজেপির অল আউট বিরোধিতা করা। বিজেপির আদর্শ, বিজেপি সরকারের নানান জনবিরোধী পদক্ষেপ, বিজেপি সরকারকে কাজে লাগিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠাগুলোকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া, প্রতিটা কাজের বিরোধিতা করতে হবে, মুখোমুখী দাঁড়াতে হবে, খানিক সফট হিন্দুত্ব দিয়ে বিজেপিকে রোখা যবে না, আপকে দেখুন, হনুমান চালিসা মুখস্থ বলেছেন কেজরিওয়াল, তাঁর সরকার প্রবীণদের তীর্থ করতে পাঠিয়েছেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়াকে সমর্থন করেছেন, কেজরিওয়াল নিজে আরএসএসকে চিঠি লিখেছেন বিজেপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কিন্তু হেরে গেলেন, কেবল হারেননি, যা অবস্থা তাতে দল টেকানোই কঠিন হয়ে যাবে। ওধারে জগন রেড্ডিকে দেখুন, দিল্লি আপনারা সামলান আমাদের এমপি-রা সমর্থন দেবে, রাজ্য আমরা সামলাব। হেরে ভুত হয়ে গেছেন, আই প্যাক না বাঁচাতে পেরেছে কেজরিওয়ালকে, না বাঁচাতে পেরেছে জগন রেড্ডিকে। ওড়িশার বিজু পট্টনায়কের পুত্র নবীন পট্টনায়ক ভেবেছিলেন দিল্লি থাক বিজেপির, আমি কেবল ওড়িশার বিকাশ করব, কী হল? কেবল বিধানসভাতে হেরেছেন তাই নয় দল ভাঙছে। আসলে বিজেপিকে তার সবকটা দিক থেকেই বিরোধিতা করতে হবে, এদিকটা ভালো, ওদিকটা খারাপ এরকম কোনও বিশ্লেষণ করতে গেলে নৌকাডুবি হবেই।
আসলে আজ তো নয়, সেই ১৯২৫ সালে আরএসএস তাদের যাত্রা শুরু করেছিল, সেই তারা যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেই তারা যারা জাতির পিতার হত্যার ষড়যন্ত্রে ছিল, সেই তারা যারা বর্বরের মতো এক ঐতিহাসিক সৌধকে ভেঙে এক হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ গড়ে তুলেছে, সেই তারা যারা দেশের সংবিধান, সাংবিধানিক কাঠামোর সামনে এক মূর্তিমান আপদ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মূল শক্তি এখনও বিরোধীদের বিচ্ছিন্নতা। হ্যাঁ এখনও তাদের ভোট, তাদের সমর্থন ৪০%-এর বেশি নয়। কিছু বিরোধীদের লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে নিজেদের সঙ্গে রেখেছে, বাকিরা খেয়োখেয়ি করে মরছে, সুবিধে নিচ্ছে আরএসএস–বিজেপি। ক’দিন আগেও উত্তর ভারতে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হিমাচলপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, ওড়িশা, পঞ্জাব, দিল্লি ছিল বিরোধীদের দখলে। কংগ্রেস অনায়াসে রাজস্থান, ছত্তিশগড় বা মধ্যপ্রদেশে হেরে গেল, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের হার সুনিশ্চিত করল জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দলবদল। উত্তরাখণ্ড নিতে বিজেপিকে বেশি খাটতে হয়নি, উত্তরাখণ্ড সামান্য গরিষ্ঠতা নিয়ে টিকে রয়েছে, যে কোনও সময়ে খসে যাবে। । বিহার নীতীশ কুমারের সঙ্গে জোট সরকার বিজেপির, আগামী দিনে বিহারে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বা তার সামান্য কিছু কম, যা নিয়ে তাদের খুব বেশি ভাবারও নেই। দিল্লি তারা নিয়ে নিয়েছে, আগামী ১০ বছরের আগে তা ফেরত আসা অসম্ভব। রইল বাকি ঝাড়খণ্ড, হিমাচল আর বাংলা। ইন ফ্যাক্ট বাংলা নিতে পারলে তাদের উত্তর ভারত পরিক্রমা শেষ হবে। কোথায় আটকাচ্ছে? কে আটকাচ্ছেন? আটকাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সব দিক থেকে। ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে জিএসটি থেকে ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়া বা ইডি-সিবিআই-এর ইস্যুতে মমতা মুখোমুখি লড়ছেন, যতটা দানবীয় শক্তি নিয়ে আরএসএস-বিজেপি মাঠে নেমেছে, ততটাই শক্তি দিয়ে তাকে রোখার চেষ্টা করছেন তিনি, তাঁর দল তৃণমূল। মুড অফ দ্য নেশন বলছে, এখনই ভোট হলে তৃণমূলের শক্তি বাড়বে, তাদের আর বিজেপির মধ্যে এখনও ৬% ভোটের ফারাক আছে আর ৬% ভোট খুব কমও নয়। আবার খুব একটা বেশিও নয় কারণ অঙ্কের হিসেবে বিজেপিকে ৩%-এর বেশি ভোট সুইং করাতে হবে, তৃণমূলের তিন শতাংশের খানিক বেশি ভোট যদি বিজেপির ধারে চলে আসে তাহলেই কেল্লা ফতে।
কিন্তু তিন শতাংশ তো কম নয়। এটা পেতে হলে বিজেপিকে কী করতে হবে? বা কী কী করতে হবে? হ্যাঁ সেই কাজটাই বুঝিয়ে দিতে এই বঙ্গে ১২টা দিন কাটিয়ে গেলেন সরসংঘচালক মোহন ভাগবত। এমনিতে কিছু গতের কথা বলেছেন, আমাদের আনপড় সাংবাদিকদের তা নিয়ে কী নাচানাচি, দেখেছ দেখেছ সরসংঘচালক মোহন ভাগবতজী নতুনভাবে নাকি দেশকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসেতুহিমাচল, রামকে কত সূক্ষ্মভাবে জুড়ে দিলেন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। বিষয়টা এত সহজ নয়, ১) আরএসএস এবারে তাদের সংগঠনকে তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামাবে, তার ছকটা দিয়ে গেলেন সরসংঘচালক, হ্যাঁ, এর পরে প্রতিটা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা যদি সেইসব এলাকাতেই হয়, যেখানে কম ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল তৃণমূল, আমি অবাক হব না, কারণ দাঙ্গা থেকে লাভ তোলে আরএসএস–বিজেপি, এটা ইতিহাস। প্রতিটা ধর্মসভার ফুল সাপোর্ট সিকিওর করে গেলেন তিনি। আর কোন ফাটল দিয়ে লোহার বাসরঘরে ঢোকা যায়, তা নিয়েও নিশ্চয়ই আলোচনা হয়েছে। হ্যাঁ, তৃণমূলের একটা মোটামুটি ভাঙনে ৪/৫/৬% ভোট যদি ভাঙানো যায়, তাহলে ছবিটা উলটে যাবে। আর বাংলা দখল হয়ে গেলে দাক্ষিণাত্য জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। মজার কথা হল এখনও কিছু অর্বাচীনদের মনে হচ্ছে তৃণমূল আর বিজেপি আলাদা নয়, তারা সর্বশক্তি নিয়ে নামছে সেই বিরোধিতায়, যদিও এক বিরোধী মুক্ত ভারতের ফাইনাল স্টেপ হল এই বাংলা, বাংলা জয় আরএসএস-বিজেপিকে এনে দেবে সেই সুযোগ, যার পরে তাদের অশ্বমেধে ঘোড়া থামানোর কোনও জায়গাই থাকবে না। লোহার বাসরঘরের ফুটো দিয়ে সাপ ঢুকছে।
রাই জেগো না রাই জেগো না বলছে পদ্ম ফুল,
সজাগ থাকার যুক্তিগুলো কাদের চক্ষুশূল!
রাই জাগো রাই জাগো ঘরে ঢুকছে কেউটে সাপ,
তোমার ঘুমের সুযোগ নিল রাম, রুটি, ইনসাফ।