তামিল ম্যাগাজিন বিকটম-এর ওয়েবসাইট ডাউন, কেউ আর খুলতে পারছে না। কিন্তু মজার কথা হল যে কার্টুন ছাপার অপরাধে এই ওয়েব সাইটকে আন-অফিসিয়ালি বন্ধ করে রাখা হয়েছে তা কিন্তু ভাইরাল। আমি শিওর যে আপনার হোয়াটসঅ্যাপেও সেই কার্টুন এসে হাজির হয়েছে। মোদিজির হাতে শেকল পরানো আছে, পাশে ট্রাম্প বসে হাসছেন। এহেন এক বিশুদ্ধ কার্টুনকে চেপে দেওয়ার এই চেষ্টা দেখলেই বোঝা যায় যে তির এক্কেবারে মাথায় লেগেছে। ১১২ জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে তৃতীয় বিমানখানা অমৃতসরে নেমেছে, তারমধ্যে ৩১ জন পঞ্জাবের, ৪৪ জন হরিয়ানার আর ৩৩ জন গুজরাটের, মানে আমাদের ছোটা মোটাভাই আর বড় মোটাভাইয়ের পড়শি। তাঁদেরকে আবার সেই একইভাবে হাতেপায়ে হাতকড়া পরিয়ে যুদ্ধ বিমানে করে ফেরত পাঠানো হয়েছে এবং জানা যাচ্ছে যে শিখ মানুষজনদের পাগড়ি খুলিয়ে পাঠানো হয়েছে। ওধারে মোদিজি নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর আমেরিকা সফর সফল। ওফ, ট্রাম্প সাহেব ওনাকে জড়িয়ে ধরেছেন, ইলন মাস্ক মিটিং করেছেন, ট্রাম্প সাহেব ওনাকে হার্ড নেগোশিয়েটর বলেছেন ইত্যাদি অত্যাদি। একবারের জন্যও তিনি ট্রাম্প সাহেবের সামনে এই কথাটা বলতে পারলেন না যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের দেশে পাঠানোর জন্য তাঁদের হাতকড়া পরিয়ে যুদ্ধ বিমানে ফেরত পাঠানো হচ্ছে কেন? বলতেই তো পারতেন যে দেশে এইসব মানুষের জন্য আমরা যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিতে পারিনি, আমাদের দেশে বেকারত্ব আমাদের আমলে রেকর্ড ছুঁয়েছে, তাই ভাগ্য অন্বেষণে আপনাদের দাদু ঠাকুরদার মতোই এঁরাও এই দেশে এসে পৌঁছেছেন, কিছু একটা করে শেষমেশ পেট চালানোর জন্য। না, এসব কথা বলতে পারেননি, দাঁত বার করে হেসেছেন এবং বলেছেন যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে আমেরিকা যা করছে তার সঙ্গে আমরা সহমত।
ট্রাম্পের সঙ্গে মিটিং করার আগে উনি মিটিং করেছেন ইলন মাস্কের সঙ্গে, ওনার ডেজিগনেশন হল স্পেশাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়ি, তিনি আমাদের দেশের বড়জোর সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, ছবিও দিলেন, ওনার সঙ্গে নাকি ইলন মাস্কের পরিচয় সেই গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যে বলেন, অনর্গল মিথ্যে বলেন। তিনি ভুলেই গেছেন তিনি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন আমেরিকা তাঁকে ভিসা দেওয়ার যোগ্যও মনে করেনি, এলন মাস্কের সঙ্গে কি ওনার ডঙ্কি রুটে আমেরিকাতে ঢুকে পরিচয় হয়েছিল? তো সেই ইলন মাস্কের সঙ্গে বৈঠকে হাজির আমাদের বিদেশমন্ত্রী থেকে সচিবরা, আর ইলন মাস্কের সঙ্গে তাঁর শিশুসন্তানেরা, তাদের আয়া এবং ইলনের বান্ধবী। ভাবুন কোন পর্যায়ে কোন বৈঠক হচ্ছে। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পরেই সাংবাদিক সম্মেলন হল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের আজ নয় কোনও কালই সহ্য করতে পারেন না, করণ থাপারের সাক্ষাৎকারে এক গ্লাস জল খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তো সেই তিনি হাজির হলেন বাধ্য হয়েই ওই সাংবাদিক সম্মেলনে। দুনিয়ার সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প জানালেন ভারতবর্ষে বাণিজ্য করা খুব শক্ত, তাদের টারিফ, মানে আমদানি শুল্ক বড্ড বেশি, মোদিজি পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন, ট্রাম্প অনায়াসে বলে গেলেন যে এবার থেকে আমরা টিট ফর ট্যাট, যে যত টারিফ বসাবে, শুল্ক চার্জ করবে আমরাও ঠিক ততটাই চার্জ করব, মিটে গেল কথা। এরপরে উনি জানালেন যে আমাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দারুণ চুক্তি হয়েছে, আরও কিছু বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এরপরে চীন প্রসঙ্গে চলে গেলেন, বললেন যে ভারত যদি চায় তাহলে আমরা চীনের সঙ্গে শান্তি আলোচনাতে সাহায্য করতে পারি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নির্মলা সীতারামন বাংলা নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলছেন
মোদিজির তখনই বলা উচিত ছিল যে আমরা পড়শিদের সঙ্গে সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে করি, দু’ দেশ আলোচনা করে মেটাব, তৃতীয় শক্তির দরকার নেই। না, বলতে পারলেন না, পরে বিদেশ মন্ত্রক থেকে সে কথা বলা হল, মোদিজির সাহসে কুলোয়নি সেই কথা বলার। আবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তো আরও রগড়, ট্রাম্প সাহেব বললেন ওটা আমি মোদিজির উপরেই ছাড়লাম, মানে খুব সাফ, বাকিগুলো তো আমি দেখছি, কথা বলছি রাশিয়া ইউক্রেন চীন আমিই কথা বলতে পারি, বাংলাদেশ এক তুচ্ছ ব্যাপার যেটা ওই আমার নায়েবমশাই দেখে দেবেন, ওটা মোদিজির ব্যাপার। এই অসম্মানজনক কথার পরেও ওনার মুখে কোনও কথা নেই, এবারেও বলতে পারলেন না, এটা আমাদের পড়শির ব্যাপার আমরা আলোচনা করে মেটাব। বলবেনই বা কী করে, তার আগেই তো শেখ হাসিনাকে এদেশে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে এমনিই ব্যাকফুটে আছেন, এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে শেখ হাসিনা সম্পর্কে ভারতের অফিসিয়াল স্ট্যান্ড জানানো হয়নি। এবারে আসুন আমরা কী পেলাম? মানে উনি গিয়েছিলেন সফরে, আমাদের দেশ এরকম এক সফরের পরে কী পেল সেটা নিয়ে খানিক উৎসাহ থাকবে বইকী, যদিও আমরা এর আগেই জানিয়েছিলাম যে দেশ বা দেশের অর্থনীতি নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, ওদেশে গেছেন গৌতম আদানির মামলার তদ্বির করতে, হ্যাঁ এরকমটাই পাবলিক পার্সেপশন, বহু মানুষ সেটাই মনে করেন, এবং আমরা কার্যক্ষেত্রেও তাই দেখলাম। না, ইলিলিগ্যাল ইমিগ্রেশন-এর এই অসম্মানজনক হাতকড়া পরানো নিয়ে একটা কথাও নেই। তাহলে আছে কী? ৩৬টা পয়েন্ট নিয়ে এক যৌথ বিবৃতি জারি করা হয়েছে, তাতে ভাট কথা আর বাওয়াল বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তা হল ১) সামরিক চুক্তি হয়েছে ১০ বছরের জন্য, কমপ্যাক্ট, ক্যাটালাইজিং অপরচুনিটিজ ফর মিলিটারি পার্টনারশিপ, অ্যাক্সিলারেটেড কমার্স অ্যান্ড টেকনোলজি। সংক্ষেপে কমপ্যাক্ট। মোদ্দা কথা হল আমাদের সঙ্গে এক মিলিটারি পার্টনারশিপ হল, আমরা আমেরিকা থেকে এফ৩৫ যুদ্ধবিমান কিনব, যা দিয়ে নাকি চীন আর পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা যাবে। ক’দিন আগেই ইলন মাস্ক এই বিমানকে মান্ধাতার আমলের বলে ঠাট্টা করেছিলেন। কত দাম দিয়ে কিনব এই বিমান? ৯৯৬ কোটি টাকা আর এই বিমানের এক ঘণ্টা উড়ানের জন্য খরচ ৩২ লক্ষ টাকা।
এদিকে বিশ্বের সব্বাই জানে আগামী দুনিয়ায় আর বিমান বা কামান দিয়ে যুদ্ধ হবে না, এবারে যুদ্ধ হবে কি-বোর্ডে, কমপিউটারে, প্রযুক্তি দিয়ে, গোলা বারুদে নয়। তাকিয়ে দেখুন, চীন লড়ছে আমেরিকার সঙ্গে, তাদের ডিপসিক বাজারে আসার পরে আমেরিকার এনভিডিয়ার শেয়ার পড়ে যাচ্ছে ১৭ শতাংশ, তাকিয়ে দেখুন কেবল ডিপসিকেই থেমে নেই চীন, তারা আরও বেশ কিছু এরকম আর্টিফিসিয়াল ইন্টলিজেন্স সিস্টেম আর টুল নিয়ে বাজারে আসছে। যে কাজ আপনি ক’দিন আগেও চ্যাটজিপিটি দিয়ে করছিলেন আজ সেই কাজ আরও সহজে করে দিচ্ছে ডিপসিক এবং তা আরও অনেক কম খরচে। হ্যাঁ, এটাই আগামী দুনিয়ায় লড়াইয়ের স্বরূপ, সেই সময়ে সারি দিয়ে পড়ে থাকা না বেচতে পারা এফ৩৫ বিমান গছিয়ে দেওয়া হল আমাদের কাঁধে। কতটা অসহায় আজ ভারত? আমাদের দেশের এক বিরাট সম্পদ হল কৃষি উৎপাদন, আমাদের কৃষকরা এমএসপি-র জন্য লড়ছে, ঠিক সেই সময়ে আমেরিকার আলফা আলফা হে, পশুখাদ্যের উপর শুল্ক কমিয়ে দিল আমাদের সরকার, আমেরিকা এবার কমদামি বাইক পাঠাবে কম শুল্কে, আমাদের দেশের বাইক সংস্থার শেয়ার টলমল করা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশে ক’ বছর ধরে সাধারণ থেকে মাঝারি এবং দামি হুইস্কি তৈরি হচ্ছে, অম্রুত বা ইন্দ্রি ইত্যাদি তো বিশ্ব কাঁপাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে আমেরিকার বারবান হুইস্কি, রাই হুইস্কি আর জ্যাক ড্যানিয়েলের মতো টেনিসি হুইস্কির শুল্ক কমানো হল ১৫০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে। খুব সোজা হিসেব বলছে আর কিছুদিন পর থেকে আমাদের দেশে বারবান হুইস্কি জিম বিম পাওয়া যাবে হাজার টাকায়, তখন কে কিনবে ব্লেন্ডার্স প্রাইড বা অ্যান্টিকুইটি? মানে দেশের ওয়াইন শিল্প যাক ভোগে, ট্রাম্প সাহেব যেন খুশি থাকেন, খুশি থাকো, তুমি খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো গোছের ব্যাপার আর কী। এবং পাওনা একটাই, ট্রাম্প সাহেব ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্টটাকেই বাতিল করে দিয়েছেন, যার ফলে নাকি নিশ্চিত জেল এবং জরিমানার হাত থেকে বেঁচে গেলেন গৌতম আদানি। অন্য কথায় আসি, নায়েব গিয়েছিলেন জমিদার মশাইকে খুশি করিয়া তাঁর সাধের সড়কিদার সনাতন ডাকাতকে মুক্ত করিয়া আনিতে, জমিদারবাবু ২ আনা অধিক খাজনা, নধর ১০ খান খাসি, ৪ গন্ডা দেশি মোরগ ইত্যাদি নজরানার বদলে সড়কিদার সনাতন ডাকাতকে মুক্ত করিয়াছেন, নায়েবমশাই গ্রামে ফিরিয়া সেই প্রাপ্তির কথা জনে জনে ব্যাখ্যান করিতেছেন। বেশিদিন নয়, ১৯৩১ সালে এক রচনা থেকে ক’টা লাইন পড়লাম। আজকের সঙ্গে মিল পেলে তা আন-ইনটেন্ডেড অ্যান্ড কোইন্সিডেন্টাল, ঘটনাচক্রে মিলে গেছে আর কী।