skip to content
Saturday, April 19, 2025
HomeScrollFourth Pillar | যত অনাসৃষ্টি, দায়ী আওরঙ্গজেবের গুষ্টি
Fourth Pillar

Fourth Pillar | যত অনাসৃষ্টি, দায়ী আওরঙ্গজেবের গুষ্টি

খেয়াল করুন এই দাসত্বের কাহিনিতে ব্রিটিশরা নেই, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে একটা কথাও নেই

Follow Us :

খেয়াল করেছেন, আপনার হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে, সমাজমাধ্যমে, মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে, বড় বাজেটের ফিল্মে আপনাকে লাগাতার বোঝানোর চেষ্টা চলছে যে আপনার পূর্বপুরুষরা হাজার হাজার হাজার বছর ধরে মুসলমানদের অধীনে ছিল, তাদের দাসত্বে জীবন কেটেছিল। খেয়াল করুন এই দাসত্বের কাহিনিতে ব্রিটিশরা নেই, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে একটা কথাও নেই। এর প্রথম লক্ষ্য হল হিন্দুদের দীর্ঘমেয়াদী মুসলিম নিপীড়নের শিকার হিসাবে তুলে ধরা। সেই ছকবাজির প্রথম ধাপটা হল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের একটা ছবি তুলে ধরা, যেখানে হিন্দু, পরম সহিষ্ণু, আর মুসলমান, হিন্দু রাজপুত রমণীর ইজ্জত নেওয়ার জন্যই এসেছিল। হোয়াটসঅ্যাপে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বকে শক্তিশালী করে এমন ছবি ও বর্ণনা ছড়ানো হচ্ছে, আজ নয় বেশ কিছু বছর ধরে আর তা লাগাতার এবং এক গ্র্যান্ড প্ল্যান, বিশাল পরিকল্পনা মাফিক। উদাহরণ দিচ্ছি, ছত্রপতি শিবাজি আফজল খানকে হত্যা করেছিলেন, একটা ছবি, যাতে আসলে হাইলাইট করা হয়েছে একজন প্রজাবৎসল হিন্দু রাজা কীভাবে একজন মুসলিম আক্রমণকারীকে হত্যা করলেন, তার বহু তথ্য হোয়াটসঅ্যাপে পেয়ে যাবেন, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে এই তথ্য উল্লেখ করা হয় না, হবে না যে আফজল খানের একজন হিন্দু উপদেষ্টা ছিলেন যিনি আফজল খানকে বারবার এই গুপ্ত আক্রমণ নিয়ে সাবধান করেছিলেন, এবং বলা হয় না যে শিবাজির একজন মুসলিম দেহরক্ষী ছিলেন যাঁর পরামর্শ তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। সেদিন ওই গুপ্ত আক্রমণের কথা ওই মুসলমান দেহরক্ষী জানতেন।

একইভাবে, আকবর এবং মহারানা প্রতাপের মধ্যে ঐতিহাসিক কাহিনিও হোয়াটসঅ্যাপে একটা সরল হিন্দু রাজা বনাম অত্যাচারী মুসলিম নবাবের দ্বন্দ্ব হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে জোট এবং পরিচয়ের জটিলতাগুলিকে বলাই হয়নি। দু’পক্ষেই যে মুসলমান, দুপক্ষেই যে হিন্দু ছিলেন, সেসব তথ্য বেমালুম মুছে কেবল হিন্দু আর মুসলমানের গল্পের কথা বলা হচ্ছে। এবং সেই ন্যারেটিভে হিন্দু মানেই প্রজাবৎসল, মুসলমান মানেই আক্রমণকারী। এর সঙ্গেই পরিষ্কার জানানো হচ্ছে যে বিজেপি হল হিন্দুদের দল, উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। দ্বিতীয় লক্ষ্য হল ঘৃণা ও বিভাজন ছড়িয়ে দেওয়া, “হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা” হিন্দুদের এই বিশ্বাস করানোর প্রাণপণ চেষ্টা হচ্ছে যে তারা মুসলমানদের কারণে বিপদে রয়েছে, এবং একমাত্র বিজেপিই হিন্দুদের দল, যারা এই বিপদ থেকে তাঁদের বাঁচাতে পারবে। তিন নম্বর উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের বেছে নেওয়া, তাদের কাছে কিছু তথ্য পাঠানো। যে তথ্য, যে ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে সেসব ঐতিহাসিক নিপীড়ন সত্ত্বেও যেসব হিন্দু রাজা, সামন্তরা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তাঁরা আসলে “ভীরু হিন্দু” আপনি যদি এইসব ভিডিও আর তথ্য দেখে পড়ে উত্তেজিত না হন, বিভাজনমূলক ঐতিহাসিক বর্ণনায় বিশ্বাস না করেন তাহলে আপনি প্রকৃত হিন্দু নন। মাথায় আনুন সেই স্লোগান, অভি ভি জিসকা খুন না খোলা, খুন নহি ও পানি হ্যায়, প্রকৃত হিন্দু হয়ে উঠুন আর তার পরেই সেই অমোঘ বাক্য মনে করিয়ে দেওয়া হবে যে বিজেপিই হল সেই প্রকৃত হিন্দুদের দল। চার নম্বর লক্ষ্য হল সম্প্রীতি, সদ্ভাব, সহযোগিতার সব গল্পগুলোকে মুছে দেওয়া। তাদের ছড়ানো প্রত্যেক ভিডিওতে, লেখায় সাফ বলে দেওয়া হয়েছে যে “পাল্টা হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সুসম্পর্ক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ভাগ করা সাংস্কৃতিক অনুশীলন (গঙ্গা-জমুনি তহজিব) রয়েছে, সে সব আসলে মিথ্যে।

শিবাজির সেনাবাহিনীতে মুসলমান এবং মুঘল প্রশাসনে হিন্দুদের উপস্থিতি, সেইসাথে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় স্থাপনাকে মান্যতা দিয়ে যে প্রচুর কাজ হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে শাসকদের সেসব উদাহরণগুলো আসলে মিথ্যে, সেটা বোঝানোটা একটা কাজ। ধরুন উদাহরণ হিসেবে বলি, গোরখপুরে গোরখনাথ মন্দিরে একটা ধুনি জ্বলে, নেভে না কখনও, গোরখনাথ মঠের দেড় কিলোমিটার দূরে একটা মসজিদেও আর একটা ধুনি জ্বলে, সেটাও নেভে না। পরম্পরা ছিল, যদি কখনও নেভে, তাহলে একে অন্যের আগুন এনে আবার ধুনি জ্বালানো হবে। আজ গোরখনাথ মন্দিরে গিয়ে এই পরম্পরার কথা বললে মার খেতে হবে। পঞ্চম লক্ষ্য প্রতিটা হোয়াটসঅ্যাপের বর্ণনাকে রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে যুক্ত করা, সর্বত্র ছড়ানো ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলোকে প্রধানমন্ত্রী মোদির মতো নেতাদের রাজনৈতিক প্রচার, বক্তৃতার সাথে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে প্রথম সারির আরএসএস বিজেপি নেতারা ক্রমাগত এই হিন্দু মুসলমান বিরোধকে তুলে ধরবেন, হিন্দু ভোটকে এক জায়গাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। এই প্রোপাগান্ডার মূল লক্ষ্য হল “ভাগ করো ও শাসন করো।” ছ নম্বর লক্ষ্য হল হোয়াটসঅ্যাপের বর্ণনার সাথে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোকে মিলিয়ে দেওয়া। এইখানে রামের আঁতুড়ঘর ছিল, এইখানে আসলে শিবলিঙ্গ ছিল, তাজমহল নয়, ওটা আসলে তেজো মহল, আওরঙ্গজেব হিন্দুদের দেখা মাত্র কোতল করার নির্দেশ দিতেন, আস্ত কুমির খেতেন গোছের গল্প।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar । জুমলাবাজ মোদিজি বিবেকানন্দের নামেও মিথ্যে বলছেন

মোদ্দা কথা হল হোয়াটসঅ্যাপ, সমাজমাধ্যম, স্কুলের শিক্ষা, সংবাদমাধ্যম বা সিনেমা, সবটাকেই এক একটা ‘ব্রেনওয়াশিং মাফিয়া’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এক হাতিয়ার যা দীর্ঘমেয়াদি হিন্দু নিপীড়নের একটি বর্ণনা তৈরি করার জন্য ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত করে, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ঘৃণা ও বিভাজন সৃষ্টি করে দেশকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে। এবারে আসুন আমাদের মূল আলোচনায়, গত ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়, প্রধানমন্ত্রী সমেত বিভিন্ন বিজেপি নেতারা আওরঙ্গজেবের অত্যাচার এবং তাঁর শত শত হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেন। এটি একটা বড় ন্যারেটিভ গড়ে তোলার জন্যই করা হয়েছিল, যা কেবল একটা নির্বাচনেই শেষ হবে না, চলতেই থাকবে। ভোটারদের হিন্দু অংশকে বোঝানোর চেষ্টা চলল তাদের হিন্দু পূর্বপুরুষরা হাজার হাজার বছর ধরে মুসলমানদের দাসত্বে আবদ্ধ ছিল, এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন এক মাস্টারমশাই ইতিহাসের কথা বলছেন, অথচ সেই অর্ধসত্য ইতিহাস নয়। এই ইতিহাসের মোড়কে বলে এমনকী নির্বাচনের সময়েও এক খুল্লম খুল্লা সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাজটা সেরে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, এখনও সেই কথাগুলোই বাজারে ঘুরছে। সেই হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে মিডিয়া থেকে সিনেমা সর্বত্র ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে একটি হিন্দু সেনাবাহিনীর নেতা হিসাবে দেখানো হয়েছে, যারা গেরুয়া রঙের পোশাক পরে আওরঙ্গজেবের মুসলিম সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অন্যদিকে আওরঙ্গজেবকে শুধুমাত্র একজন মুসলিম উগ্রপন্থী হিসাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যিনি হিন্দুদের নিপীড়ন করতেন, যেখানে তার সেনাবাহিনীতে কোনও হিন্দু নেই, এরকমটাই বোঝানো হচ্ছে। ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক বিরাট সুসম্পর্কের ইতিহাসকে প্রধানত হিন্দুদের মুসলমানদের দ্বারা নিপীড়নের, অত্যাচারের ইতিহাস হিসেবেই তুলে ধরা হচ্ছে।

কিন্তু সত্যিগুলো কী?

এক) ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ কোনও মুসলমান নবাব, সম্রাটের অধীনে কোনওদিনও ছিলেন না, তিনি একজন মহান সম্রাট ছিলেন যিনি যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাঁর সাম্রাজ্য শক্তিশালী করেছিলেন। তাঁর এক বিরাট লড়াই ছিল ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে যাঁরা আরব সাগরে বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন, তিনি তাঁদের থেকে কর আদায় করতেন, সংঘর্ষ লেগেই থাকত। সে সব সংঘর্ষের কথা ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে, ইতিহাসে শিবাজি একজন হিন্দু সম্রাট আর তাঁর যুদ্ধ কেবল মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে।

দুই) শিবাজির বাবা ছিলেন শাহাজি এবং তার চাচা ছিলেন শরিফজি, যাঁর নাম একজন সুফি সাধকের নামে করা হয়েছিলেন, যা শিবাজির পরিবারে হিন্দু ও মুসলিম সাধকদের প্রতি শ্রদ্ধার ইঙ্গিত দেয়।

তিন) শিবাজি মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সমর্থন করতেন। তিনি প্রায়শই সুফি সাধক ইয়াকুত বাবার কাছে আশীর্বাদ নিতে যেতেন।

চার) শিবাজি আদেশ দিয়েছিলেন যে প্রত্যেকে তার ধর্ম অনুসরণ করার স্বাধীনতা পাবে এবং কেউই তা বিঘ্নিত করতে পারবে না। তার সৈন্যরা কোনও মহিলা, কুরআন বা মসজিদের ক্ষতি করলে অবধারিত ছিল কঠিন শাস্তি।

পাঁচ) শিবাজি একজন মুসলিম গভর্নরের পুত্রবধূকে সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

ছয়) শিবাজির সেনাবাহিনীতে অনেক মুসলমান ছিলেন, যার মধ্যে মুসলিম জেনারেল যেমন নুর খান বেগ (পদাতিক প্রধান), শামা খান (লেফটেন্যান্ট) এবং নৌবাহিনী প্রধান দৌলত খান ও দরিয়া সরং ছিলেন। সিদ্দি হিলাল ও ইব্রাহিম খান তাঁর আর্টিলারি কমান্ড করতেন এবং তার গোয়েন্দা বিভাগের সচিব ছিলেন মৌলানা হায়দার আলি।

সাত) আফজল খান, যাকে শিবাজি বিখ্যাত প্রতাপগড় দুর্গে হত্যা করেছিলেন, তাঁর একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ উপদেষ্টা ছিলেন যার নাম কৃষ্ণমূর্তি ভাস্কর কুলকর্ণী। যিনি বার বার আফজল খানকে এই বৈঠকে যেতে নিষেধ করেছিলেন।

আট) শিবাজি মহারাজ তাঁর মুসলিম দেহরক্ষী সিদ্দি ইব্রাহিম খানের পরামর্শে একটি লোহার নখ, বাঘনখ, ব্যবহার করেছিলেন, এবং সেটা দিয়েই আফজল খানকে হত্যা করা হয়েছিল।

নয়) পুরন্দরের যুদ্ধে, আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মির্জা রাজা জয় সিং, একজন হিন্দু রাজপুত।

১০) আওরঙ্গজেবের প্রধান দেওয়ান ছিলেন একজন হিন্দু, রাজা রঘুনাথ রায়, যাঁকে ঔরঙ্গজেব তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, বহুবার, দরবারে এবং লেখায়।

১১) আওরঙ্গজেবের শাসন আমলে মুঘল প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬৭৯ সালে, আওরঙ্গজেবের প্রায় ৭২ জন রাজপুত এবং ৯৬ জন মারাঠা মনসবদার ছিলেন।

১২) যদিও এটাও সত্যি যে আওরঙ্গজেব ইসলামকে ‘সঠিকভাবে’ প্রতিষ্ঠা করতে কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন এবং হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর শুল্ক বৃদ্ধি করেছিলেন, অন্তত একটা লিখিত দলিল পাওয়া যাচ্ছে যেখানে তিনি ১৬৫৪ সালে একজন হিন্দু রাজপুত রাজাকে একটি রাজকীয় আদেশ পাঠিয়েছিলেন যেখানে তিনি সব ধর্মের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে কথা বলেছিলেন এবং উপাসনালয় ধ্বংসের সমালোচনা করেছিলেন।

১৩) ১৬৫৯ সালে, আওরঙ্গজেব তাঁর কর্মকর্তাদের বেনারাসে কোনও হিন্দু বা ব্রাহ্মণকে ক্ষতি না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬৮৭ সালে, তিনি বেনারাসে পবিত্র ব্রাহ্মণ ও ফকিরদের জন্য বাড়ি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন।

১৪) আওরঙ্গজেব হিন্দু মন্দির ও জৈনদের সমর্থনে করমুক্ত জমি ও গ্রাম দিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু সাধকদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নিতেন এবং তাদের উপহার দিতেন।

১৫) শিবাজি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে কুরআন হল বিশ্বের ঈশ্বরের বাণী, শুধুমাত্র মুসলমানদের নয়, এবং হিন্দু ও মুসলমানরা তার কাছে একই ছিল। তিনি আওরঙ্গজেবের জিজিয়া করের সমালোচনা করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন যে আকবরের মতো পূর্ববর্তী মুঘল শাসকরা এটি চাপাননি এবং এটি দরিদ্রদের উপর বোঝা সৃষ্টি করেছিল বলেই তিনি বলেছিলেন।

১৬) শিবাজি আকবরের প্রশংসা করেছিলেন যে তিনি সকলের সঙ্গে সমান আচরণ করতেন এবং জগৎগুরু হিসাবে সম্মানিত ছিলেন।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ওই সময়য়ের দলিল, শিবাজির আদেশ, চিঠি, ইত্যাদি বলছে আওরঙ্গজেব অন্যান্য রাজা নবাব সম্রাটের মতনই রাজত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিছু ভালো কাজ করেছিলেন, অনেক খারাপ কাজও করেছিলেন। এবং সেই মাপকাঠিতে দেখলে সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসই তাই। শিবাজির সময়েই এক স্বাধীন সৈন্যবাহিনীর জন্ম হয়েছিল যারা মারাঠা সাম্রাজ্যের বাইরের রাজ্য আক্রমণ করে ধনরত্ন লুঠ করে নিয়ে আসতে, মারাঠা কুলপতি, পেশোয়া ইত্যাদিরা পেতেন এক অংশ, বাকিটা তাঁরা তাঁদের সৈন্যদের খরচের জন্য রাখতেন, তাঁদের প্রতি মারাঠা রাজের সমর্থন থাকত, তারাই ছিল বর্গি, বহু পরে তারাই এসেছিল এই বাংলায়, তাদের অত্যাচারের কাহিনি সবার জানা। খোকা ঘুমল, পাড়া জুড়োল, বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে? আবার আওরঙ্গজেবের জিজিয়া কর তো ছিল এক সাম্প্রদায়িক শোষণ। কিন্তু সে তো ইতিহাস, সেসব কবেই শেষ হয়েছে, তারপর ইংরেজ এসেছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ এতদিন পরে স্বাধীন ভারতের শত্রু সেই আওরঙ্গজেব? এতবড় শত্রু যে তার কবর খুঁড়ে ফেলে দিতে হবে? এ কোন অসভ্য দুনিয়াতে ঢুকে পড়ছি আমরা? বিজেপি এবং আরএসএস আওরঙ্গজেবকে অপদেবতা হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ঘৃণা ছড়ানোর হাতিয়ারে শান দিচ্ছে। তাঁর হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং মারাঠা নেতা শম্ভাজি, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পুত্রের হত্যার মতো কর্মকাণ্ডগুলোর জবাব চাইছেন। কেন? হিন্দু জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে উসকে দেওয়ার জন্য, আর কোনও কারণই নেই। আজ নয়, মহারাষ্ট্রের বিজেপি নেতা, তখন উপমুখ্যমন্ত্রী, দেবেন্দ্র ফড়নবিশ ২০২২ সালের মে মাসে এআইএমআইএম নেতা আকবরউদ্দিন ওয়াইসির আওরঙ্গজেবের সমাধি পরিদর্শনের সমালোচনা করেছিলেন, বলেছিলেন যে এটি ‘জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের’ অপমান এবং আওরঙ্গজেব ‘এই দেশের মুসলমানদের জন্য কখনই আইডল হতে পারেন না’। খেয়াল করুন একইভাবে, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছিলেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিয়েছিলেন।

এই ডেমনাইজেশন, অপদেবতা চিত্রায়ন শুধু ঐতিহাসিক নয়, বরং রাজনৈতিক, প্রায়শই হিন্দু আইকন যেমন শিবাজির সাথে তুলনা করা হয়, বিশেষত নির্বাচনী প্রচারের সময়ে এবং তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংসের দাবি, বিজেপি-সমর্থিত সবকটা গোষ্ঠী যেমন বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ২০২৫ সালের ১৫ মার্চ, ‘করসেবা’ (প্রতীকী শুদ্ধি) এর হুমকি দিয়েছে যদি সরকার সমাধিটি সরিয়ে না দেয়, তাহলে তারা এটাকে ধ্বংস করবে, তাদের যুক্তি এটা আওরঙ্গজেবের শাসনামলে হিন্দুদের উপর “শতাব্দীর অত্যাচার, নৃশংসতা এবং দাসত্বের” প্রতীক, সমাধিটা হিন্দুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, ঘৃণা এবং অত্যাচারের স্মারক। সমাধিটা নাকি এক বিভাজনমূলক প্রতীক যা সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উসকে দেয়। সাতারা এমপি উদয়নরাজে ভোঁসলে, বিজেপি নেতা এবং শিবাজির বংশধর, ২০২৫ সালের ৭ মার্চ একটি জেসিবি মেশিন দিয়ে এটি “ধ্বংস করার” কথা বলেছিলেন, আওরঙ্গজেব “চোর ও লুটেরা” তাই তাঁর কবরে শুয়ে থাকার অধিকারও নেই। আর এক বিজেপি নেতা, নবনীত রানা, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে এই কথাটাই আবার বলেছেন, এটা নাকি এক ঐতিহাসিক অন্যায়। যুক্তি ঘৃণা ছাড়িয়ে আর্থিক আলোচনাতেও ঢুকে পড়েছে, বিজেপি বিধায়ক টি রাজা সিং এই সমাধি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর যুক্তি যিনি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, হিন্দু রাজাদের হত্যা করেছিলেন তাঁর কবর সংরক্ষণের জন্য অত্যাচারের প্রতীককে সংরক্ষণের জন্য জন্য ব্যয় করা অনুচিত। আসলে বিজেপি এবং আরএসএস আওরঙ্গজেবকে এক রাক্ষসের মতো চেহারা দিয়ে তাঁর নৃশংসতার উপরে জোর দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচার চালিয়ে ভোট পেতে চায়, এছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্যই নেই। আমরা চোখের সামনে বাবরি মসজিদ দেখেছি, এবারে আওরঙ্গজেবের স্মৃতিসৌধকে ধ্বংস হতে দেখব, তবে ওই হিন্দুত্ববাদীরা হয়তো জানেনই না যে আওরঙ্গজেব ওই চত্বরেই শুয়ে আছেন কোনও এক অখ্যাতনামা কবরে, হ্যাঁ তিনি মারা যাওয়ার আগেই নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর কবরকে যেন অযথা মহিমান্বিত না করা হয়, অন্যান্য মুঘল সম্রাটের মতো তাঁর সমাধি আজ আর চিহ্নিত করার কোনও উপায় তিনি রেখে যাননি।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Russia - Ukraine | Donald Trump | রাশিয়া-ইউক্রেন যু*দ্ধ নিয়ে বিরাট মন্তব‍্য ট্রাম্পের
00:00
Video thumbnail
C. V. Ananda Bose in Murshidabad | মুর্শিদাবাদের জাফরাবাদে রাজ্যপাল, দেখুন সরাসরি
00:00
Video thumbnail
Bangladesh News | মুর্শিদাবাদের অশান্তি নিয়ে বাংলাদেশের বি*স্ফো*রক মন্তব্য, কড়া জবাব ভারতের
00:00
Video thumbnail
C. V. Ananda Bose | র*ণক্ষেত্র বৈষ্ণবনগর,রাজ্যপালকে ঘিরে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ,দেখুন চাঞ্চল্যকর ভিডিও
00:00
Video thumbnail
Murshidabad Unrest | মুর্শিদাবাদে পৌঁছল জাতীয় মহিলা কমিশন, কী কথা বললেন স্থানীয়দের সঙ্গে?
00:00
Video thumbnail
CPIM Brigade Sabha | রবিবার বামেদের ব্রিগেড সভা, আজ থেকেই শুরু জোর প্রস্তুতি, দেখুন সেই ছবি
00:00
Video thumbnail
America | Russia | রাশিয়া-ইউক্রেনের শান্তি চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে আমেরিকা, কারণ কী?
00:38
Video thumbnail
Murshidabad | Congress | মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জে যাচ্ছে কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল
03:21
Video thumbnail
Murshidabad | স্বাভাবিক ছন্দে সামসেরগঞ্জ, শান্তি আর সম্প্রীতির বার্তা দিল মুর্শিদাবাদের আম জনতা
02:09