আমাদের চাওয়ালা কাম চওকিদার দেশের মধ্যে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না, হলেও সেই সব সাংবাদিক মুখোমুখি হন যাঁরা প্রশ্ন করেন, মোদিজি আম চেটে খান না, কেটে খান না, চুষে খান। কিন্তু এবারে এক পিস যোগাড় করেছেন, বিদেশি সাংবাদিক, তাঁকে ঠিক সাংবাদিকও বলা যায় না, ইলন মাস্কের কোম্পানিতে চাকরি করেন, লেক্স ফ্রিডম্যান। ইনিও সেই জিডি গশ, যাঁর বাংলা নাম গুণধর ঘোষ ছিল, সেরকমই এনার নাম আলেক্সেই আলেকজান্দ্রানভিচ ফ্রিডম্যান। আদতে রাশিয়ার লোক, এখন আমেরিকাতে থাকেন, চাকরি ইলন মাস্কের, আর পডকাস্ট, সবই একই গতের। তো সেই পডকাস্টারের মুখোমুখি হয়ে আমাদের মোদিজি অনেক কথা বলেছেন, সে সব নিয়ে দুই কি তিন এপিসোড আলোচনা করতে হবে। আজ তার একটা ছোট্ট অংশ। তিনি ওই পডকাস্টে বলেছেন যে, তিনি নাকি আদতে বিবেকানন্দেরই শিষ্য, তাঁরই আদর্শ মেনেই চলেছেন সারাটা জীবন, আজও বিবেকানন্দই তাঁর আদর্শ। এমনিতে মোদিজি মাঝে মধ্যে সত্যি বলেন, সেদিক থেকে দেখতে গেলে তাঁর কথার ৮০-৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ মিথ্যে, এটাও সেই তালিকাতেই পড়ে। আসুন দেখা যাক, বিবেকানন্দ, মোদি, বিজেপি, আরএসএস-এর মিল আর বিরোধটা কোথায়।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ১৯শতকের একজন ভারতীয় সন্ন্যাসী এবং দার্শনিক, যিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ একটা হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং ভারতীয় জনতা পার্টি তার রাজনৈতিক শাখা। দু’টো সংগঠনই হিন্দুত্ব আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বিবেকানন্দ সব ধর্মের সমন্বয়ে বিশ্বাস করতেন এবং সমস্ত ধর্মকেই সত্যের পথ হিসেবে দেখতেন। ১৮৯৩ সালে বিশ্ব ধর্ম সংসদে তিনি বলেছিলেন, “আমি গর্বিত যে আমি এমন একটি ধর্মের অন্তর্গত, যা বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছে।” অন্যদিকে, আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ব আদতে হিন্দু সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেয় এবং প্রায়ই অন্য ধর্মগুলিকে অস্বীকার করে, তাদের ঘৃণা করে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত একবার নয়, বহুবার ভারতকে আসলে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথার সমালোচনা করতেন এবং সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতেন। তিনি বলেছিলেন, “কাজই মানুষকে হীন করে না, বরং কাজের পিছনের হীন চিন্তা মানুষকে হীন করে।” অন্যদিকে, আরএসএস-বিজেপি কিন্তু জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয় না। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যেও জাতিভেদ নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা যায়। মুখে যাই বলুক দুই সংগঠনই আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদী এক কাঠামোকেই এনে হাজির করতে চায়। বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদ ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক, ইনক্লুসিভ এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করেই তা গড়ে উঠেছিল। তিনি সব ভারতীয়কে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলতেন। অন্যদিকে, আরএসএস-বিজেপির জাতীয়তাবাদ হিন্দু পরিচয়কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এবং প্রায়ই তা আদতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের স্বার্থে বেড়ে ওঠে, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করে। সংখ্যালঘু মানুষদের বিপন্ন করে।
জন্ম-নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে শতহস্ত দূরে থাকা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ বেদান্ত এবং যোগকে পশ্চিমী বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন। তিনি সার্বজনীন আধ্যাত্মিকতা এবং সব ধর্মের সমন্বয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষা নব্য-বেদান্তের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা অদ্বৈত বেদান্ত এবং পশ্চিমী সার্বজনীনতাবাদকে মিলিয়ে দিয়েছিল। তাঁর লক্ষ্য ছিল সমষ্টির মধ্যেই ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিকাশ এবং সামাজিক সংস্কার। অন্যদিকে, আরএসএস, যা ১৯২৫ সালে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা থেকে আজ অবদি একজন বাদ দিলে প্রত্যেক সরসংঘচালক হলেন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ। আর বিজেপি, তার রাজনৈতিক সহযোগী, হিন্দুত্বের ওপর, ব্রাহ্মণ্যবাদের ওপর ভিত্তি করেই রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে তুলেছে। এই আদর্শ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে মনে করে। কেবল মনে করে তাই নয়, বাকিদেরও সেটাই মনে করায়, যা এক ধরণের কর্তৃত্ববাদ। যদিও আরএসএস নিজেকে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে বিজেপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করে, তবুও আসলে দু’টো সংগঠনই ভারতকে একটা হিন্দু-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, এক হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে সংখ্যালঘুদের কোনও জায়গাই নেই। ১৮৯৩ সালের বিশ্ব ধর্ম সংসদে যে মানুষটা বলেছিলেন, “আমি গর্বিত যে আমি এমন একটি ধর্মের অন্তর্গত, যা বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছে। আমরা শুধু সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না, বরং সব ধর্মকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করি।” সেই বিবেকানন্দের শিক্ষা কর্মযোগ, নিঃস্বার্থ সেবা এবং জ্ঞানযোগ এর মাধ্যমে ব্যবহারিক আধ্যাত্মিকতার উপর গড়ে উঠে ছিল। তিনি ধর্মের আনুষ্ঠানিক এবং গোঁড়া দিকগুলোর সমালোচনা করতে ছাড়তেন না। গোহত্যা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর ঠাট্টা তামাশার কথা তো সবাই জানেন। এমনকি হিন্দুধর্মেরও বহু কু-প্রথার বিরোধিতা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি করেছিলেন। তিনি ধর্মকে এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর শিক্ষা হিসেবেই দেখতেন, সেটাই বলতেন, সেটাই প্রাকটিস করতেন। অন্যদিকে, আরএসএস এবং বিজেপি হিন্দুত্বের সাথে যুক্ত, যা সাভারকার বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই আদর্শ হিন্দু সংস্কৃতি এবং জাতীয় পরিচয়কেই ভারতীয় পরিচয়ের মূল বিষয় হিসেবেই দেখে। তাঁরা মুখে দাবি করে যে, তারা সব ধর্মকে সম্মান করে, কিন্তু তাঁদের মূল লক্ষ্য হিন্দু মূল্যবোধ আর হিন্দু ঐতিহ্যকে ভারতীয় পরিচয়ের কেন্দ্রে রাখা, আপনি ভারতীয় মানে আপনাকে হিন্দু সংস্কৃতি মেনেই চলতে হবে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বহু জায়গাতেই বলেছেন যে ভারত একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ সাংস্কৃতিক অর্থে। কিন্তু আমরা তো জানিই যে, এই প্রাধান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের প্রান্তিক করে। বিজেপির নীতিগুলোর দিকে চোখ ফেরান, সেখানেও একই কথা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ, অভিন্ন দেওয়ানি সংহিতার বিতর্ক আসলে তো হিন্দু পরিচয়কেই প্রাধান্য দেয়, যা বিবেকানন্দের সার্বজনীনতাবাদের বিপরীত।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপি চলছে ডালে ডালে, মমতা চলছেন পাতায় পাতায়
মোদি, আরএসএস, বিজেপির সঙ্গে বিবেকানন্দের দর্শনের এক বিরাট তফাত হল স্বামী বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথার তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি এটিকে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখতেন যা হিন্দুধর্মের মূল নীতির বিরোধী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আত্মার কোনো জাতি, লিঙ্গ বা ত্রুটি নেই। তিনি শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতেন। রামকৃষ্ণ মিশনের কাজই সেটা প্রমাণ করে। মিশনের মাধ্যমে তিনি দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষদের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছিলেন, জাতি নির্বিশেষে। প্রায় লোক দেখানোর জন্য আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত কিছুদিন আগেই একবার ব্রাহ্মণদের জন্যই জাতিভেদ থাকবে, এরকম কিছু কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক’দিন পরে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি আসলে ব্রাহ্মণ বলতে ‘পণ্ডিত’ বা ‘জ্ঞানী মানুষ’ বলতে চেয়েছিলেন, যা আদতে জাতিভেদের পক্ষে অত্যন্ত পুরনো এক যুক্তি। আরএসএস সংরক্ষণ নীতিকে সমর্থন করে, সেটা ভোটের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু তা নিয়ে তাঁদের যথেষ্ট জড়তা রয়েছে। যেমাত্র জাতিগত জনগণনার কথা এল, অমনি ওনারা জনগণনাই বন্ধ করে দিলেন। ওনারা জানেন যে, জাতিগত জনগণনা এক সামাজিক দাবি, যা না মানলে তলার সারির মানুষজনদের ভরসা উঠে যাবে আর করলে তাঁদের ব্রাহ্মণ্যবাদ গড়িয়ে খাদে পড়বে। যে কারণে অবস্থা থেকে বাঁচতে তাঁরা জনগণনাকেই স্থগিত রেখেছেন। এটা আসলে বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল, যা নাকি উচ্চবর্ণের সমর্থন এবং নিম্নবর্ণের কাছে পৌঁছনোর মধ্যে একধরণের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু মাথায় রাখুন এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পিওর পলিটিক্স।
স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদী ছিলেন কিন্তু তা ছিল আধ্যাত্মিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, ইনক্লুসিভ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারতের শক্তি তার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং বিভিন্ন মানুষের ঐক্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত, প্রাপ্য বরান নিবোধত, “উঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না।” তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক একচেটিয়া মৌলবাদী চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, বরং সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব এবং সম্প্রীতির উপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদকে মানবতার সেবার মাধ্যম হিসেবে দেখতেন, যেখানে শিক্ষা এবং চরিত্র গঠন জাতীয় অগ্রগতির চাবিকাঠি। সেটাই ছিল রামকৃষ্ণ মঠ মিশন গড়ে তোলার আদত কারণ। অন্যদিকে, আরএসএস-বিজেপির জাতীয়তাবাদ হিন্দুত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা ভারতীয় পরিচয়কে হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই তুলে ধরে। আরএসএস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই নয় বরং এক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছিল, যা এক সংস্কৃতি এক ভাষা এবং হিন্দু পুনর্জাগরণ, এই তিন মূল উদ্দ্যেশ্য নিয়েই চলেছিল। ওনাদের এই জাতীয়তাবাদ আদতে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, দিয়েছে, দেবেও। আর তারই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করে দেবার এক অনবরত চেষ্টা। যেমন ধারা-৩৭০ বাতিল এবং সংখ্যালঘু মানুষজনের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে বিতর্কে দেখা যায়। তাঁরা কী খাবে, কী পরবে, কী ভাবে উপাসনা করবে, সেটাও ঐ মোদি আরএসএস এবং বিজেপি তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে স্থির করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা, চরিত্র গঠন এবং আধ্যাত্মিক জাগরণের মাধ্যমে সামাজিক সংস্কারের করা জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আসল পরিবর্তন ব্যক্তির ভিতর থেকে আসে, নিজের মধ্যে ইশ্বরের উপলব্ধি এবং তাও অন্যের সেবার মাধ্যমে আসবে, বলেছিলেন ‘শিব জ্ঞানে জীবের সেবা’। ১৮৯৭ সালে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ এর সময়ে বিপন্ন মানুষের ত্রাণের মাধ্যমে জাতি বা ধর্ম নির্বিশেষে কাজ করে। সে পদ্ধতি ছিল বিশুদ্ধ অ-রাজনৈতিক। তিনি নারী শিক্ষা এবং ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “একটি জাতির অগ্রগতির সেরা থার্মোমিটার হল, তার নারীদের প্রতি আচরণ।” আরএসএস এক মনুবাদী সংগঠন যাদের নারী সম্পর্কে ধারণা ঐ সরসংঘচালক সাফ বলে দিয়েছেন, মেয়েদের জায়গা রান্নাঘরে, এবং সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়াটাই তাদের কাজ। এক চরম নারীবিরোধী দর্শন নিয়েই আরএসএস গড়ে উঠেছে। আরএসএস এবং বিজেপি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কাজকর্মের মাধ্যমেই সামাজিক সংস্কারের কাজ করেন, যে কোনও কাজ করছেন, অন্য চোখটা আছে ভোটের বাক্সে। সে আরএসএস হোক, ভারতীয় মজদুর সংঘ হোক, এবিভিপি হোক বা বিজেপিই হোক, এনাদের একমাত্র কাজ হিন্দু মূল্যবোধ প্রচার করা। সামাজিক ন্যায় বিচার থেকে সংরক্ষণ সবতাই আসলে ঐ এক হিন্দুত্বের ভিত্তিতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই করা। কোথাও কোনও মিল নেই, বরং বিবেকানন্দের দর্শন, বিবেকানন্দের চিন্তা আরএসএস বিজেপির তীব্র বিরোধী, কিন্তু আরএসএস এবং বিজেপি প্রায়ই স্বামী বিবেকানন্দকে হিন্দু গর্ব এবং জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ উদ্ধৃত করে হিন্দু গর্বের কথা বলেছেন। কিন্তু এই ব্যবহার নির্বাচনী প্রচার ছাড়া কিছুই নয়। বিবেকানন্দের অন্তর্ভুক্তিমূলক, সার্বজনীন দর্শন এবং আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্বের মধ্যে পার্থক্যকে আজ সবার সামনে হাজির। আমিষ-নিরামিষ, দরগা-মন্দির, হিন্দু-মুসলমান এক তীব্র সাম্প্রদায়িক বাইনারির মধ্যেই বিজেপির জন্ম। সেই বাইনারি গড়ে তোলার মাস্টার মাইন্ড ঐ আরএসএস, সেখানে বিবেকানন্দ এক্কেবারেই বেমানান। বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে গ্রহণযোগ্যতার ধর্ম হিসেবে দেখতেন, অন্যদিকে আরএসএস-বিজেপি এটিকে একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে উপস্থাপন করে, যা দিয়ে তারা অন্যান্য ধর্মকে ছোট করে, হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতিকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এখানকার সংখ্যালঘু ধর্মগুলোকে আসলে এক প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখে দাঁড় করায়।
আসলে আরএসএস-এর কোনও আইকন নেই, তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি কাজেই তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও আইকন নেই, তাঁদের ধর্ম বিষয়েও মৌলিক কোনও কাজ নেই, কাজেই তাঁদেরকে আঁকড়ে ধরতে হয়। বিবেকানন্দকে যিনি ওনাদের ঐ এক জাতি, এক ধর্ম এক ভাষা এক খাদ্য ইত্যাদি বকওয়াসের কোনওটাতেই নেই, নেই কিন্তু গেরুয়া আছে, আমাদের মোদিজির তো আবার এই ভেক ধরার ইতিহাস আছে। তিনি ঐ গেরুয়া কে সম্বল করেই বিবেকানন্দকে তাঁদের আইকন বানাতে চান। অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত, বিবেকানন্দ দুকলমও যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা ভুলে গেলেও আরএসএস বিজেপি হতে পারবেন না। সামনে বসে থাকা ঐ লেক্স ফ্রিডম্যান এসবের কিছু জানেনও না, বোঝেনও না। কাজেই তাঁর সামনে ফোকটে বিবেকানন্দপ্রেমী হয়ে ওঠার নৌটঙ্কি করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।