গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই পেয়েছিল ৩০৩টি আসন, ভোট ছিল ৩৭.৩৬ শতাংশ। সেই সময়কার এনডিএ আসন পেয়েছিল ৩৫৩, আর ভোট পেয়েছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। কিন্তু সেই অযোধ্যা তো এখন আর নেই, কাজেই রামও নেই। বড় বড় প্রত্যেক দলই এনডিএ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তাদের ফেরা প্রায় অসম্ভব। এনসিপি বা শিবসেনার এক অংশ ভেঙে এনডিএ-তে গিয়েছে বটে, কিন্তু সার্ভে বলছে তাদের দিকে মানুষের রায় যাবে না। কিন্তু সেসব মাথায় না রেখেও যদি ধরি যে সেই ভোটও এনডিএ-তে যাবে তাহলেও এনডিএ-র আপাতত ভোট ৪০ শতাংশের কিছু কম। উল্টোদিকে পড়েছে ৬০ শতাংশ ভোট। তবুও বিরোধীরা আবার হেরে যেতেই পারেন, কেন হেরে যেতে পারেন, সেটা নিয়েই আমাদের আলোচনা। আমি বলছি না হেরেই যাবেন, জিতলে কীভাবে জিতবেন, কী কী করলে জিতবেন, তা নিয়ে আরেকদিন লিখব। আজ আসুন এটা নিয়েই আলোচনা করা যাক যে বিরোধীরা ২০২৪-এ হেরে গেলে, কোন কোন কারণে হারবেন।
প্রথম কথা হল ওই ৬০ শতাংশ ভোটের অন্তত ৫০ শতাংশ জোটের দিকে আনতে হলে জোট বাঁধতে হবে তো, একটা শক্তপোক্ত জোট। অনেকেই বলেন ৭৭-এ কি বহু আগে থেকে এক জোট তৈরি হয়েছিল? নির্বাচনের ডাক দেওয়ার পরে নেতাদের জেল থেকে ছাড়া হল, ক’ মাসের মধ্যে ভোট হল, কংগ্রেস হেরে গেল। না, এটা পুরো সত্যি নয়, সত্যিটা হল জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিন থেকেই মানুষ তার বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিল। আজও এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে তেমন কোনও মানুষের জোট তৈরি কি হয়েছে? না হয়নি। তাহলে একটা জোট এই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে তৈরি করতে হবে। এবং একটা শক্তপোক্ত জোট হলে যে বিজেপির কপালে দুঃখ আছে তা বিজেপিও জানে। জানে বলেই ওরকম এক নি-জার্ক রিঅ্যাকশন আমরা দেখেছিলাম। ইন্ডিয়া জোটের শুরুর দিনগুলোতে, একই দিনে এনডিএ-র মিটিং ডাকা, ইন্ডিয়া ঘমন্ডিয়া ইত্যাদি কয়েনেজ-এর ব্যবহার, তলা থেকে উপরের বিজেপি নেতাদের এবং তাঁদের কৃপাধন্য চ্যানেলে এই জোটের বিরুদ্ধে প্রচারের রকম দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে বিজেপিও জানে যে এরকম একটা জোট হলে কপালে দুঃখ আছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই জোট তার গতি আর দিশা দুটোই হারাল। আমরা দেশসুদ্ধ নেতাদের এই চার রাজ্যে জনসভা করতে দেখলাম না, আসন ভাগাভাগি ছেড়ে দিন, তা নিয়ে কথাও বলতে দেখলাম না। বহুস্বরের কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, সমস্বরে সামাজিক ন্যায়ের কথা শুনলাম না, দেশের ধুঁকতে থাকা আর্থিক অবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি বা বেকারত্ব তেমন কোনও ইস্যু হল না। উল্টে জোটের মধ্যেই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার হল, পনৌতি, অপয়া ইত্যাদি লুজ টক হল। ফলাফলও চোখের সামনে। তাহলে সমস্যা জোটের মধ্যেই আছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চার রাজ্যের নির্বাচন, কেন এমনটা হল?
প্রথম সমস্যা হল জোটের সবচেয়ে বড় মাথাকে নিয়েই। ২০১৯-এও কংগ্রেসের ভোট ছিল ১৯.৬৭ শতাংশ, ভোট শতাংশের দিক থেকে তারপরের বড় দল তৃণমূল পেয়েছিল ৪.১ শতাংশ। মানে খুব পরিষ্কার যে এই ইন্ডিয়া জোটের স্বাভাবিক নেতৃত্ব থাকবে কংগ্রেসের হাতে। কিন্তু দুটো কারণে এই নেতৃত্ব নিয়ে বহু প্রশ্ন। প্রথম কারণ হল কংগ্রেসের জলসাঘরের জমিদার চরিত্র, তারা এখনও ছোট দলগুলোকে নিয়ে চলতে হবে, বিজেপিকে হারাতে হলে তাদেরকেই সবথেকে বেশি আত্মত্যাগ করতে হবে, এই সত্যিটাকে মেনে নিতে পারছে না, হাতে জমিদারির ঘিয়ের গন্ধ যাচ্ছে না। যদি এই সত্যিটা কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতে পারত, তাহলে রাজস্থানে লোকতান্ত্রিক পার্টি, আদিবাসী পার্টি বা সিপিএম-এর সঙ্গে একটা আসন সমঝোতা হত, মধ্যপ্রদেশে সমাজবাদী দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা হত। হয়নি কারণ তাঁদের অহমিকা বাদ সেধেছে। কোন হ্যায় ওহ অখিলেশ, বকিলেশ, বলেছিলেন কমলনাথ, তিনি কোথায় এখন? আসলে সমস্যা আরও গভীরে, এই জোটের একটা দল নয়, বিভিন্ন দলের সঙ্গে বিভিন্ন দলের নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ঝগড়া আছে, কনফ্লিক্টিং ইন্টারেস্ট। ধরুন আপ, সে দল তো মূলত কংগ্রেসকে সরিয়েই দিল্লিতে, পঞ্জাবে জায়গা করে নিয়েছে, এমনকী গুজরাতের বিধানসভায়। কংগ্রেস ২০১৭তে ৪১.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, আর ২০২২ এ? ২৭.৫ শতাংশ ভোট। গেল কোথায় বাকি ভোট? আপের খাতায়, আপ পেয়েছিল ১৩.৭ শতাংশ ভোট। দুটো বিজেপি বিরোধী ভোট জুড়লে বিজেপি হেরে যেত না, কিন্তু আসন তো বাড়ত।
একই স্বার্থের দ্বন্দ্ব দিল্লিতে, পঞ্জাবে, হরিয়ানায়। পঞ্জাবে কংগ্রেস ২০১৯-এ ৮টা লোকসভার আসন পেয়েছিল, এবার ক’টা আসনে লড়বে? আপ ক’টা আসনে লড়বে? ওই কনফ্লিক্টিং ইন্টারেস্ট। কেরলে বাম কংগ্রেস, দুজনে দুজনকে বিজেপির বি টিম বলে, হ্যাঁ বলে। সিপিএম বাংলাতে তৃণমূলকে বিজেপির বি টিম, বিজেমূল বলে। কেরলে কংগ্রেসকে বিজেপির বি টিম বলে, কংগ্রেস বাংলাতে সিপিএম-এর সঙ্গে জোটে আছে, কেরলে তারা সিপিএমকে বিজেপির বি টিম বলে। বাংলার কথা আলাদা করে বলার নিশ্চয়ই দরকার নেই। জগাই, মাধাই, গদাই থেকে বিজেমূল এখন সব্বাই জানেন। এরপরেও তৃণমূল কংগ্রেসকে ক’টা আসন দিতে পারে? বড়জোর তিন কি চার। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী দল আর কংগ্রেস কে কাকে কত আসন ছাড়বে? এসপি কংগ্রেসকে বড়জোর ৪টে আসন ছাড়তে রাজি, কংগ্রেস কত আসন ছাড়বে তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ওদিকে বিহারের মহা গঠবন্ধনে গত বিধানসভার ফলাফল সাফ বলে দিয়েছে যে কংগ্রেসের কাছে সেই জনভিত্তি আর নেই, এবারে সেই নিয়ে আকচা আকচি শুরু হল বলে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ভেঙেছে, এনসিপি ভেঙেছে, তাদের সেই জোর নেই, কাজেই কংগ্রেস এখন সেখানে বড় দাদা, সেখানেও আসন ভাগাভাগি সহজে হবে না। মানে ওই কনফ্লিক্টিং ইন্টারেস্ট, স্বার্থের লড়াই হল এক বিরাট সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হল ধরুন আসন ভাগাভাগি হল, ভোট দেওয়া নেওয়াটা হবে? মানে মানুষ দলের কথা শুনবে? এতদিন ধরে বাংলাতে কং-বাম জোটের নানান হিসেব চলছে, এখনও কি কংগ্রেসের ভোট বামেরা পায়? প্রত্যেক বাম মানুষজন তাঁর ভোটটা প্রয়োজনে কংগ্রেসকে দেন? দেবেন? উত্তর না।
একইভাবে এসপির ভোট কংগ্রেসে যাবে? বা উল্টোটা, কংগ্রেসের ভোট এসপিতে যাবে? কংগ্রেসের ভোট শিবসেনার কাছে যাবে? এনসিপি-র ভোট কংগ্রেসের কাছে যাবে? কাজে জোট হলেও ভোট হাতবদল হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। আজকাল রাজনীতিতে নীতি আদর্শের কঠাগুলো বেমানান, তবুও একবার ইন্ডিয়া জোটের দিকে তাকান, রামধনু জোট, শিবসেনা কংগ্রেস জোট, তাদের আদর্শের কথাবার্তা তাকে রেখেই তো সম্ভব। ধরুন আপ, তারা ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ সমর্থন করেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে জোটে আছে কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লা বা মেহেবুবা মুফতি। এবং কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট যারা কংগ্রেসের সঙ্গে চিরটাকাল আদর্শের ভিত্তিতেই লড়ে গেল, তাদেরও জোট। রাহুল গান্ধী গতবার ওয়াইনাড়ে নির্বাচনী বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন মার্কসিজম ইজ অ্যা ডেড ফিলোজফি, দলের পলিটব্যুরো নেতা রাহুলের হাত ধরে চলার সওয়াল করেন, দলের নামের পিছনে টিকটিকির ল্যাজের মতো এখনও মার্কসবাদী লেখা আছে। সব মিলিয়ে এই জোটের আদর্শগত কোনও মিল নেই, সেটাও এক সমস্যা। এনডিএতে আদর্শগত মিল আছে? না নেই, কিন্তু এনডিএতে বিজেপি ছাড়া যারা আছে তাদের আদর্শ নিয়ে একফোঁটাও মাথাব্যথাও নেই। এই ইন্ডিয়া জোটের আরও বড় এক সমস্যা হল, হু ইজ এগেইনস্ট মোদি? মোদির বিরুদ্ধে কে? রাহুল গান্ধী? মল্লিকার্জুন খাড়গে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? অরবিন্দ কেজরিওয়াল? এই লড়াইয়ে দুশো মাইল এগিয়ে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি। এগিয়ে থাকবেন তাঁর চালাকি দিয়ে, তাঁর স্ট্রিট স্মার্ট বক্তৃতা দিয়ে, মিথ্যে কথা দিয়ে, কিন্তু এগিয়ে থাকবেন, এটাই মোদ্দা কথা। কাজেই এই জোটের এই চার সমস্যাই আগামী দিনে এই জোটের হারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। খেয়াল করে দেখুন এর একটা সমস্যাও কিন্তু এনডিএ তে নেই, মধুভাণ্ডের ভাগাভাগির জন্য যারা ওই জোটে আছে, তাঁদের কোনও কনফ্লিক্টিং ইন্টারেস্ট নেই। এনসিপি অজিত পাওয়ারকে গোটা ৬-৭ আসন, শিন্ডে শিবসেনাকে গোটা ৫ আসন দিলেই মুখ বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ রাজ্যে খুলে আম লুঠের অনুমতি তো আছে, সেটাই তো স্বার্থপূরণ, সেখানে আদর্শগত কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। ভোট আসবে জেনেই জোট হয়েছে, আর এক ও অভিন্ন নেতা মাথার উপর রয়েছে, ২০২৪-এ বিরোধী দলগুলো যদি আবার বিরাটভাবে হারে, তাদের জোট যদি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে এগুলোই হবে কারণ। কিন্তু আমি কি বলছি এর থেকে বের হওয়ার কোনও উপায় নেই? আছে। সে আলোচনা আগামিকাল।