skip to content
Saturday, July 27, 2024

skip to content
Homeচতুর্থ স্তম্ভFourth Pillar | চার রাজ্যের নির্বাচন, কেন এমনটা হল?

Fourth Pillar | চার রাজ্যের নির্বাচন, কেন এমনটা হল?

Follow Us :

গতকাল আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম যে কী হয়েছে। আলোচনাতে যে মোদ্দা কথাগুলো উঠে এসেছিল তা হল কংগ্রেসের ভোট কমেনি, বিজেপির ভোট বেড়েছে, আর সেই ভোট এসেছে অন্যান্যদের কাছ থেকে। হিসেব সেই কথাই বলছে। এর মধ্যেই মিজোরামের ফলাফল এসেছে, সেখানে একেবারেই অন্য রাজনীতি। একটা দল হঠাৎ করেই উঠে এসেছে, আরেকটা আঞ্চলিক দলের ভোটব্যাঙ্ক তছনছ করে তারা একাই ক্ষমতায় এসেছে। সেখানেও কিন্তু কংগ্রেসের ভোট বিরাট কমেছে তাও নয়, এখনও কংগ্রেস মিজোরামে ২০ শতাংশের বেশি ভোট দখলে রেখেছে। আসন একটাই পেয়েছে কারণ তাদের লড়াই হয়েছে এমএনএফ আর জোরাম পিপলস ফ্রন্টের সঙ্গে। অন্যদিকে বিজেপি ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ২টো আসন পেয়েছে কারণ তাদের আসনে এমএনএফ খানিক ছাড় দিয়েই রেখেছিল। মিজোরাম এক অন্য দিশা দেখাচ্ছে, সে আলোচনা আরেকদিন। আজ আলোচনা এই চার রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট কমেনি, বিজেপির ভোট বেড়েছে, অন্যান্যদের বিরাট ভোট তাদের দিকেই গেছে, এটাই বা কেন? মানে আজ আলোচনার বিষয় বিজেপি তাদের ভোট ধরে রাখল শুধু না, তাদের ভোট বাড়াল। এর পেছনের কারণগুলো কী? একটা সাধারণ কথা তো অনেকেই বলবেন যে বিজেপি ধর্মকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে নেমেছিল, ধর্মীয় মেরুকরণের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই। বিজেপিকে আপাতত আর ওই হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি নিয়ে আলাদা কিছু বলতে হয় না। ভাম বেড়াল দেখেছেন? তাকে আলাদা করে গন্ধ ছড়াতে হয় না, ভাম বেড়াল এল, গন্ধ ছড়াল আর আপনি জেনে গেলেন ভাম এসেছে এমনটা নয়। সে আসে তার গন্ধ নিয়েই, বরং চলে গেলেও সেই গন্ধ রেখে যায়। বিজেপিও খানিকটা তাই, বিজেপি নিজেকে কড়া হিন্দুত্বের সঙ্গে, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িয়ে এক অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব তৈরি করেছে।

এটা ২০১৪-র পর থেকেই শুরু হয়েছে, ২০১৪ র নির্বাচনে তারা হিন্দুত্ব, জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, দুর্নীতি, মহিলা সুরক্ষা, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে নেমেছিল। আজ তাদের আলাদা করে হিন্দুত্ব বা জঙ্গি জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রায় কিছুই বলতে হয় না, ওটা তাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই মিশে আছে। নদীর ধারে জলের শব্দের মতো, খোলা মাঠে শন শন হাওয়ার শব্দের মতো। ওই যে আগেই বললাম, ভাম বেড়ালের গায়ের গন্ধের মতো তারা এলেই ওগুলোও এসে যায়, আলাদা করে আনতে হয় না। এবং এটাই তাদের এক বিরাট কৃতিত্ব। একসময় কংগ্রেস নেতারা আসতেন, তাঁদের সঙ্গেই এসে যেত স্বাধীনতার লড়াইয়ের কথা। বছরের পর বছর জেলে থাকার কথা, গান্ধীর কথা, ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, সত্যাগ্রহের কথা। কমিউনিস্টরা আসত, সঙ্গেই থাকত মিছিলের কথা, থাকত গরিব মহল্লায় তাদের নেতাদের মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার কথা। আসত প্রান্তিক, ছোট কৃষকের ধান গোলায় তোলার কথা, তাদের আত্মত্যাগের কথা, তাদের মেধাবী, তরুণ, শিক্ষিত নেতৃত্বের কথা। আজ? কংগ্রেস কমিউনিস্টরা এলে কি সেসব মনে হয়? মাথায় আসে? বরং উল্টোটা, এখন রাহুল গান্ধীকে আলাদা করে গান্ধীজির কথা বলতে হয়, গ্রামীণ অর্থনীতির কথা বলতে হয়, জওহরলালের রাষ্ট্রীয় শিল্প আর পরিকাঠামোর কথা বলতে হয়। কমিউনিস্ট নেতারা এসে বলেন, আমাদের দলে একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আছেন যিনি চুরি করেননি, যিনি সৎ ছিলেন। আমাদের দলের নেতারা দেখুন ইনসাফ যাত্রায় রাস্তায় বসেই খাবার খাচ্ছেন, তাঁরা যে তৃণমূলের চেয়েও অনেক বেশি সৎ সেই তুলনা বার বার দিতে হয় ইত্যাদি। মানে তাঁদের, তাঁদের দলের, নেতা কর্মীদের অস্তিত্বের সঙ্গেই তা মিশে নেই, আলাদা করে মনে করাতে হয় এবং তার বিপরীত উদাহরণও আছে, যা সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। গান্ধীজির কথা বললেই, আত্মত্যাগের কথা বললেই কংগ্রেসের সেই সব দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কথা মনে পড়ে। কমিউনিস্টরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা বললেই অনিল বসু, লক্ষ্মণ শেঠের প্রসঙ্গ আসবেই।

আরও পড়ুন: চতুর্থ স্তম্ভ (Fourth Pillar) পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন, ফলাফল কী বলছে? (১)

অথচ বিজেপির নরেন্দ্র মোদিই আসুক আর লকেট চ্যাটার্জি, বা তলার সারির কোনও নেতা বা কর্মী, পেছনে তানপুরার মতো বাজতে থাকে হিন্দুত্ব, মুসলমান ঘৃণা, ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে গোছের ভাষণ। কোথাও কন্ট্রাডিকশন আছে? কোথাও? না নেই। হ্যাঁ, এটাই বিজেপির সুবিধে, তাঁরা মাঠে নামলেই, না নেমে সাইডলাইনে বসে থাকলেও তাঁদের ইস্যু মানুষের কাছে পরিষ্কার। তাঁরা মাঠে নেমে সেই ডোজ বাড়ান বা কমিয়ে রাখেন, আলাদা করে কোনও কিছুই বলতে হয় না। তাঁরা এক ফৌজ, তাঁদের নেতা এক হিন্দু হৃদয়সম্রাট, পিরিয়ড। উল্টোদিকে আপনি কখনও নফরত কা বাজারে মহব্বত কা দুকান খোলার কথা বলছেন, কখনও বেনারসে শিবের মাথায় জল ঢালছেন, আপনাদের এক অংশ নাস্তিক, এক অংশ সংখ্যালঘু খ্রিস্টান, মুসলমান। আপনি বলতেই পারেন সেই অংশ তো এখনও সংখ্যাগুরু, হিন্দু, যাঁরা বিজেপির সঙ্গে যাননি। খ্রিস্টান, মুসলমান, যাঁরা শঙ্কিত, আতঙ্কিত, নাস্তিক, যাঁরা চিন্তিত, সেটাই তো বিরাট অংশ, তারাই তো ৫৫-৫৬ শতাংশ। ঠিকই কিন্তু তাদের সবার জন্য একটা ন্যারেটিভ কি তৈরি করা গেছে? বিরোধীরা এসে হাজির হলেই ওই ৫৫-৫৬ শতাংশ মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো কি এসে দাঁড়াচ্ছে সামনে? না দাঁড়াচ্ছে না। তাঁরা কেবল ঐক্যবদ্ধ হননি, আলাদা আলাদা লড়েছেন, ভোট কাটাকাটি হয়েছে। সেটাই একমাত্র কারণ নয়, তাঁরা তাঁদের একটা কমন ন্যারেটিভ, তাঁদের রাজনীতির এক সাধারণ উদ্দেশ্য মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেননি। তাঁরা সমস্বরে বলতেই পারতেন ধর্ম নয়, জাত নয়, ভাষা নয়, মানুষের বাঁচার লড়াইয়ে আমরা শামিল হতে চাই। মানুষের মাথায় একটা শক্তপোক্ত ছাদ, তার চাকরি, তার শিক্ষা, স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি কি দিতে পেরেছেন বিরোধীরা? বা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেসব কি মানুষের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে? কারণ স্বাধীনতার পর থেকেই তো এসব দেওয়ার কথা ছিল। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে অন্য কথা, এসব তাঁরা পেয়েছেন কেবল প্রতিশ্রুতি হিসেবে, এখন বলা হলেই হবে না, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। অন্যদিকে বিজেপির প্রতিশ্রুতিগুলো দেখুন, বাবরি মসজিদ ভাঙব, ভেঙেছে। ৩৭০ তুলে দেব, তুলেছে। তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন আনা হবে, এনেছে। এবারে আসলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড আনবে, আনবেই। অর্থাৎ তাঁদের একটা সেট অফ প্রমিস, তাঁদের এই প্রতিশ্রুতিগুলো তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন, যাঁর ফলে তাঁদের আলাদা করে হিন্দুত্ব নিয়ে কিছু বলতে হয় না।

উল্টোদিকে কংগ্রেস বা আলাদা দল যখন হিন্দুত্ব নিয়ে কিছু বলে, তখন মানুষ ভাবে বিজেপির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে এঁরা কোর্স কারেকশন করছেন, নিজেদেরকে শুধরোচ্ছেন। এবং মানুষ ছাত্রের চেয়ে শিক্ষককে বেশি মানবে, এটা তো সাধারণ কথা। এই কারণেই আজ নতুন করে নয়, বিজেপি বহু আগে থেকেই লড়াইয়ে এক ধাপ এগিয়ে থেকেই মাঠে নামছে। দক্ষিণ ভারতে এটা হচ্ছে না। হচ্ছে না কারণ ওই যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, হিন্দুত্বের, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের, সেগুলো ওখানে কোনওদিনই কাজ করেনি। ওখানে ডমিনেন্ট ইস্যু ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, অর্থনীতি। ওখানে মন্দিরে মন্দিরে পুজো করাটা, মাথায় চওড়া করে চন্দন লেপাটা ৯৯ শতাংশ হিন্দুদের রোজকার অভ্যেস। তেমনই সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। সেখানে আওরঙ্গজেবের অত্যাচারের কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, বরং টিপু সুলতানকে তাঁরা প্রজাবৎসল রাজা বলেই মনে করেন, নিজামের অন্নে প্রতিপালিত হয়েছেন বলতে তাঁদের দ্বিধা নেই। উত্তর ভারতের সীমান্তের লড়াই, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গা দক্ষিণ ভারতকে ছোঁয়নি। বরং দ্রাবিড় ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিজেপির পাল্টা এক ন্যারেটিভ সেখানে মানুষের আছে, যার ফলে সেখানে এখনও বিজেপি দাঁত ফোটাতে তো পারছেই না, ক্রমশ আরও পিছু হঠছে। এই এক ইস্যুতেই দেশে এক কাল্পনিক রাজনৈতিক বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতের তলায় এক অন্য সংস্কৃতি অন্য রাজনীতি, আর উত্তরের অন্তত গোবলয়ে আরেক সংস্কৃতি, আরেক ধরনের রাজনীতি। উত্তর পূর্বাঞ্চলেও এবার তেমনই এক বিভাজন রেখা আর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে। পঞ্জাব, বাংলা বিহার ওড়িশা জুড়ে অবিভক্ত বাংলার এলাকা জুড়ে দিল্লির অধীনতা না মেনে নেওয়ার ইতিহাস, এক ঐতিহ্য এই অঞ্চলগুলোকে কখনওই দিল্লির অনুসারী হয়ে উঠতে দেয়নি, যা আজও বরকরার। পঞ্জাব, ওড়িশা, বাংলার ভাষাও গোবলয়ের সঙ্গে তাদের আলাদা করেই রেখেছে। বিজেপির এই বিপুল জয়ের পেছনে তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের জন্যই হিন্দিভাষী গোবলয়ে তারা এগিয়ে আছে। এবারের চার রাজ্যের ফলাফল সেটাই আবার জানান দিল।

এই চার রাজ্যের এক আধটাতে তারা নাও জিততে পারত, তারা দুটোতে জিতে দুটোতে হারতেও পারত, কিন্তু তাতে করে তাদের ন্যারেটিভ মুছে যেত না, তারা তাদের অস্তিত্বকে ধরেই রাখতো, আবার ফিরে আসতো। এই প্রধান কারণের সঙ্গে জুড়েছে তাদের এক জনপ্রিয় নেতার প্রভাব, স্বাধীনতার পর থেকে এত জনপ্রিয় নেতা, এত ম্যানিপুলেটিভ একজন নেতা, এত ধূর্ত, এতটা নির্বাচনমুখী নেতা আমাদের দেশ আগে দেখেনি। তাঁর অর্বাচীন সমস্ত কাজের পরেও মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে, বিরাট রিসোর্সকে কাজে লাগিয়ে এক লার্জার দ্যান লাইফ ছবি তৈরি করা হয়েছে, যিনি বিজেপির যাবতীয় ন্যারেটিভ সেট করে দিচ্ছেন, কমিউনিকেট করছেন। বিরোধী কিছু নেতারা ভেবেছিলেন ফ্রিবিজ দিয়ে, মানুষকে সরাসরি কিছু বেনিফিট দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বেন। বোঝেননি যে মোদিজি সেই ফ্রিবিজ, সেই রেওড়ি আরও অনায়াসে দিতেই পারেন, এবং তিনি দেশ জুড়েই এক বিশাল লাভ্যার্থী বর্গ তৈরি করে ফেলেছেন। কাজেই ওই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বেশিদিন কাজ দেবে না, এটাও বিরোধীদের বুঝিয়ে দিল এই নির্বাচন। এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দেশ জুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক অভিযান শুরু হয়েছে, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ বিরোধী নেতারাই অভিযুক্ত। কারও কারও ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে কোটি কোটি টাকা, কোনওখানে কেবল যোগাযোগ, সম্পর্ক। এই অভিযানও কোথাও মধ্যবিত্তের এক অংশকে প্রভাবিত করেছে বইকী, যেমনটা ওই মধ্যবিত্তরাই বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদির তোলা ডায়ন্যাস্টিক পলিটিক্স-এর অভিযোগেও সায় দিয়েছে। অর্থাৎ পিছনে কনস্ট্যান্ট ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্থানীয় ইস্যু, ডায়ন্যাস্টিক রুল, দুর্নীতি, লাভ্যার্থী বর্গের রাজনীতি মিলিয়েই বিজেপি জিতেছে। অন্যদিকে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ নয়, তাদের কাছে পাল্টা ন্যারেটিভ রেডি নেই, দুর্নীতির বহু অভিযোগ তাঁরা সামাল দিতে পারছেন না। কংগ্রেস তার বংশানুক্রমিক শাসনের বিরুদ্ধে ওদেরও তো আছে গোছের আলগা যুক্তি দিচ্ছে, বিরোধীরা সফট হিন্দুত্বের খেলা খেলছে এবং বিরোধীদের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, এই সব মিলিয়েই বিরোধীরা হেরেছে, বিজেপি জিতেছে।

RELATED ARTICLES

Most Popular