একটা দেশে অনেকবার স্বাধীনতা হওয়া সম্ভব? একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, ফ্রান্সের স্টাটসবুর্গ, ১২৬২ এ স্বাধীন শহর, ১৬৮১ তে ফ্রান্সের এক শহর, ১৮৭১ এ জার্মানির অংশ, ১৯১৮ তে আবার ফ্রান্সের শহর, জুন ১৯৪০ এ জার্মানির দখলে, নভেম্বর ১৯৪৪ এ আবার ফ্রান্সের অংশ। মানে স্বাধীনতা এসেছে, গেছে, আবার এসেছে, আবার গেছে, প্রত্যেকবার কারেন্সি বদলেছে, বদলেছে ডাকটিকিট, বদলেছে সংবিধান। কাজেই স্বাধীনতা একবার এলেই তা অজর অমর অক্ষয় তা ভাবার কোনও কারণ নেই, তা চলে যেতে পারে, তা অর্জন করার লড়াই আবার হতে পারে, এবং সেই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে পালটে যেতে পারে সংবিধান। আরও একটা বিষয় তো আছেই, নতুন স্বাধীনতার লড়াই হলে সংবিধান যদি এক থাকে তাহলে সেটা তো স্বাধীনতার লড়াই নয়, সেটা তাহলে ক্ষমতা বদলের লড়াই, এক রেজিম থেকে আর এক রেজিমের হাতে ক্ষমতা যাওয়া বা আসা। তো আমরা সেই অর্থে বাংলাদেশে দু’বার এমন স্বাধীনতার লড়াইয়ের কথা শুনলাম, একবার ১৯৭১ এ পাকিস্তান থেকে মুক্ত এক স্বাধীন বাংলাদেশ, আর এখন শুনছি এই জুলাই অভ্যুত্থান নাকি আগস্টের স্বাধীনতার সূচনা করেছে। ইতিহাসের মজাটা হল তা থিতু হতে সময় লাগে, ইতিহাস এক বিষয়কে শেষমেশ কীভাবে দেখবে তা জানার জন্য খানিক সময় দিতেই হয়। ধরুন আমাদের দেশের জরুরি অবস্থা, মনে হয়েছিল মানুষের মৌলিক অধিকার বোধহয় আর থাকবেই না, কিন্তু মাত্র ক’ বছরে তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। পাক হানাদারদের আক্রমণে সারা বাংলাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, মনেই হয়েছিল সব শেষ, মিলিটারির দখলে চলে গেল দেশ, কিন্তু তা তো হয়নি, শেষমেশ রাত্রির বৃন্ত থেকে বাংলাদেশের মানুষ ছিনিয়ে এনেছিল লাল টুকটুকে দিন, সবুজের উপরে লাল বৃত্তের স্বাধীনতা। কাজেই জুলাই অভ্যুত্থান সত্যিই স্বাধীনতা আনল নাকি এক ক্ষমতার হস্তান্তর হল, একদলের হাত থেকে ক্ষমতা গেল, একদলের হাতে ক্ষমতা এল তা তো আগামী ইতিহাস বলবে কিন্তু আপাতত এক নতুন সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে।
ইন ফ্যাক্ট দেশের খোলনলচে বদলে দেওয়ার জন্যই মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেবল সংবিধান নয়, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, নির্বাচন এবং সংবিধান সবকটা বিষয় নিয়েই সংস্কারের জন্য এক কমিটি তৈরি করেছিল, সেই কমিটিগুলো তাদের রিপোর্ট দিয়েছে, এবার তা নিয়ে এক কনসেন্সাস, এক ঐক্যমত্য গড়ে উঠলে তা কার্যকর হবে। এখানে সবথেকে বড় প্রশ্ন কমিটি কী সুপারিশ করল সেটা নয়, সবথেকে বড় প্রশ্ন হল সেই কমিটির যাবতীয় সুপারিশ নিয়ে ঐক্যমতের বিষয়টা। সেটা কীভাবে সম্ভব? ডঃ রিয়াজ আলির নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা করেছে। তাতে বাংলাদেশের এক কক্ষের সংসদের জায়গাতে দুই কক্ষের সংসদের সুপারিশ আছে, মোট আসন অনেকটা বাড়িয়ে ৫০৫ করার সুপারিশ আছে, মহিলাদের জন্য ৫০ এর বদলে ১০০ জনের সংরক্ষিত আসনের কথা বলা আছে, বলা আছে নিম্ন কক্ষ সরাসরি নির্বাচিত হবে, উচ্চ কক্ষের মানে আমাদের এখানকার রাজ্যসভার মত, সেখানে ১০৫ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক ভোটে, মানে ধরুন বি এন পি ৫০ শতাংশ ভোট পেল, তাহলে বি এন পির ৫০ জন সাংসদ যাবেন ওই উচ্চ কক্ষে যাঁদের সরাসরি নির্বাচনে নামতে হবে না আবার জামাত পেল ১০ শতাংশ, তাহলে ১০ জন তাদেরও যাবে। এই সংবিধান সংস্কার কমিটি আগের সংবিধানের ৪টে মূল বিষয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে সুপারিশ করা হয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আগের ৪টি বিষয় আর পরের পাঁচটি বিষয়ের বস্তুত কোনও বিভেদ নেই, তফাৎও নেই, সমাজতন্ত্র এক সাম্যের কথা বলে, গণতন্ত্র কথাটা থাকছে, ধর্মনিরপেক্ষতা উঠে বহুত্ববাদ এবং সামাজিক সুবিচার একই সুরক্ষা দেবে সংখ্যা লঘু মতের মানুষজনকে, মধ্যে এসেছে মানবিক মর্যাদা, যা আজকের দিনে জরুরি, সারা পৃথিবী মানবাধিকার নিয়ে লড়ছে, সেখানে বাংলাদেশ যদি তাদের সংবিধানে মানবিক মর্যাদাকে ঠাঁই দেয় তাহলে তা তো অত্যন্ত ভালো। কিন্তু তা আগের চারটে বিষয়ের এক আমূল পরিবর্তন তাও কিন্তু নয়।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আগামিকাল রায় আরজি কর মামলার, আসুন একটু ফিরে দেখি
সংসদে আসন সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টা এইভাবেও দেখা যায়, স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটির মতন মানুষ ছিলেন আজ কমবেশি ১৭ কোটির কিছু বেশি, কাজেই এই বৃদ্ধি সেই জনসংখ্যাকেই স্বীকৃতি দেবে, মহিলা সংরক্ষণ ৫০ থেকে ১০০ বলে দেয় বাংলাদেশ তার আধুনিকতার পথ থেকে সরে যাচ্ছে না, এক কট্টর ইসলামিক দেশে মহিলাদের এই সংরক্ষণের হার তো থাকে না, কাজেই এটাও আশাব্যঞ্জক। এসব হওয়ার আগেই আগে ছিলেন কিন্তু এখন কাজি নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হল, এও এক ব্যাপার বটে, অজশ্র শ্যামাসঙ্গীতের রচয়িতা এক মানুষ যদি এক ঘোষিত ইসলামিক দেশের রাষ্ট্রকবি হতে পারেন তাহলে তার ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু সমস্যা তো সংবিধান সংশোধনের বা সংস্কারের বিষয় নিয়ে নয়, একটা কথা তো পরিষ্কার যে নতুন এক সংবিধান কিন্তু রচনা হচ্ছে না, বলা ভালো সংবিধানে ব্যাপক সংশোধন আনা হচ্ছে। তা হোক, কিন্তু সেই নতুন সংবিধানই হোক আর সংবিধানের আমূল সংশোধনই হোক, তারজন্য যে ন্যূনতম ঐক্য দরকার, যে ঐক্যমত্য দরকার তা কী করে পাওয়া যাবে? হতেই পারে যে এই সব সংবিধান সংশোধন বা অন্যান্য সংশোধনগুলোকে সামনে রেখেই এক নির্বাচনে যাবেন ইউনুস সরকার, নতুন সরকার আর নতুন সংবিধান একসঙ্গেই পাবেন বাংলাদেশের মানুষজন। কাজেই আপাতত বড় যে প্রশ্নটা উঠে আসবে তা হল নির্বাচন কবে? সেই নির্বাচনের ভোটার লিস্ট কবে ফাইনাল করা যাবে? সেই নির্বাচনের পদ্ধতি কী হবে? সেই নির্বাচন পরিচালনা কারা করবে আর সেই সময়ে এই সরকার কোন ভূমিকা পালন করবে? আর একটা প্রশ্ন তো থাকবেই যে এই নির্বাচনে আওয়ামি লিগ অংশগ্রহণ করতে পারবে? একটা সুস্পষ্ট রায় উঠে আসছে মানুষের মধ্য থেকেই, যে আওয়ামি লিগ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছিল, তারা আর হাসিনার সময়কার আওয়ামি লিগ এক নয়, এমনকী মুজিবের সময়ে বাকসাল চালু করার সময়েও আওয়ামি লিগেও এই সব প্রশ্ন কিন্তু ছিল। পরবর্তীতে এক হাসিনা আওয়ামি লিগ তৈরি হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ, বিক্ষোভ। কিন্তু হাসিনা সমেত পালের গোদারা বাইরে, এখন কি দেশের আওয়ামি লিগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে? না, এখনও পর্যন্ত না বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি না সরকার, কেউই এই বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
এখন গণতন্ত্রের স্লোগানকে সামনে রেখে যদি দেশের এক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই না দেওয়া হয়, তাহলে কি সেই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে? হাসিনা তো ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন, বাংলাদেশ কি হাসিনার পদচিহ্ন ধরে চলবে? সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক সন্ধিক্ষণে, এক বিশাল সম্ভাবনা নিয়েই আমাদের সামনে আবার এ পৃথিবীতে বাঙালির একমাত্র মাতৃভূমি, বহু সংশয় বুকে নিয়েও বহু মানুষ তাকিয়ে থাকবেন আগামী দিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে। আজ নয় সেই কবে থেকেই বাংলাদেশের মধ্যে এক ইসলামিক জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, চালিয়ে যাচ্ছে, তারা আজও সমান সক্রিয়। ঠিক যেমন আমাদের দেশের হিন্দু জঙ্গি জাতীয়তাবাদী স্লোগান তুলে হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য সক্রিয় দল আর রাজনৈতিক শক্তি আজ ক্ষমতায় বসে আছে, কিন্তু খুব বিরাট সুবিধে করে উঠতে পারছে না মূলত দুটো কারণে, ১) আমাদের সংবিধান আর রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনও সেরকম কাজ করার অনুমতি দেয় না। ২) দেশের মানুষ ওই হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করেছে, করছে, যার জন্যই তারা ৩০৩ থেকে এক ধাক্কায় ২৪০ এ নেমে গেছে। আজ বাংলাদেশেও সেই সন্ধিক্ষণ হাজির, কিন্তু ভরসা হল ডঃ রিয়াজ আলির এই কথাটা– আমরা ৭১-এর স্বাধীনতা সংকল্পের উপরে ভিত্তি করেই নতুন দেশ গড়তে চাই, হ্যাঁ ওইখানেই আছে সব জবাব, ওখানেই আছে এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ঠিকানা।