কলকাতা: এরকমই এক তপ্ত বৈশাখের রাতে লোকটার মা প্রায় পনেরো দিনের লড়াই শেষে সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। দিনটা পয়লা বৈশাখ ছিল না। কিন্তু মাসটা বৈশাখই ছিল। বৈশাখ এলেই লোকটার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। এত বছর পরেও এই বুড়ো বয়সেও চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে।
বড় মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। সেই পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যায় মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়া হালখাতার নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। তখন অত দোকান কোথায়? পাড়ায় একটা দুটো মুদির দোকান, একটা সোনার দোকান, মন্টুদার দর্জির দোকান। লোকটার সেই দাদুর আমল থেকে মন্টুদার দোকানে যাতায়াত। কতবার যে দাদুর সঙ্গে সেই দোকানে জামার মাপ দিতে গিয়েছে, তার ঠিক নেই। তারপর দাদু বয়সের কারণে চলাফেরা বন্ধ করে দিল। তারপর থেকে মায়ের সঙ্গে তিন ভাই পুজোর জামার মাপ দিতে যাওয়া। তিনজনের একই রকম ছিট। বোনদেরও তাই। তিন বোনের একই রকম ফ্রক। সেটাও মন্টুদার দোকানে বানাতে হবে।
সেই মন্টুদার দোকানে পয়লা বৈশাখ হালখাতায় যাওয়ার সে কী আনন্দ। যেতাম দল বেঁধে। ছোট্ট একটা প্যাকেট। তাতে একটা দানাদার, একটা প্রায় টোকে যাওয়া সন্দেশ, আর একটা আমিত্তি ( আসলে অমৃতি)। সেটা যে কী করে আমিত্তি হয়ে গেল, আজও বুঝে উঠতে পারেনি লোকটা। আরও ছিল। এক পাতার একটা ক্যালেন্ডার। হয় মা সারদা, নয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ, নতুবা কালী ঠাকুরের ছবি দেওয়া। বাংলা মাসের ক্যালেন্ডার। মন্টুদা সেটা দিতে ভুলে গেলে আবার ছুট লাগাত লোকটা তা আনতে। মন্টুদার দোকান সেরে বুকুদার মুদির দোকান। সেখানেও ছোট প্যাকেটে একটা লাড্ডু, একটা নিমকি, একটা সিঙ্গারা। সঙ্গে ক্যালেন্ডার। সব শেষে স্যাকরার দোকান। আর একটা প্যাকেট। তারপর বাড়িতে ফিরে সেই প্যাকেটের জিনিসগুলোর সদ্ব্যবহার। সকালের মাল বিকেলে হয় টোকে যেত, নয় পিঁপড়ে ধরত। তবু খেয়ে নিত সকলে। তাতেই কী আনন্দ।
বাড়িতে তখন কত লোক। মা প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণি। কত আর মাইনে সেই যুগে? বাবা সাংবাদিক। রোজ রাতে লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরা। তখন সাংবাদিকদেরও বেতন ছিল কম। তবে মান মর্যাদা ছিল। এখন যার বড়ই অভাব। এত লোকের রান্না সেরে মা ইস্কুলে চলে যেত। লোকটা এবং তার ভাইবোনেরা যে যার মতো ইস্কুলে। পয়লা বৈশাখে ছুটি থাকত কি না, এই বুড়ো বয়সে তা আর মনে পড়ে না।
আর ছিল নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর পালা। মায়ের টিনের ট্রাঙ্কে জমা করা থাকত পোস্ট কার্ড। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো পোস্ট কার্ড কী জিনিস, জানেই না। লোকটার মায়ের অভ্যাস ছিল চিঠি লেখা। নববর্ষের কয়েকদিন আগে মা পোস্ট কার্ডের তাড়া নিয়ে বসে যেত চিঠি লিখতে। কূল পুরোহিত ছিলেন লোকটার বাবার অগ্নিসাক্ষী করে মিতা পাতানো। মা সবার আগে সেই তারানাথ কাকুকে চিঠি লিখত, পরম পূজনীয় তারানাথদা, আমার নববর্ষের প্রণাম লইবেন। তারপর মাসীদের, পিসিদের পালা। তুমি আশীর্বাদ লইও, আপনি প্রণাম নিবেন।
আজকের যুগে পোস্ট কার্ড অচল। পোস্টাপিসে এখন আর পোস্ট কার্ড পাওয়া যায় কি না, লোকটা জানে না। এখন তো ফেসবুক, হোয়াটসআপের, ইনস্টাগ্রামেরর যুগ। সেল্ফি তুলে নববর্ষের অভিনন্দন জানানো। বাংলা নববর্ষের অভিনন্দন বা শুভেচ্ছাও ইংরেজিতে। না হলে জাত যাবে যে। হঠাৎ দেখা গেল, অভিনন্দনের বদলে নাকি শুভনন্দনও বলা যেতে পারে। এবার কতজন শুভনন্দন জানাল, দেখতে হবে।
লোকটা ভাবছিল ছেলেবেলার কথা। শহরতলির একটা মফসসল শহরে জন্ম কম্ম, বেড়ে ওঠা। তারপর কাজের টানে কলকাতায় বাস। তবু কি ভোলা যায় পয়লা বৈশাখ মন্টুদা কিংবা বুকুদার দোকানের হালখাতার কথা? আজকে হয়ত সেই মন্টুদার দোকান ভেঙে মস্ত বড় মল হয়েছে। আজকের দিনে ছোটরা দল বেঁধে মা-বাবার হাত ধরে পাড়ার দোকানে হালখাতা করতে যায় কি না, জানা নেই লোকটার। আজকাল কলকাতা শহরে তো বটেই, শহরতলিতেও হালখাতার ধরন পাল্টে গিয়েছে। লোকটা ছেলেবেলায় ভাবতেই পারত না, পয়লা বৈশাখে রেস্তরাঁয় খাওয়া যায়। এখন তো শহরতলিতেও হরেক রকমের রেস্তরাঁর ভিড়। খেতে হলে লম্বা লাইন দিতে হবে, আগে থেকে নাম লেখাতে হবে, টেবিল বুক করতে হবে। পেটে খিদে নিয়ে অন্তত দুঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। অথবা অনলাইনে বাড়িতে খাবার আনিয়ে নিতে হবে।
তবু নববর্ষ আসবে, যাবে। পয়লা বৈশাখ আসবে, যাবে। তা উদযাপনের তরিকাও বদলে যাবে। লোকটার আবার মনে পড়ল মায়ের কথা। চোখটা আবার ভিজে উঠল। এরকম এক তপ্ত বৈশাখেই তো লোকটার মা চলে গিয়েছিল। পয়লা বৈশাখে বড্ড মিস করে লোকটা তার মাকে।